সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ধ্বংসস্তুপে পরিনত হবে আধ্যাত্মিক এই সিলেট নগরী। সম্প্রতি ছোট অর মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প ঘণ ঘণ আঘাত হানায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে লোকজনের মধ্যে। বড়সড় ঝাঁকুনি দিলেই প্রাণ হারাবে মানুষজন। এছাড়া সিলেট সিটি কপোরেশনের আওতাধীন মহানগরীর ২৩টি ঝঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।
ভূমিকম্পনের মাত্রা রিখটার স্কেল ৭ ছাড়লেই সিলেটে ভয়াবহ অবস্থায় পরিনত হবে। সিলেটে ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন ঘিরে এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। পূর্বাবাস আর ঘণঘণ কয়েকটি ভূমিকম্প এই আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
নগরীর বন্দরবাজার, মহাজনপট্টি, লালদীঘিরপার, তালতলা, তেলিহাওয়র, জিন্দাবাজার, কালীঘাট, মেডিকেল রোড, আম্বরখানা, হাউজিং এস্ট্রেট, চৌহাট্টা, শাহজালাল উপশহর, সুবিদবাজার, মদিনা মার্কেট ও আখালিয়ার মতো জনবহুল এলাকাগুলি সবচেয়ে রেড জোনে। ভয়াবহ ভূ-কম্পে ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে এলাকাগুলি। এছাড়া নগরীতে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করে ও সয়েল টেস্ট ছাড়াই ভবন নির্মাণে অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া সিলেটের হরিপুর, গোলাপগঞ্জ রয়েছে ভয়াবহ ডেঞ্জার জোনে। এই দুই এলাকার ভূ-গর্বে তেল-গ্যাস থাকায় বড় ভূমিকম্পে ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। তা হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বহুগুণ বাড়বে।
সিলেটকে ভূমিকম্পে কতটা নাড়িয়ে দিতে পারে একটি গবেষণায় বেশ আগেই দেখিয়েছে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের পুর প্রকৌশল বিভাগ এবং সিলেট ডিজাস্টার ফোরাম। গবেষণায় উঠে এসেছে, ভূমিকম্পের জন্য ডেঞ্জার জোন হিসেবে বিবেচিত সিলেট নগরীর ৯৫ ভাগ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। ৪ দশমিক ৪ ভাগ ভবন বাদে নগরীর সব ভবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধুমাত্র ভবন ধ্বসে ৫০০ কোটি টাকার উপরে ক্ষয়ক্ষতি হবে। মারাত্মকভাবে আহত হবেন প্রায় ৩৭ হাজার লোক। লোকজনের উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস এবং দ্রুত উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য সিলেটে সামান্য কোন ব্যবস্থাই নেই। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় সিলেটে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
ভূমিকম্পের মাত্রা অনুসারে বাংলাদেশকে তিনটি ভূকম্পন বলয়ে ভাগ করা হয়েছে। এক নম্বর বলয়ে ভূমিকম্পের মাত্রা রিকটার স্কেলে ৭ থেকে ৯ পর্যন্ত বা তার অধিক হতে পারে। এই এক নম্বর বলয়েই রয়েছে সিলেটের নাম। সিলেট ছাড়াও এই বলয়ের আওতাভূক্ত এলাকা হচ্ছে ময়মনসিংহ, রংপুর, উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চল। মার্কিন অধ্যাপক রজার বিলহাম ২০০১ সালের আগষ্টে উপমহাদেশের ভূমিকম্প পে¬ট (টেকনোটিক পে¬ট) গবেষণা করে যে রিপোর্ট দিয়েছেন তা জেনে সিলেটের মানুষের চমকে উঠারই কথা।
তিনি রিপোর্টে উলে¬খ করেন, এই দশকের মধ্যেই উপমহাদেশে বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ ও মায়ানমারে বড় ধরণের ভূমিকম্প হবে। আর বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম বলয়ে অর্থাৎ সিলেট অঞ্চলে এই ভূমিকম্পহওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। অন্যদিকে সিলেট ডিজাস্টার ফোরাম আয়োজিত একাধিক সেমিনারে গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সিলেটে বড় ধরণের ভুমিকম্পহওয়ার আশংকা ব্যক্ত করেন। তাদের মতে ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় ১০০ বছর পরপর পুনরায় ভূমিকম্প হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
