সিকৃবির ছাত্র ওয়াসিম হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল সিলেট ॥ বাস চালক ও হেলপারের দায় স্বীকার

34
চৌহাট্টায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও প্রতিকী লাশ নিয়ে শোক। ছবি- রেজা রুবেল

স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) ছাত্র মো. ওয়াসিম আফনান (২১) বাস থেকে ফেলে হত্যার প্রতিবাদে সিকৃবিসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নগরীর চৌহাট্টা ও দক্ষিণ সুরমা সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের চন্দিপুলে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে। ফলে নগরীজুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
এদিকে এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে কোন মামলা করা হবে না বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করবে বলে জানা গেছে। এছাড়া বাসের চালক ও হেলপার প্রাথমিকভাবে পুলিশের কাছে এ হত্যার দায় স্বীকারও করেছে।
গতকাল রবিবার বেলা ১১টার দিকে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন ওয়াসিমের সহপাঠীরা। দুপুর ১২টার দিকে তারা নগরীর চৌহাট্টায় অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। এছাড়া দক্ষিণ সুরমা সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের চন্দিপুল এলাকায় সড়ক অবরোধ করে হত্যার প্রতিবাদ জানায় শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া সিকৃবির শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে ৩ দিনের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে।
‘যে মগজ দেশ গঠনে ব্যবহার হয়, সে মগজ কেন রাস্তায় পড়ে রয়’, ‘জীবনের নিরাপত্তা চাই। এছাড়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সামনের সড়কে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সিকৃবির শিক্ষার্থীরা। ‘দড়ি লাগলে দড়ি নে, ঘাতকের ফাঁসি দে’ এই শ্লোগানে মিছিল আর শ্লোগানের মাধ্যমে সেই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া শ্লোগানে মুখরিত করে তুলে আশপাশ এলাকা। এ সময় শিক্ষার্থীরা ওয়াসিমের হত্যার প্রতিবাদে পাঁচদফা দাবি জানায়। দাবিগুলোর মধ্যে অভিযুক্ত চালক ও হেলপারের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করা, উদার পরিবহরেন রোড পারমিট ও লাইসেন্স বাতিল করা, লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি মহাসড়কে চলতে না দেয়া, অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি না চালানো এবং সড়কে শিক্ষার্থীসহ সকল যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার হুঁশিয়ারি দেন।
আন্দোলনরত সিকৃবি শিক্ষার্থী মাইনুল হাসান বলেন, শেরপুর হাইওয়ে পুলিশ গণমাধ্যমে বলেছে, এটি সড়ক দুর্ঘটনা। আমরা বলছি এটা সরাসরি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
ঘাতকের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আহবায়ক সৈয়দ জুমন বলেন, আমরা আশ্বাস চাইনা, বাস্তবায়ন চাই। বিগত দিনেও আশ্বাসের রাজনীতি আমাদের দেখা হয়ে গেছে। তাই অবিলম্বে ঘাতক বাস চালকের ফাঁসির রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, এই দাবি শুধু এখন সিকৃবি শিক্ষার্থাদেরই নয়, এই আন্দোলন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পরার মধ্য দিয়ে ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকর করা হবে।
ঘটনার পর বাসটিকে ধাওয়া করে ওসমানীনগরের বেগমগঞ্জ থেকে আটক করে পুলিশ। এ সময় চালক ও হেলপার পালিয়ে গেলেও শনিবার রাত ১০ টার দিকে পুলিশ বাসচালক জুয়েল আহমদকে কে আটক করে। এরপর রাত ১ টার দিকে হেলপার মাসুক আলীকেও আটক করে পুলিশ।
চালক হেলপারের শাস্তি দাবিতে সাবেক অর্থমন্ত্রীর একাত্মতা: সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা পোষণ করেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গতকাল রবিবার দুপুর ১২ টার দিকে চৌহাট্টায় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সাথে দেখা করে একাত্মতা পোষণ করেন। এ সময় তিনি চালক ও হেলপারের শাস্তি দাবি করেন। এর আগে সকালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এসময় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুুষও তাদের সাথে একাত্বত্মা পোষণ করেন। তখন তারা ‘দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’, ‘ওয়াসিম হত্যার বিচার চাই’, ‘আমার ভাই মরলো কেনো, বিচার চাই, নিরাপদ সড়ক চাই’ এমন নানা স্লোগান দিতে থাকেন।
ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ সিকৃবির শিক্ষার্থীদের ৩ দিনের কর্মসূচি: সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওয়াসিম আফনানকে বাস দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে ‘হত্যার’ ঘটনায় ৩ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল রবিবার দুপুরে শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে যোগ দেন। দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ চলে। পরীক্ষা স্থগিত, ক্লাস বর্জনসহ সিকৃবি শিক্ষার্থীরা ৩ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ তুলে নেন।
বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, দুর্ঘটনার মামলা নয়, দুর্ঘটনার মামলাকে হত্যা মামলায় নিতে হবে, ৩ দিনের মধ্যে মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে, এ ৩ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণাও দেওয়া হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা ওয়াসিম হত্যার প্রতিবাদে বাসচালক ও তার সহকারীকে আইনের আওতায় এনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফাসি কার্যকর, ঘাতক ‘উদার’ পরিবহন বাসের রুট পারমিট ও লাইসেন্স বাতিলের দাবি জানান। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরাও একই সময় ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করে চালক ও সহকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।
সিকৃবির শিক্ষার্থী হত্যার দায় স্বীকার চালক ও হেলপারের: সিকৃবি ছাত্র মো. ওয়াসিম আফনানকে বাসচাপায় হত্যার ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা পুলিশের কাছে দিয়েছেন উদার পরিবহনের বাসের চালক জুয়েল আহমদ ও তার হেলপার মাসুক আলী। আটকের পরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ঘটনার দায়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এর আগে শনিবার রাতেই ঘাতক (ঢাকামেট্রো-ভ-১৪-১২৮০) বাসকে ওসমানীনগর থেকে, বাসচালক জুয়েল আহমদকে দক্ষিণ সুরমা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে এবং হেলপার মাসুক আলীকে সুনামগঞ্জের ছাতক থেকে আটক করে দক্ষিণ সুরমা থানা ও শেরপুর ফাঁড়ি পুলিশ।
মৌলভীবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) আনোয়ারুল হক জানান, মৌলভীবাজার মডেল থানা পুলিশ স্থানীয় থানা পুলিশের সহায়তায় অভিযান চালিয়ে তাদের নিজ নিজ এলাকা থেকে আটক করেছেন। আটকের পরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ঘটনার দায় স্বীকার করেছেন। চালক ও সহকারীর বরাত দিয়ে তিনি বলেন, শনিবার বিকেলে নবীগঞ্জের টোল প্লাজা থেকে সিলেট যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র উদার পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো-ভ-১৪:১২৮০) বাসে ওঠেন। এ সময় সহকারী মাসুক মিয়া তাদের কাছে ১০০ টাকা ভাড়া দাবি করেন। এ সময় ওয়াসিম ও তার বন্ধুরা ছাত্র পরিচয় দিয়ে ভাড়া কম রাখার কথা বলেন। এতে সহকারী ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়ান। এক পর্যায়ে তারা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শেরপুর মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে নেমে যান। নামার সময় পেছন থেকে বাসের সহকারী তাদের গালি দেন। এ সময় ওয়াসিম বাসের সিঁড়িতে উঠে হাতলে ধরে কেন গালি দিলেন তা জিজ্ঞেস করছিলেন সহকারীকে। তখন গাড়ি চালক গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। ঠিক তখনই সহকারী মাসুক মিয়া ওয়াসিমকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেন। সাথে সাথে বাসের পেছনের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে ওয়াসিম গুরুতর আহত হন। পরে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
এ ঘটনার ব্যাপারে মৌলভীবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল আহামদ বলেন, ওয়াসিমের পরিবার মামলা করবে কি না তা নিশ্চিত নয় পুলিশ। তবে পরিবার মামলা করতে না চাইলে, পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।
গ্রামের বাড়িতে সমাহিত ওয়াসিম: বাসচাপায় নিহত সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (সিকৃবি)-এর শিক্ষার্থী ঘোরি মো. ওয়াসিম আফনানকে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। রবিবার বেলা ৩টার দিকে নবীগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে বাদ জোহর জানাযার নামাজ শেষে তাকে দাফন করা হয়। নিহত ওয়াসিম সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ফলাফল প্রত্যাশী ছাত্র। তিনি হবিগঞ্জে নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের রুদ্র গ্রামের মো. আবু জাহেদ মাহবুব ও ডা. মীনা পারভিনের পুত্র। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওয়াসিমের চাচা শিহাব উদ্দিন।
এর আগে শনিবার রাতে মরদেহ ময়না তদন্ত ছাড়াই হস্তান্তর করেছে পুলিশ। পরিবারের অনুরোধে ময়না তদন্ত ছাড়াই শনিবার রাতে ওয়াসিম আফনানের লাশ হস্তান্তর করা হয় বলে জানান কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সেলিম মিয়া।
শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভের মধ্যেই ময়নাতদন্ত ছাড়াই ছেলের মরদেহ নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন ওয়াসিমের বাবা মো. আবু জাহেদ মাহবুব।