কাজিরবাজার ডেস্ক :
অন্তিম শয়ানের আগে প্রমাণ করে গেলেন কত বড় গণমানুষের নেতা ছিলেন সৈয়দ আশরাফ। জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহে তিন পৃথক জানাজায়ই ছিল শোকার্ত মানুষের ঢল। বুকফাটা কান্না, আর্তনাদ আর আহাজারিতে ভরা লাখো মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় বিদায় নিলেন সৈয়দ আশরাফ। পরিচ্ছন্ন, সততার
মূর্ত প্রতীক শুদ্ধ মানুষ যে ছিলেন সৈয়দ আশরাফ, তিন স্থানেই শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা লাখো মানুষের ঢলই তার প্রমাণ দিয়েছে।
সততা, নির্লোভ মানসিকতা আর রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সৈয়দ আশরাফ শেষ যাত্রায় শ্রদ্ধা পেয়েছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছ থেকেও। স্বজন, আপনজন ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাঁদিয়ে ও লাখো মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রবিবার বাদ আসর বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্র্রায় শায়িত হলো এই ক্ষণজন্মা রাজনীতিক।
এমপি হিসেবে শপথ নেয়ার জন্য সময় চেয়ে স্পীকারকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম; সেই সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে তিনি এলেন, কফিনবন্দী হয়ে। রবিবার সকালে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে অশ্রুসিক্ত বিদায় জানান তার সহকর্মীরা। সেখানে জাতীয় ও দলীয় পতাকায় মোড়া কফিনে ফুল দিয়ে এই আওয়ামী লীগ নেতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের হাজারো নেতাকর্মী সৈয়দ আশরাফের জানাযায় অংশ নিয়ে স্মরণ করেন তাদের ‘দুঃসময়ের কা-ারীকে’।
৬৭ বছরের সৈয়দ আশরাফ ফুঁসফুঁসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কয়েকমাস চিকিৎসাধীন থাকার পর বৃহস্পতিবার রাতে তিনি ইন্তেকাল করেন। শনিবার সন্ধ্যায় সৈয়দ আশরাফের মরদেহ দেশে আনার পর রাতে তার দেহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। রবিবার সকাল দশটায় প্রথমে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রথম নামাজে জানাযা হয়। এরপর তার মরদেহ হেলিকপ্টারযোগে নেয়া হয় তার নির্বাচনী এলাকা কিশোরগঞ্জে। সেখানে দেশের বৃহত্তম ময়দান শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে দ্বিতীয় দফা নামাজে জানাযার পর তার মরদেহ নেয়া হয় ময়মনসিংহ আঞ্জুমান ঈদগাহ মাঠে। সেখানে তৃতীয় দফা নামাজে জানাযা শেষে তার মরদেহ ঢাকায় এনে বাদ আছর বনানী কবরস্থানে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফকে চিরনিদ্র্রায় শায়িত করা হয়।
দক্ষিণ প্লাজায় শোকার্ত মানুষের ঢল : সততার মূর্ত প্রতীক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় নেমেছিল শোকার্ত মানুষের ঢল। তার জানাযায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে দক্ষিণ প্লাজা ছিল পরিপূর্ণ। সংসদ প্লাজায় এমপি বা সাবেক এমপিদের জানাযায় সাধারণ যত মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়, সৈয়দ আশরাফের জানাযায় উপস্থিতি ছিল কয়েকগুণ বেশি। দক্ষিণ প্লাজার ওপরের চত্বর পূর্ণ হয়ে সিঁড়ি এবং সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে জানাযায় অংশ নেন কয়েক হাজার শোকার্ত মানুষ। মানুষের এই ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।
সকাল সাড়ে দশটার কিছু আগে সৈয়দ আশরাফের কফিন সংসদ চত্বরে আনার পর একাত্তরের এই মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। এ সময় বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর। শেষ বিদায়ের আগে একাত্তরের রনাঙ্গণের মুজিব বাহিনীর এই যোদ্ধার প্রতি ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয় রাষ্ট্রীয় সম্মান। পরে সৈয়দ আশরাফের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পীকার এডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া। পরে জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে দলের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী সৈয়দ আশরাফের প্রতি শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। শোক সন্তুপ্ত পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।
সংসদ সচিবালয় জামে মসজিদের ইমাম আবু রায়হানের পরিচালনায় জানাযা ও মোনাজাত শেষে সৈয়দ আশরাফের মরদেহে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা। জানাযার আগে সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন তার ছোট ভাই ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
শ্রদ্ধা ও জানাযায় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, ওবায়দুল কাদের, মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ড. আবদুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব) ফারুক খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আসাদুজ্জামান নূর ছাড়াও আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সামরিক-বেসামরিক উর্ধতন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন শ্রেণীর পেশার মানুষ অংশ নেন।
