উনিশ শ’ আঠারো থেকে দু’হাজার আঠারো

206

মিলু শামস

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার এক শ’ বছর পুরো হলো এ বছর ১১ নভেম্বর। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে পুরো দুনিয়া কয়েকটি দেশের মধ্যে ভাগ হয়। বিশ শতকের শুরুতে ভাগ বা দখল করার জন্য আর কোন ভূখণ্ড বাকি ছিল না। তখন অনিবার্য হয় পুনর্বণ্টন। অর্থাৎ উপনিবেশের দখল এক প্রভুর কাছ থেকে অন্য প্রভুর কাছে যাওয়া জরুরী হয়ে পড়ে। এ থেকে শুরু হওয়া দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত পৃথিবীবাসীকে চার বছরের দীর্ঘ যুদ্ধের মুখোমুখি করে। তবে এ পর্যন্ত আসার আগে আরেকটু পেছন ফিরলে ভাগাভাগির স্বরূপটা পরিষ্কার বোঝা যায়।
আঠারো শ’ ষাট থেকে আঠারো শ’ আশি সাল ছিল ব্রিটেনের উপনিবেশ দখলের স্বর্ণযুগ। আঠারো শ’ ছিয়াত্তর সালে ব্রিটেন, রাশিয়া ও ফ্রান্সের উপনিবেশগুলোর মোট আয়তন ছিল চার কোটি বর্গকিলোমিটার, যেখানে মোট জনসংখ্যা ছিল সাতাশ দশমিক আটত্রিশ কোটি। উনিশ শ’ চৌদ্দ সালে এ পরিসংখ্যান দাঁড়ায় যথাক্রমে ছয় পয়েন্ট পনেরো কোটি বর্গকিলোমিটার এবং আটচল্লিশ দশমিক বাইশ কোটি। আঠারো শ’ তিয়াত্তর সালে জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের কোন উপনিবেশ ছিল না। উনিশ শ’ চৌদ্দ সালে পৌঁছে এ তিন রাষ্ট্রের উপনিবেশের আয়তন দাঁড়ায় পঁয়ত্রিশ লাখ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা চার দশমিক বারো কোটি। বেশিরভাগ উপনিবেশ ছিল ব্রিটেনের দখলে। শিল্প বিপ্লব পেরিয়ে আসা ব্রিটেনের অর্থনৈতিক শক্তিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো পাল্টা শক্তি তখনও ছিল না। ভারত, বর্মা, মালয়, আফ্রিকার বেশিরভাগ অংশ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অর্ধেকের বেশি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডাসহ আরও কিছু অঞ্চলের দখল নিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখন জ্বলজ্বল করছে।
দখলদারিত্বে এর পরের অবস্থান ছিল ফ্রান্সের। তার দখলে ছিল উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, ভিয়েতনাম এবং প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু দ্বীপ। জার্মানি অধিকার করেছিল পশ্চিম ও পূর্ব আফ্রিকা, এশিয়া ও ওশেনিয়ার কিছু অঞ্চল। সাইবেরিয়ার পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল রাশিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দখলে নিয়েছিল কিউবা, পোর্টেরিকো এবং হাওয়াই। ইতালি, জাপান, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের দখলেও ছিল কিছু এলাকা। মূলত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইন্দোনেশিয়ার দখল ছিল নেদারল্যান্ডসের হাতে।
আঠারো শ’ ছিয়াত্তর সালের পর ছ’টি রাষ্ট্রের উপনিবেশ ফুলে-ফেঁপে ওঠে। রাষ্ট্রগুলো হলোÑ ব্রিটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। এদের উপনিবেশের মোট আয়তন হয়েছিল দুই পয়েন্ট পাঁচ কোটি বর্গকিলোমিটার, যা প্রভু দেশগুলোর আয়তনের প্রায় দেড়গুণ। আর এর জনসংখ্যা ছিল প্রভু দেশগুলোর জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ষাট ভাগ। বিশ শতকের শুরুতে আফ্রিকা ও এশিয়ার অল্প কয়েকটা দেশ যেমন লাইবেরিয়া, আবিসিনিয়া, তুরস্ক, আফগানিস্তান ও পারস্য স্বাধীন থাকলেও কোন না কোন সাম্রাজ্যের প্রভাব বলয়ে ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক পটভূমি তৈরি হয়েছিল বলা যায় কয়েকটি সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে। যেমন সুদান ও নীল নদ নিয়ে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সংঘর্ষ, মরক্কো নিয়ে ফ্রান্স ও জার্মানির সংঘর্ষ, আফগানিস্তান নিয়ে রুশ-ব্রিটিশ, মাঞ্চুরিয়া নিয়ে রুশ-জাপান, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়া নিয়ে ব্রিটিশ-জার্মান, বলকান নিয়ে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়াÑহাঙ্গেরীর বিবাদ-সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ।
