মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী ॥ সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুন না হলে ছিটকে পড়বেন

76
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সচিবালয়ের মন্ত্রী পরিষদ কক্ষে মন্ত্রী পরিষদ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সম্প্রতি ঢাকায় বিভিন্ন ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে অগ্নিনিরাপত্তায় সংশ্লিষ্টদের একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি বনানীতে অগ্নিকান্ডে হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছে মন্ত্রিসভা। সচিবালয়ে সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এই নির্দেশ দেন তিনি। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের একথা বলেন। এছাড়া মন্ত্রীদের আবারও হুঁশিয়ার করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। না হলে ছিটকে পড়বেন। কে কি করছেন সব খবর আছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যখন ভবন তৈরি করা হবে, তখন ফায়ার সার্ভিস একটি ক্লিয়ারেন্স দেয়, এ ক্লিয়ারেন্স যথেষ্ট নয় এর সঙ্গে পরিদর্শন করে এটা ‘ভায়াবল’ কিনা সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, ফায়ার সেফটির বিষয়টি নিয়মিত ইন্সপেকশন (পরিদর্শন) করা। ফায়ার সার্ভিস যে অনুমোদনটা দেয়, এটা ইন্ডাস্ট্রির মতো প্রতি বছর একবার করে নবায়ন করা যায় কিনা- সেটা দেখা।
প্রধানমন্ত্রী বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে ভবন নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছেন। ফ্রিকোয়েন্টলি এক থেকে তিন মাসের মধ্যে বা সুবিধামতো সময়ে অগ্নিমহড়া করা। যাতে সবাই সচেতন হয়। ধোঁয়ায় শ্বাসবন্ধ হয়ে অনেকে মারা যায়, ধোঁয়া কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিছু বিকল্প ব্যবস্থা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে। ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করা গেলে আগুনে মৃত্যুর হার অনেকটা কমে যাবে। ধোঁয়া বন্ধ করার টেকনিক যেটা আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে নেয়া হয় সেটা আমরা কীভাবে নিতে পারি তা দেখাতে হবে। তিনি বলেন, পানির অভাবে অনেক সময় ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে পারে না। পানির অভাবজনিত সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ঢাকায় যে খাল, ডোবা, ঝিল ছিল তা বন্ধ হয়ে গেছে। যেখানে যেখানে সম্ভব জলাধার তৈরি করে পানির অভাব পূরণ করতে হবে।
ভরাট হয়ে যাওয়া লেকগুলো সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধানম-ি ও গুলশান লেক এগুলো যাতে কেউ দখল করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। এখন ফায়ার সার্ভিসের সাকুল্যে তিনটি ল্যাডার আছে, যেগুলো ২৩ তলা পর্যন্ত যেতে পারে। ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা ও ল্যাডারের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
পরিবেশ ও বাস্তবতার দিকে চিন্তা করে যাতে স্থপতিরা প্ল্যানটা করেন। ঘর যেগুলো তৈরি করা হয় তা অনেকটা ম্যাচ বাক্সের মতো। এখানে কোন দরজা-জানালা থাকে না, গ্লাস দিয়ে ব্লক, এসি করা। এবার এটা ভেঙ্গে বেরোতে হয়েছে। এজন্য দরজা, জানালা বা বারান্দা থাক তবে বের হওয়ার একটা সুযোগ যেন থাকে। ফায়ার এক্সিট নিশ্চিত করা। শুধু হাইরাইজ নয়; প্রতিটি দালানে শতভাগ ফায়ার এক্সিট নিশ্চিত করা, যাতে সবাই যেতে পারে।
অনেক স্থানে ইলেক্ট্রনিক সিস্টেমে দরজা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফায়ার এক্সিটগুলো সবসময় ওপেন থাকবে। এটা ইলেক্ট্রনিক সিস্টেম দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করলে যখন ইলেক্ট্রনিক সিস্টেম ফেইল করবে বিদ্যুত থাকবে না তখন এটা চলবে না। এজন্য এটা যাতে ম্যানুয়ালি হ্যান্ডেল করা যায় এভাবে রাখতে হবে।