কিশোরগঞ্জ : অকাল প্রয়াত জননেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে অশ্রুসিক্ত ভালবাসায় চির বিদায় জানিয়েছে কিশোরগঞ্জবাসী। একজন রাজনীতিক নিজ এলাকায় কতটা জনপ্রিয় হতে পারেন, শেষ যাত্রায় লাখো মানুষের ঢল তার প্রমাণ মিলেছে। দলমত নির্বিশেষে তিন লক্ষাধিক মানুষ তার জানাযায় অংশ নিয়ে শোকাবহ পরিবেশে বেদনাবিধূর চিত্তে শেখ দেখা ও চোখের জলে তাকে বিদায় জানিয়েছেন।
এর আগে দুপুর একটার দিকে একটি হেলিকপ্টারযোগে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নিথর দেহ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্টেডিয়ামে আনা হয়। সেখানে জাতীয় পতাকা মোড়ানো কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা। সেখান থেকে মরদেহবাহী গাড়ির বহর পৌঁছে শোলাকিয়া মাঠে। দুপুরের আগেই বিশাল শোলাকিয়া ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। জানাযার পূর্বে সৈয়দ আশরাফকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। দুপুর দেড়টায় কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া মাঠে সৈয়দ আশরাফের দ্বিতীয় নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা পড়ান শহরের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা খলিলুর রহমান।
জানাযায় অংশ নেন সঙ্গে আসা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, বিসিবি সভাপতি নাজমুর হাসান পাপন এমপি, আফজাল হোসেন এমপি, রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক এমপি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুল আহসান হুমায়ুন, জেলা প্রশাসক সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী, পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদসহ বিশিষ্টজনেরা। এ সময় সৈয়দ আশরাফের তিন ভাই মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ শাফায়াতুল ইসলাম, ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, ড. সৈয়দ শরীফুল ইসলাম, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের একমাত্র মেয়ে সৈয়দা রীমা ইসলাম, দুই বোন সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি, সৈয়দা রাফিয়া নূর রুপাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। নামাজে জানাযা শেষে তার মরদেহ ময়মনসিংহে নেয়া হয়।
ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহের মাটি ও মানুষের প্রিয় নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের তৃতীয় নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় জেলার আঞ্জুমান ঈদগাহ মাঠে। বিকেল পৌনে তিনটার দিকে অনুষ্ঠিত এই নামাজে জানাযায় ইমামতি করেন আঞ্জুমান ঈদগাহ মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা আবদুল্লাহ আল মামুন। এ সময় জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাসহ আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ নানা শ্রেণী-পেশার লাখো মানুষ জানাযায় শরিক হন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার প্রতি গার্ড অব অনারসহ রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়।
সৈয়দ আশরাফের স্মৃতি বিজড়িত ময়মনসিংহের এই নামাজে জানাযায় লাখো মানুষের ঢল নামে। সৈয়দ আশরাফের সহপাঠী সাদেক জানান, সৈয়দ আশরাফ ছিলেন একজন নির্লোভ আদর্শিক ও সত্যিকারের দেশপ্রেমিক একজন রাজনীতিবিদ। তার আদর্শ ধারণ ও চর্চা করা হলেই তার প্রতি সত্যিকারের সম্মান প্রদর্শন করা হবে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জেম হোসেন বাবুল জানান, আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক ছিলেন সৈয়দ আশরাফ। জেলার নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছে তিনি ছিলেন ভরসার বাতিঘর। সৈয়দ আশরাফের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এডভোকেট আবদুর রাজ্জাক জানান, এই ক্ষতি ও শূন্যতা কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয়। একজন সৎ, ত্যাগী ও আদর্শিক রাজনীতির প্রতীক ছিলেন সৈয়দ আশরাফ।
তৃতীয় নামাজে জানাযা শেষে তার মরদেহ হেলিকপ্টারযোগে পুনরায় ঢাকায় আনা হয়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সৈয়দ আশরাফের মরদেহবাহী এ্যাম্বুলেন্স বনানী কবরস্থানে এসে পৌঁছায়। সেখানেই উপস্থিত ছিলেন বিপুলসংখ্যক শোকার্ত নেতাকর্মীরা। এরপর কবরস্থানে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। এরপর তার কবরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফসহ সর্বস্তরের নেতারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।