এক শ’ বছরে পৃথিবীর পরিবর্তন অনেক হয়েছে। কিন্তু আধিপত্য টিকিয়ে রাখার পুরনো খেলা অব্যাহতভাবেই রয়েছে। শুধু এর রূপ পরিবর্তন হয়েছে। উনিশ শ’ চৌদ্দর পর ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে আবার নানা প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব এবং তিরিশের দশকের মহামন্দা ও ফ্যাসিবাদের উত্থান আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক শক্তি বেড়ে যাওয়াকে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও রাজনীতি নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজির গঠনপ্রবাহ ও মুনাফা অর্জনের প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে, যা স্পষ্ট হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। রাজনীতি ও অর্থনীতির একটি ভিন্ন কাঠামো উন্মোচিত হয়। পুরনো উপনিবেশগুলো একে একে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে থাকে। জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে এসব দেশের উন্নয়ন সমস্যা পুঁজিবাদের ভাবনার নতুন বিষয় হয়। ইংল্যান্ড, জাপান, জার্মানির অবস্থান দুর্বল হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শক্তিধরদের মধ্যে প্রধানতম জায়গা দখল করে। নেতৃত্বের জায়গা নিশ্চিত হয় তার। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয় বিশ্বে নতুন একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। বিভিন্ন দেশে বিপ্লবী সরকার নিয়ে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অভ্যুদয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আয়তন বা পরিসর কমিয়ে দেয়, যা ওই ব্যবস্থার জন্য ভয়ানক দুশ্চিন্তার কারণ হয়। পুঁজিবাদ জন্ম থেকেই অন্তর্নিহিতভাবে আন্তর্জাতিক চরিত্রের। সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিশালী অবস্থান তার আন্তর্জাতিকতাকে আরও দৃঢ় করতে সচেষ্ট হয়। অর্থনীতির নতুন বিন্যাসকে সুসংহত রাখতে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠান, যার অন্যতম লক্ষ্য হয় নবীন স্বাধীন দেশগুলোয় আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজির বিনিয়োগ ও বাজার সৃষ্টিতে সহায়তা দেয়া। এ সময় থেকে যুদ্ধ অর্থনীতি বিশ্ব পুঁজিবাদে স্থায়ী হয়। এরপর প্রায় প্রতি দশকে পুঁজিবাদ নিজেকে নতুন নতুনভাবে বিন্যাস করে।
পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত অনুন্নত বিশ্ব থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে শিল্পপণ্যের বাজার তৈরি করা ছিল আন্তর্জাতিক পুঁজির স্বাভাবিক প্রবণতা। এসব দেশে তখনও পর্যন্ত সরাসরি শিল্প বিনিয়োগ ছিল না। শিল্প বিনিয়োগ প্রধানত উন্নত পুঁজির দেশে কেন্দ্রীভূত ছিল। ষাট দশকে পৌঁছে ওই প্রবণতায় পরিবর্তন আসে।
অনুন্নত বিশ্বে শিল্পে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ শুধু শুরুই হয় না, ব্যাপকভাবে বেড়েও যায়। এসব দেশের বিশাল সমস্যা শ্রমকে রফতানিমুখী করা এবং আমদানি বিকল্প শিল্পায়ন আন্তর্জাতিক বাণিজের সম্প্রসারণ করে।
সত্তর দশকের শুরুতে পুঁজির বিন্যাস হয় তেল সঙ্কটকে কেন্দ্র করে। এ সময় পুঁজির পুঞ্জীভবন ও কেন্দ্রীভবন সৃষ্টি হয় আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি।
আশির দশকে পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণের বিষয়টি বিশেষভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। যোগাযোগ ও প্রযুক্তিতে অবিশ্বাস্য অগ্রগতি উৎপাদনকে অভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় নিয়ে আসে।
সমাজতন্ত্রের পতন নিশ্চিত করার পর বিশ্ব পুঁজিবাদ গা ঝাড়া দিয়ে ঝড়ের গতিতে ছুটতে থাকে। গত শতকের নব্বই দশক ছিল পুরনো পৃথিবীর ভারসাম্য থেকে নতুন ভারসাম্যে প্রবেশ করার ক্রান্তিকাল। মাইক্রো ইলেক্ট্রনিক্স, বায়োটেকনোলজি এবং শক্তি সম্পদের নতুন প্রযুক্তির প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় কে লাভবান হবে সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দশক। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে পুঁজিবাদ সহস্রাব্দের দোরগোড়ায় পৌঁছয়। নব্বই দশকের শেষ থেকে পুঁজির ভুবনে মিডিয়া সাম্রাজ্যের দুরন্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। স্যাটেলাইট ও কেবল নেটওয়ার্ক, মুদ্রণশিল্প, বেতার ও চলচ্চিত্র শিল্পের ওপর শতভাগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পুঁজিবাদকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করে। তবে সহস্রাব্দের প্রথম দশকেই যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালস্ট্রিটের শতকরা নিরানব্বই ভাগের বিক্ষোভ এর নতুন সঙ্কটও দেখিয়ে দিয়েছে।
বাইরে থেকে সঙ্কটের স্বরূপ সহজে বোঝা না গেলেও অন্তর্গত ক্ষয় হয়ত এ শতাব্দীতেই পূর্ণভাবে প্রকাশিত হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওযার শততম বছরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই।