আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

68

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কবি রফিক আজাদ ‘পঞ্চানন কর্মকার’ কবিতায় ‘যুগ-পরম্পরাক্রমে প্রাগৈতিহাসিক উৎস থেকে/ উৎসারিত হতে থাকা নিরন্তর মনুষ্য জীবন;/মুদ্রিত গ্রন্থের মূল্যে ইতিহাস : মানব-সভ্যতা-/ দীর্ঘকালব্যাপী অগ্রযাত্রা আর মনন প্রবাহ/বাঙালির দীর্ঘ ইতিহাসে সমৃদ্ধির সূত্রে এই/ গ্রথিত হয়েছে গ্রন্থ : তোমাকেই ঘিরে চলে জানি/ অন্বেষণ-আধুনিক বাঙালির অন্বিষ্ট মনন;’। মাতৃভাষার লড়াইয়ে এমন সব গল্প কবিতার জন্ম দিয়েছে ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেই থেকে বাঙালী জাতি এই দিনটিকে গভীরভাবে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে আসছে।
বাংলাভাষার ওপর প্রথম আঘাত আসে একাদশ শতাব্দীতে ‘সেন রাজাদের’ রাজত্বকালে। তখন বাংলাভাষা এক ভয়ানক সঙ্কট ও অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এ সময় বাংলার বৌদ্ধশাসন উৎখাত করে সেন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা বাংলাভাষা চর্চা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা করেন। বাংলাভাষার বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত ও ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছিলেন, ‘ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে ‘দুর দুর’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণরা যে রূপ দূরে থাকেন, বঙ্গভাষা তেমনই সুধীজনের অপাঙ্ক্তেয় ছিল, তেমনি ঘৃণার, অনাদরের ও উপেক্ষার পাত্র ছিল।’
ভাষা আন্দোলন গবেষক মোহাম্মদ আমীন লিখেছেন, ‘দেড় হাজার বছর আগে প্রকৃত ভাষা থেকে বাংলাভাষা জন্ম নেয়ার পর বাংলার কবি এবং গায়েনরা বাংলাভাষায় কবিতা, গান গেয়ে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ কথাবার্তার মাধ্যমে বাংলাভাষাকে প্রসারের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করে। শিশু ভাষাটি যখন আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছিল তখনই সেন রাজবংশ বাংলাভাষার সর্বপ্রকার ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এমআর মাহবুব ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও একুশের ইতিহাসে প্রথম’ বইয়ে এমন তথ্য উল্লেখ করেন। তার ওই বইয়ে বলা হয়েছে, ষোলো ও সতেরো শতকে বাংলাভাষা রাষ্ট্রীয় কাজে ও বেসরকারীভাবে ব্যবহৃত হত। সেই থেকে বাংলাভাষা প্রথম রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। ভাষাবিজ্ঞানী ড. এসএম লুৎফর রহমান এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, ‘বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বা সরকারী কাজে তার ব্যবহার ঠিক কবে থেকে শুরু হয়, তার নির্দিষ্ট তারিখ জানান না দেয়া গেলেও, এ তরফে সব নমুনা-নিশানা করা গিয়েছে।’ তা থেকে দেখা যায়- সতেরো শতকের পহেলা দশক থেকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি ও সরকারী ব্যবহার ঘটে চলেছে।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রথম মতো দেন, একজন ব্রিটিশ লেখক ‘ন্যাথনিয়েল ব্র্যাসি হলহেড’। বাংলার ১৭৭৮ সালে তার বাংলা ব্যাকরণ বই ‘এ গ্রামার অব দ্যা বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ বইটিতে। হলহেডের বাংলা হরফে মুদ্রিত এটিই প্রথম বাংলা বই। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাভাষার ওপর আঘাত নেমে এলেও কোনকালেও বাংলাভাষাকে শিকলে আটকে রাখতে পারেনি শাসক গোষ্ঠী। ১৯৫২ সালেও পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীও বাংলাভাষার হাতে পায়ে শিকল পরাতে পারেনি।
বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার প্রশ্নটি উত্থাপিত হয় ভারত বিভাগের আগে থেকেই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। সেই সময় পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রীর কাছে বুদ্ধিজীবীরা একটি স্মারকলিপি দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ ও কাজী মোতাহার হোসেনসহ বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী পাল্টা বাংলাভাষার প্রস্তাব দেন। বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষার প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব আসে ‘গণ আজাদী লীগ’ (পরবর্তীতে সিভিল লিবার্টি লীগ)-এর পক্ষ থেকে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে। বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (তৃতীয় খ-) বইয়ে এমন তথ্য উল্লেখ করেছেন।
তৎকালীন সময়ে সংবাদপত্রগুলো পাকিস্তানে বাংলাভাষার সম্ভাবনা নিয়ে বুদ্ধিজীবী এবং জনমত প্রকাশ করতে থাকে। এর মধ্যে ১৯৪৮ সালে ২২ জুন দৈনিক ইত্তেহাদে প্রকাশিত আবদুল হকের কলাম ছিল প্রথম। ২৯ জুলাই ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নিবন্ধটি ছিল বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এসব নিবন্ধের অধিকাংশের বিষয়বস্তু ছিল বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষার মর্যাদা দেয়া প্রসঙ্গে। ১৯৪৭ সালের ৬ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ এর একটি সভায় একই দাবি উত্থাপিত হয়।
বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার লক্ষ্যে, নতুন সংগঠন তমদ্দুন মজলিস, তারা হলেনÑ অধ্যক্ষ আবুল কাশেম, আবুল মনসুর আহমদ এবং কাজী মোতাহার হোসেন। তারা এ বইয়ে বাংলা ও উর্দু উভয়কেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার সুপারিশ করেন। তারা ফজলুল হক মুসলিম হলে ১২ নবেম্বর একটি সভা করেন। এ সভার পূর্বে পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সমাজ ৫ নবেম্বর এ সংক্রান্ত একটি সভা করে। কিন্তু বিদ্যমান অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে ডিসেম্বর মাসে যখন ৫ ডিসেম্বর করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ও মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন প্রদেশে ব্যবহার এবং প্রাথমিক স্তরের আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা এসে জড়ো হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম ও দাফতরিক ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করার দাবি জানানো হয়। ভাষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত প্রথম সভা ছিল সেটি। ডিসেম্বরের শেষেরদিকে ছাত্ররা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে।
বদররুদ্দীন উমরের লেখা ‘ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ-কতিপয় দলিল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটিতে ৩২টি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধি ছিল। ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী মুসলীম লীগ অফিস ৯৪ নবাবপুর রোডে এই কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আবুল হাশিম। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অলি আহাদ এবং আরও কয়েকজন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন ও ভোট দেন। সিদ্ধান্তটি গৃহীত হওয়ার পর আলি আহাদ মন্তব্য করেন যে, কমিটি যে প্রস্তাবই গ্রহণ করুক তাতে কিছু এসে যায় না কারণ পরদিন সকালে ছাত্ররা নিজেরাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। এ কথা শুনে আবুল হাশম সঙ্গে সঙ্গে এই মর্মে একটি প্রস্তাব করে যে, পরদিন সকালে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে যদি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয় তাহলে সেই সঙ্গে সর্বদলীয় কমিটি বিলুপ্ত হবে। এই দ্বিতীয় প্রস্তাব অনুযায়ী শামসুল হক, আজিজ আহমদ ও কাজী গোলাম মাহবুবকে দায়িত্ব দেয়া হয় পরদিন সকালে ছাত্রদের কাছে সর্বদলীয় কমিটির সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করার এবং তাদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা থেকে বিরত রাখার জন্য। পরের দিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ৯৪ নবাবপুর রোডের আওয়ামী লীগ অফিসে যাই। অলি আহাদ তখন সেখানে উপস্থিত হয় এবং জানায় যে একটা দোকানের সামনে থেকে পুলিশ একজন পিকেটারকে গ্রেফতার করেছে। প্রায় সাড়ে ৯টার দিকে অলি আহাদ আবার ওই অফিসে গিয়ে খবর দেয় যে ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণে বহু ছাত্র সমবেত হয়েছে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হওয়া এবং গুলিবর্ষণের পর সর্বদলীয় কমিটির কোন প্রভাব আর থাকেনি এবং তাকে বিলুপ্ত বলেই ধরে নেয়া হয়েছিল।
এদিকে, তমদ্দুন মজলিসের প্রকাশিত পুস্তিকাদি এবং প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাসেম ও তার সহযোগীদের বিভিন্ন সময়ে প্রচারিত বক্তব্যে দেখা যায়, তাদের লক্ষ্য ছিল দেশে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কয়েম করার চেষ্টা চালানো। এরা রাজনৈতিক চিন্তায় প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী ছিলেন। সম্ভবত বাংলা রাষ্ট্রভাষার বিষয়টিকে তাদের এই বিশেষ প্রয়োজনের অংশ হিসেবেই তারা চেয়েছিলেন। বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে সমন্বিত করে নয়। মতাদর্শগত এই বৈশিষ্ট্যের কারণ তারা ভাষা আন্দোলনে আপোসপন্থা গ্রহণে দ্বিধা করেননি। এর প্রমাণ মার্চে জিন্নাহ পূর্ববঙ্গে সফর উপলক্ষে ভাষা বিষয়ক লক্ষ্য অর্জনে তাদের আনন্দ ও প্রত্যাশা এতই স্পষ্ট ছিল যে কোন দূরদর্শিতার পরিচয় না রেখেই লীগ শাসনের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে তারা মাঝপথে আন্দোলন স্থগিত করে দিতে এতটুকু দ্বিধা করেননি। এমন কি জিন্নাহ চলে যাবার পর লক্ষ্য অর্জনে চূড়ান্ত ব্যর্থতা সত্ত্বেও সেই স্থগিত আন্দোলন শুরু করার কোন উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেননি, এ বিষয়ে সংগ্রাম পরিষদকে উজ্জীবিত করার কোন চেষ্টাও তারা করেননি।