তিনি বলেন, অনেক দেশে আছে তারপলিনে ঝুলে মানুষ নামতে পারে। এ সিস্টেমটা যে কেউ ব্যবহার করতে পারে। শুধু ফায়ার সার্ভিস করবে তা নয়। তারপলিনে ঝুলে একসঙ্গে অনেক লোক উঁচু ভবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। লাফ দিয়ে পড়ার কারণে অনেকে গুরুতর আহত হয়েছে, মারাও গেছে। তারপলিন থাকলে এটা করা লাগবে না। অনেক জায়গায় নেট সিস্টেম আছে। সেটা ধরে ধরে নামা যায়।
বিশেষ করে হাসপাতাল ও স্কুলগুলো যেখানে লোকসমাগম বেশি হয়, ওখানে অবশ্যই বারান্দা বা খোলা জায়গা রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ‘ইন্টেরিয়র ডেকোরেটর’ যারা করে তারা অনেক সময় এগুলো ব্লক করে দেয়, এটা যেন না করে। আগুন লাগার সময় অনেকে লিফট ব্যবহার করেন। কিন্তু সারা বিশ্বেই আগুন লাগার সময় লিফট ব্যবহার করা নিষেধ। এ জিনিসগুলো ট্রেনিং কিংবা সচেতনতার অভাব আছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রত্যেকটি ভবনে যেন কমপক্ষে একাধিক বের হওয়ার পথ থাকে। অনেক সময় হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে মারা যায়। এটা যেন না হয়- সেই নির্দেশনাও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো-
বহুতল ভবন তৈরির সময় ফায়ার সার্ভিসের ক্লিয়ারেন্সের পাশাপাশি সেটা ‘ভায়াবল’ কি না নিশ্চিত করা। অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা। ফায়ার সার্ভিসের যে অনুমোদন দেয়া হয় কারখানার মতো তা প্রতি বছর নবায়নের ব্যবস্থা করা। বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা। এক থেকে তিন মাসের মধ্যে অগ্নিনির্বাপণ মহড়া করা। অগ্নিকান্ডের সময় ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু এড়াতে ভবনে ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি অবলম্বন। পানির অভাবে অনেক সময় ফায়ার সার্ভিস কাজ করতে পারে না; তাই যেখানে যেখানে সম্ভব জলাশয় বা জলাধার তৈরি করা। লেকগুলো সংরক্ষণ করা। বহুতল ভবনে ওঠার জন্য ফায়ার সার্ভিসের ল্যাডারের সংখ্যা বাড়ানো। প্রকৌশলীরা যেন পরিবেশ ও বাস্তবতার নিরিখে অবকাঠামোর নক্সা করেন তা নিশ্চিত করা। প্রতিটি ভবনে ফায়ার এক্সিট নিশ্চিত করা। অনেক জায়গায় ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে দরজা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফায়ার এক্সিট যেন সব সময় ওপেন থাকে, অর্থাৎ ম্যানুয়ালি যেন তা খোলা যায়। জরুরী প্রয়োজনে মানুষ যেন বহুতল ভবন থেকে তারপলিনের মাধ্যমে ঝুলে নামতে পারে, সেই পদ্ধতি চালু করা। প্রতিটি হাসপাতাল ও স্কুলে বারান্দাসহ খোলা জায়গা রাখা। ভবনে আগুন লাগলে লিফট ব্যবহার না করা। প্রতিটি ভবনে কমপক্ষে দুটি এক্সিটওয়ে রাখা।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বৈঠকে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী অবহিত করেছেন পুরো ঢাকা শহরের জন্য ২৪টি টিম গঠন করা হয়েছে। টিমগুলো পুরো ঢাকা শহরে যত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও হাইরাইজ বিল্ডিং আছে পরিদর্শন করে যেটা কম্প্যায়েন্সের আওতায় আসবে তা ফিট বলে ঘোষণা দেয়া হবে। যেটা আনফিট সেটা বন্ধ করে দেয়া হবে। কঠোর ভাবে এটা এনফোর্স করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে আবারও বলেছেন, সকলে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। না হলে ছিটকে পড়বেন। সকলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কে কি করছেন? কে কোন কাজে কতটুকু আন্তরিক সব খবর আছে। কেউ মনে করবেন না, কেউ কিছু দেখছে না, কেউ কিছু জানছে না। সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের সঙ্গে মন্ত্রীদের জেলায় জেলায় নিজ দফতর পর্যবেক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, দফতর পর্যবেক্ষণে গেলে কাজের গতি বাড়ে। দুর্নীতিও কমে।