সিলেটে ১৮৯৭ সালে স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৯৭ সালের ১২ জুনের সেই গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়াক (আসাম আর্থকোয়াক নামে ভারতে পরিচিত) যার মাত্রা ছিল রিকটার স্কেলে ৮ দশমিক ৭। তখন থেকে এ পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান প্রায় ১২১ বছর। এসব তথ্য উপস্থাপন করে বিশেষজ্ঞরা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে ৭ থেকে ৮ এর অধিক মাত্রায় ভূমিকম্পহওয়ার আশংকা ব্যক্ত করেন। কোন কোন জায়গায় বড় ধরণের ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পূর্বে পূর্ভাবাস হিসেবে আগে থেকেই মৃদু ভূকম্পন হয়।
সংশি¬ষ্ট সূত্র জানায়, সিলেট অঞ্চলে ২০০০ সাল থেকে গত ১৮ বছরে প্রায় ৫শ বারেরও বেশী মৃদু ভুকম্পনঅনুভূত হয়েছে। এই তথ্যও সিলেটে বড় ধরণের ভূমিকম্পহওয়ার আগাম ইঙ্গিত বহন করে। গত এক মাসের ব্যবধানে দুটি ভূমিকম্প সিলেটে সংঘটিত হয়েছে। মাত্রা কম থাকলেও বিকট শব্দ আতঙ্ক ছড়িয়েছে বেশ। এছাড়া ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারী সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্প সংঘঠিত হয়। রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার এই ভূমিকম্পে বড় ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বেশ ক’টি ভবনে ফাটল দেখা দেয়। আর গত কয়েক বছরে একাধিকবার ভুমিকম্প হওয়ায় সারাদেশের মতো সিলেটের মানুষের মধ্যেও অজানা আতংক বিরাজ করছে।
এ ব্যাপারে আবহাওয়া অধিদফতরের সিলেট কার্যালয়ের আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ বলেন, সিলেট ইন্দো-অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোশিয়া এই দুটি প¬টের উপর অবস্থিত। এ দু’টি পে¬টই ভূমিকম্প প্রবণ। তিনি বলেন, সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় ১৮৯৭ সালের ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে ইন্দো-অস্ট্রেলিয়া পে¬টে ফল্ট তৈরী হয়েছিলো। এই ফল্টটি সিলেটের খুব কাছেই। সিলেটের গোয়াইঘাটে জাফলংয়ের ওপারে ভারতের ডাউকি এলাকায় ভূগর্বে ফাটল তৈরী হয় ১৮৯৭ সালে। তা ডাউকি ফল্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই ফল্টের কারণে সিলেট বেশ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। তিনি বলেন, ৫৫ ভাগ প্রতিষ্ঠান প্রকৌশলী ভবন নির্মাণে জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে না। যাদের বিল্ডিং কোড নেই তাদের মধ্যে ৩৩ ভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ২২ ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বিশেষজ্ঞদের দাবি, বড় ভূমিকম্প হলে নগরীর বেশিরভাগ ভবনই বড় ক্ষতির বিপর্যয়ে পড়বে। এতে হতাহতের মাত্রাও বেড়ে যাবে অনেক।
সিটি কপোরেশন সূত্র জানায়, সিলেট সিটি কপোরেশনের আওতাধীন মহানগরীর ২৩টি ঝঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, সিলেট কালেক্টরেট ভবন-৩, সমবায় ব্যাংক ভবন, নগরীর জেলরোড মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার সাবেক কার্যালয় ভবন, নগরীর সুরমা মার্কেট, বন্দরবাজার সিটি সুপার মার্কেট, জিন্দাবাজার মিতালী ম্যানশন, দরগা গেইট আজমীর হোটেল, বন্দরবাজার মধুবন মার্কেট, কালাশীল মান্নান ভিউ, শেখঘাট শুভেচ্ছা-২২৬, চৌকিদেখী ৫১/৩ সরকার ভবন, নগরীর যতরপুর নবপু®প-২৬/এ, জিন্দাবাজার রাজা ম্যানশন, পুরানলেন ৪/এ কিবরিয়া লজ, নগরীর খারপাড়ার মিতালী-৭৪, মির্জাজাঙ্গাল মেঘনা-এ-৩৯/২, পাঠানটুলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর বাগবাড়ী ওয়ারিছ মঞ্জিল, একতা ৩৭৭/৭, একই এলাকার হোসেইন মঞ্জিল একতা ৩৭৭/৮, শাহনাজ রিয়াজ ভিলা একতা ৩৭৭/৯, বনকলাপাড়া নূরানী-১৪, ধোপাদিঘীর দক্ষিণপাড় পৌর বিপনী ও ধোপাদীঘিরপার পৌর শপিং সেন্টার।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেছেন, ঝুঁকিপূর্ণ এবং অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ভবনগুলোর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া এসব ঝুঁকিপূর্ণভবনগুলোর জন্য অফিসিয়েল কাজ করে যাচ্ছে সিসিক।
সরেজমিনে এসব ভবন ঘুরে দেখা গেছে, সরকারী প্রতিষ্ঠানে দিব্যি অফিস করছেন কর্মকর্তারা, বাসাতে লোকজন ঝুঁকি নিয়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠা ভবনগুলোতে প্রতিদিনই ব্যবসায়ীরা পুরাদমে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সিলেট কালেক্টরেট ভবন-৩ এ বিল্ডিংয়ের কুটিতে ব্যাপক ফাটল রয়েছে। এ ভবনের সামনে একটি সাইনবোর্ডে সিলেট নির্বাহী প্রকৌশলী সিলেট গণপূর্ত বিভাগ সিলেট কর্তৃক লেখা রয়েছে- “ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় গণপূর্ত অধিদপ্তর কর্তৃক পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ভবনটি ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ করা হলো।” তার পরেও নিচ তলার পশ্চিম পাশে রয়েছে সিলেট জেলা কোর্ট মালখানা, দ্বিতীয় তলার পূর্বে রয়েছে কালেক্টরেট ওয়েলফেয়ার সোসাইটির অফিস, এসএমপি কোর্ট মালখানা ও সিলেট জেলা সমাজ সেবা কার্যালয়। এছাড়া এ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে সিলেট জেলা প্রশাসকের ৩ জন নাইটগার্ডও থাকেন।
এ ভবনে থাকা সিলেট জেলা সমাজ সেবা কার্যালয় (নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল) প্রবেশন অফিসার মো: তমির হোসেন চৌধুরী দৈনিক কাজিরবাজার পত্রিকাকে জানালেন, আমাদের মূল অফিস বাগবাড়ীতে। আদালত থাকায় কাজের সুবিধার্ধে এখানে অফিস নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকের উত্তর পাশে সিলেট কালেক্টরেট-৩ ভবনটি নির্মান ক্রটির জন্য ২০০৭ সালে এটি পরিত্যক্ত ঘোষনা করা হয়েছে। তিনি গর্বের সাথে বলে উঠলেন তারপরেও গত এক যুগ ধরে অফিস করতেছি। কোন অসুবিধা হচ্ছে না।
নগরীর তালতলা ফায়ার সার্ভিস স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, সিলেটে ভূমিকম্প পরবর্তী দ্রুত উদ্ধার কাজের জন্য তাদের কোন যন্ত্রপাতি নেই। ধ্বংসস্তুপ থেকে লোকজন উদ্ধার করার জন্য বুলডোজার, ক্রেনসহ আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি ফায়ার স্টেশনের নেই। যদি কখনো দুর্ঘটনাবশত একটি ৩ তলা ভবনও ধ্বসে পড়ে সেক্ষেত্রেও ফায়ার স্টেশনের করার তেমন কিছু নেই। যন্ত্রপাতি বলতে আছে হাতুরে, শাবল, বেলচার মতো ক্ষুদ্র যন্ত্র। ভবনে মানুষ চাপা পড়লে এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে উদ্ধার করার কোন উপায় নেই। এ ধরণের কোন ঘটনা ঘটলে ঢাকা থেকে যন্ত্রপাতি নিয়ে আসার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
তালতলা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার শিমূল মো: রফি বলেন, বড় ধরনের ভূমিকম্পের পরবর্তী উদ্ধার কাজের জন্য আমাদের প্রাথমিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। এর বেশী কিছু নেই। তিনি বলেন, সকলের সম্বন্বয়ে উদ্ধার কাজ করতে হবে এছাড়াতো আর কোন উপায় নেই। তিনি জানালেন নিজের বিল্ডিংটার দিকে চেয়ে দেখুন আমরা কি অবস্থায় রয়েছি।