ধর্ষকের নাম-পরিচয় ভালোভাবে প্রকাশ করুন – প্রধানমন্ত্রী

95
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে জয়িতা পদকপ্রাপ্তদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতায়নে সমাজের সর্বস্তরে পুরুষের পাশাপাশি তাদের সমঅধিকার নিশ্চিত করেছে উল্লেখ করে দেশের নারী সমাজকে নিজের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে নিজেদেরই সক্ষমতা অর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যদিও ক্ষমতা দিয়েছি (স্থানীয় সরকারে) তবুও তারা সব জায়গায় ক্ষমতাটি প্রয়োগ করতে পারেন না। যারা দায়িত্বে আছেন (স্থানীয় সরকারে) তাদের নিজেদের ক্ষমতাটা নিজেদের অর্জন করে নিতে হবে। কেউ ক্ষমতা কখনও হাতে তুলে দেয় না, এটা হলো বাস্তবতা।
ধর্ষকের প্রতি যেন সবার ঘৃণা জন্মায়, সেজন্য তাদের নাম-পরিচয় ভালোভাবে প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকাল আমরা দেখি প্রায়ই শিশু ধর্ষণ ও নারী ধর্ষণ। এটা অত্যন্ত গর্হিত একটা কাজ। যারা করে তারা সমাজের শত্রু। তাদের প্রতি ঘৃণা। যারা এ ধরনের কাজ করে, তাদের নাম-ধাম-চেহারা ভালভাবে প্রচার করা এবং নির্যাতিত নারী নয়, যে ধর্ষক তার পরিচয়, তার চেহারা এমনভাবে প্রচার করতে হবে যে সমাজের প্রতি স্তরের মানুষ যেন তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। এভাবে তাকে একেবারে সমাজ থেকে বের করে দেয়া প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে শনিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান।
ধর্ষণকারীর শাস্তি নিশ্চিতে সরকারের সচেষ্ট থাকার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ধর্ষণকে বিশ্বব্যাপী সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এমনকি উন্নত সভ্য দেশেও এ সমস্যাটা রয়েছে। এর বিরুদ্ধে আরও জনমত সৃষ্টি করা দরকার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্থানীয় সরকার আইনে আমরা এক-তৃতীয়াংশ নারী আসনের ব্যবস্থা করেছি। ইউনিয়ন এবং উপজেলাসহ সব জায়গায় একজন চেয়ারম্যানের সঙ্গে ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। আমাদের দেশের মেয়েরা এখন চাকরি-বাকরি, খেলাধূলাসহ সব দিক দিয়ে এগিয়েছে। এমনকি এভারেস্টও জয় করে ফেলেছে। সংসদ সদস্য, বিচারপতি, শিক্ষক, পাইলট, মেজর জেনারেল, পুলিশ, বিমানবাহিনীসহ প্রত্যেকটি স্থানে মেয়েরা কাজ করছে। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীতে এখন অনেক নারী কাজ করেন। এমনিতে নারী পাইলট আছেন। আগামীতে নারীরা বিমানবাহিনীতে ফাইটার জেট চালাবে। আর এ কারণেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা যা পারে মেয়েরা তার থেকে ভালই পারে। তিনি বলেন, এ কথা মনে রাখতে হবে একটা সমাজকে যদি গড়ে তুলতে হয়, আর যে সমাজে অর্ধেক নারী, তাদের বাদ দিয়ে সমাজ কখনো গড়ে উঠতে পারে না।
নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে জনসচেতনতার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা কথা মনে রাখতে হবে, শুধু আইন করলে সহিংসতা বৈষম্য দূর হবে না। এজন্য সমাজের সচেতনতা সৃষ্টি করা একান্তভাবে দরকার। দেশকে গড়ে তুলতে নারী-পুরুষ সবাইকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, একটা কথা মনে রাখতে হবে, সমাজের অর্ধেক যেখানে নারী, তাদের বাদ রেখে একটা সমাজ কখনও গড়ে উঠতে পারে না। সেক্ষেত্রে নারী পুরুষ সমন্বয়ে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করা সব থেকে প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানে নারীদের অধিকার দিয়েছেন বলে নারীরা আজ এগিয়ে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, যে সম্মাননাই পাই না কেন সবই আমার দেশের মানুষের। আজকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে যেই সম্মাননাটা পেয়েছি, সেটা আমি উৎসর্গ করে যাচ্ছি আমার বাংলাদেশের মা-বোনদের, বিশ্বের সকল নির্যাতিত নারীদের। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার আইনে আমরা এক-তৃতীয়াংশ নারী আসনের ব্যবস্থা করেছি। ইউনিয়ন এবং উপজেলাসহ সব জায়গায় একজন চেয়ারম্যানের সঙ্গে ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি বলেন, একটা সময় বলা হতো নারীরা কেন পড়াশুনা করবে। নারীরা ঘরের কোণে বসে থাকবে, রান্না-বান্না করবে আর সন্তান জন্ম দেবে। ধর্মের নামে নারীদের ঘরে আটকিয়ে রাখা হতো। বন্দী করে রাখা হতো। সেই অবস্থা এখন আর নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতা নারীদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা প্রথম যে সংবিধান দিলেন সেখানে তিনি মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত নারী আসন দেন। তিনি মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করে দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন মেয়ে যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীনতা অর্জন করে তাহলে সমাজে তার ভালো অবস্থান হয়। তিনি বলেন, আগে জুডিসিয়াল সার্ভিসে কোন নারী চাকরির সুযোগ ছিল না। বঙ্গবন্ধু এই আইন বাতিল করে দিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে উচ্চ আদালতে একজনও নারী বিচারক ছিলেন না। ওই সময় নাজমুন আরা জেলা জজ ছিলেন। আমরা ক্ষমতায় এসে তাকে হাইকোর্টে নিয়ে আসি। এরপর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলে ১০ শতাংশ কোটায় জুডিসিয়াল সার্ভিসে নারীদের নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া স্থানীয় সরকার আইনে সংরক্ষিত আসন করে দিয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, জেলা প্রশাসক ও এসপির পদে মেয়েদের বাধা ছিল। এপর আমি যাকে প্রথম নারী এসপি করে মুন্সীগঞ্জে আনলাম, তিনি দায়িত্ব নিয়েই ডাকাত ধরে ফেললেন। তার এ কাজের সঙ্গে আমিও জয়ী হয়ে গেলাম। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ এবং পারিবারিক সহিংসতা থেকে সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে তাঁর সরকার কঠোর শাস্তির বিধান রেখে ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা-২০১৩ প্রণয়ন করেছে উল্লেখ করার পাশাপাশি নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তার সরকারের ডিএনএ আইন-২০১৪, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭, যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ প্রণয়ন এবং একই সঙ্গে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ এর সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ মোবাইল কোর্ট আইন- ২০০৯ এর তফসিলভুক্তকরণের কথাও উল্লেখ করেন।
এছাড়াও মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাসে উন্নীত করা এবং পিতার নামের পাশাপাশি মাতার নাম অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক করাসহ ৮টি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে ১৯ হাজার ৯২৯ জন কর্মজীবী নারীর আবাসন সুবিধা প্রদান, কর্মজীবী নারীদের জন্য ৯৪টি ডে-কেয়ার সেন্টারের মাধ্যমে ৩৬ হাজার ১৮৩ জন শিশুকে সেবা প্রদান এবং ২০০৯- ২০১৮ পর্যন্ত ৮টি বিভাগ, ৬৪ জেলা এবং ৪২৬ উপজেলায় ২ লাখ ১৭ হাজার ৪৪০ জন সুবিধাবঞ্চিত দুস্থ নারীকে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদানের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় ৭ জেলার ৮ হাজার উপকারভোগী নারীকে স্বাবলম্বী করতে মাথাপিছু এককালীন ১৫ হাজার টাকা অনুদান ও প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কন্যাশিশুরা যেন কোনভাবেই বৈষম্যের শিকার না হয়, সেই সচেতনতাটা আমাদের সমাজে ইতোমধ্যেই এসে গেছে। আর আমি এটাই মনে করি, সমাজকে গড়ে তুলতে হলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই একান্তভাবে কাজ করা দরকার। ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তা আনিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার এই পঙ্ক্তি উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে সমঅধিকার, সেই অধিকারের কথা তিনি স্পষ্টভাবে বলে গেছেন। কাজেই সমাজ ও দেশকে কল্যাণময় করতে হলে নারী-পুরুষের একসঙ্গে কাজ করাটা জরুরী।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখা এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পাঁচ ক্যাটাগরিতে পাঁচজনকে জয়ীতা পুরস্কার প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন্নাহার। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন্নাহার, বাংলাদেশে ইউএনডিপির প্রতিনিধি মিয়া সেপো প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।