কাজিরবাজার ডেস্ক :
আবহমান বাংলার ঐতিহ্যে সাজানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন গণভবনের সবুজ লন শনিবার পরিণত হয়েছিল রাজনৈতিক নেতাদের মিলনমেলায়। বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অনুপস্থিতি এ মিলনমেলায় এতটুকুও ছেদ ফেলতে পারেনি। বরং ওই জোট বাদে ৭৫ দলের মধ্যে বেশিরভাগ নেতাদের সরব উপস্থিতি ও পদচারণায় গণভবন শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির এক অন্যরকম মিলনক্ষেত্রে। রাজনৈতিক আড্ডা, কুশল বিনিময়, পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণে মুখরিত হয়ে ওঠে গণভবনে সবুজ চত্বর।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে যেসব রাজনীতিকের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সংলাপ করেছিল তাদের গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে শনিবার শুভেচ্ছা বিনিময় ও চা-চক্রে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়া শেখ হাসিনা শনিবার নেতাদের সম্মানে এই শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠান ও চা-চক্রের আয়োজন করেন।
অনুষ্ঠানে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি আগামী দিনে ঐক্যবদ্ধভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে বার্তা দিয়েছিলেন, মত-পার্থক্য আলাদা হলেও সব দলকে গণভবনে ডেকে এক সঙ্গে বসে শুভেচ্ছা বিনিময় ও চা-চক্রের মাধ্যমে সেই বার্তাটি আবারও সবার সামনে আনলেন টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসা শেখ হাসিনা। রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে সবার সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথা বলার পাশাপাশি দেশ গঠনে সবার সহযোগিতাও চাইলেন তিনি।
পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে আগত সকল আমন্ত্রিত অতিথিদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, আমরা শুধু চা-চক্রই করিনি, এখানে আমরা রাজনৈতিক ও বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময়ও করেছি। আমাদের আতিথেয়তায় ঘাটতি থাকলে সেটা আমরা হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করেছি।
সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আপনারা প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে এসেছেন, খোলামেলা আলোচনা করেছেন- এর জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। আশা করি, প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ আপনাদের ভাল লেগেছে।’ দেশ গঠনে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সবার সহযোগিতা কামনা করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, নির্বাচনের সময় দেয়া অঙ্গীকারগুলো ‘প্রধানমন্ত্রী অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চান। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আপনাদের সবার সহযোগিতা চাই।’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের পহেলা নবেম্বর থেকে সংলাপ শুরু করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ৭৫ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। ওই সংলাপে অংশ নেয়া সব দলের নেতাদেরই চা-চক্রে আবারও আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকরা গণভবনে যায়নি। তারা যে চা-চক্রে অংশ নিচ্ছে না তা শুক্রবারই জানিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে গণভবনে হাজির হয়েছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতারা। সবার মুখেই ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের হাসি, আনন্দ। বিজয়ের আনন্দ নিয়েই দুপুর আড়াইটা থেকেই একে একে আসতে থাকেন নেতারা। বিকেল চারটায় প্রধানমন্ত্রী গণভবনের সবুজ লনে উপস্থিত হওয়ার আগে বিভিন্ন দলের বিপুলসংখ্যক নেতাদের সরব উপস্থিতিতে মিলনমেলায় পরিণত হয় প্রধানমন্ত্রীর এই চা-চক্র।
পরিপূর্ণ বাঙালি সংস্কৃতির আদলে ও আবহমান বাংলার ঐতিহ্যে সাজানো হয়েছিল গণভবনের সবুজ লনটি। বাজানো হয় দেশের গান। অতিথিদের বসার জন্য গণভবনের সবুজ লনে চেয়ার টেবিল মোড়া মাদুরের ব্যবস্থা করা হয়। কুঁড়েঘরে বাঙালীয়ানা নানা খাবারে আপ্যায়িত হন অতিথিরা। ফুচকা চটপটির জন্য আলাদা আলাদা টেবিল রাখা হয়। পিঠার টেবিলে ছিল পাটিসাপটা, ভাপা, চিতই, পুলি, জিলাপি প্রভৃতি। ছিল বিভিন্ন ধরনের কাবাব, নানরুটি, পরোটা। খাবারের তালিকায় আরও ছিল বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফল, নানা ধরনের শরবত, জুস, চা-কফিসহ বাঙালি ঐতিহ্যের নানা খাবার।
প্রধানমন্ত্রী গণভবনের মাঠে আসেন বিকেল চারটার পরে। তিনি সবুজ লনে ঘুরে ঘুরে অতিথিদের সঙ্গে সহাস্যে শুভেচ্ছা ও কুশলা বিনিময় করেন। অনেক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি নেতাদের স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নেন প্রধানমন্ত্রী। চা-চক্র চলে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা পর্যন্ত। পরে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাড়ির দক্ষিণের সবুজ লনের এই অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ছাড়াও প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দলসহ ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতৃবৃন্দ, যুক্তফ্রন্ট, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, তরিকত ফেডারেশন, বিএনএসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত হন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টানা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, নুরুল ইসলাম নাহিদ, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, মুহাম্মদ ফারুক খান, আব্দুল মতিন খসরু, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী এডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, উপমন্ত্রী এনামুল হক শামিম, হুইপ ইকবালুর রহিম, ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, দেলোয়ার হোসেন, ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ, দলের কো-চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদের, মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা, সাবেক মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদার, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, আবু হোসেন বাবলা ও সুনীল শুভ রায় প্রমুখ।
জাতীয় পার্টি (জেপি) সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার, জাসদের (আম্বিয়া) মইনউদ্দীন খান বাদল, নাজমুল হক প্রধান, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খানসহ দলগুলোর অন্যান্য নেতাও শরিক হন চা-চক্রে।
প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গণভবনের চা-চক্র ও শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি ও যুক্তফ্রন্টের প্রধান সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মহাসচিব মেজর (অব) আবদুল মান্নান, মাহি বি চৌধুরী, শমসের মবিন চৌধুরী, ইসলামী ঐক্যজোটের সভাপতি মিজবাহুর রহমান চৌধুরী, তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভা-ারী, বিএনএ সভাপতি ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাসহ আরও অনেকে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও চা-চক্রে অংশ নেন।
বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট চা-চক্রে না এলেও গণভবনের পরিবেশ খুবই প্রাণবন্ত ছিল বলে জানিয়েছেন চা-চক্রে অংশ নেয়া বিভিন্ন দলের নেতারা। এ বিষয়ে আলাপকালে তারা বলেন, খুবই প্রাণবন্ত পরিবেশে গণভবনে চা-চক্র অনুষ্ঠিত হয়েছে। আন্তরিক পরিবেশে সকলেই আড্ডা-গল্পে সময় কাটিয়েছেন। বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট না আসায় মনে হয় সকলে খুশিই হয়েছেন। কারণ, বিএনপি একটি রাজনৈতিক পরিবেশ দূষণকারী দল। দলটির নেতারা সৌহার্দ্যরে রাজনীতি বোঝেও না, উদারপন্থায়ও বিশ্বাস করেন না।
গণভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিকল্প ধারা বাংলাদেশ ও যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডাঃ এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক কোন বক্তব্যে বা এ ধরনের কিছুই হয়নি। শুধু চা-চক্র হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সবার সঙ্গে কথা বলেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বসেছিলেন, নির্বাচনের পর আবারও বসলেন। চা খাওয়া ও কুশল বিনিময়ই মূল বিষয় ছিল।