কাজিরবাজার ডেস্ক :
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ৭ দফা দাবি পেশ করেছে বিএনপি। এ ছাড়া ক্ষমতায় গেলে কি করবে এমন ১২ দফা পেশ করে দলটি। রবিবার বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানসহ দলের নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহার ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৭ দফা দাবি ও ১২ দফা প্রস্তাব ঘোষণা করেন। তিনি এ ছাড়াও খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তারেক রহমানসহ দলের নেতাদের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ৩ অক্টোবর সারাদেশের সকল জেলায় সমাবেশ ও জেলা প্রশাসকদের কাছে স্মারকলিপি এবং ৪ অক্টোবর সকল বিভাগে সমাবেশ ও বিভাগীয় কমিশনারদের কাছে স্মারকলিপি দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, অবিলম্বে ৭ দফা দাবি না মানলে টানা আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারের পতন ঘটানো হবে। এদিকে বহু হাঁকডাক দিয়ে দীর্ঘ এক বছর পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করলেও এ সমাবেশে দলের নেতাকর্মীদের তেমন উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। এর আগে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১২ নবেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করেছিল বিএনপি। ওই সভায় বিপুল সংখ্যক লোকের উপস্থিতি ঘটেছিল। পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ভরেও আশপাশের রাস্তায় জড়ো হয়েছিল মানুষ। আর রবিবারের সমাবেশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানই ভরেনি। বিশেষ করে বিকেল ৪টার পর উদ্যানের অধিকাংশ অংশই ছিল ফাঁকা।
বিএনপির দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই জাতীয় সংসদ বাতিল, তফসিলের আগেই খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার বিরুদ্ধে দায়ের সব মামলা প্রত্যাহার এবং সকল বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মুক্তি, সাজা বাতিল ও মামলা প্রত্যাহার, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে ফল প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও নতুন কোন মামলা না দেয়া, পুরনো মামলায় কাউকে গ্রেফতার না করা, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং সামাজিক গণমাধ্যমে স্বাধীন মতপ্রকাশের অভিযোগে ছাত্রছাত্রী-সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার এবং গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, সরকারের পদত্যাগ ও সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা, ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা, নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে কোন ধরনের বিধি-নিষেধ ছাড়াই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা।
সমাবেশ মঞ্চ থেকে ঘোষিত ১২ দফা প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছেÑ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি ন্যায় ভিত্তিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করা। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দলীয়করণের ধারার বদলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। রাষ্ট্র ক্ষমতায় গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত করা। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ দেশপ্রেমিক স্বশস্ত্র বাহিনীকে আরও আধুনিক, শক্তিশালী ও কার্যকর করা। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। কঠোর হস্তে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও অধিকতর কার্যকর করা। সকল নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা ও মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়- এই মূলনীতিকে অনুসরণ করে জাতীয় মর্যাদা ও স্বার্থ সংরক্ষণ করে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে পাস্পরিক এবং সৎ প্রতিবেশী সুলভ বন্ধুত্ব ও সমতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, বিনিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। কোন ধরনের সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় না দেয়া এবং কোন জঙ্গী গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করতে না দেয়া। নিম্ন আয়ের নাগরিকদের মানবিক জীবনমান নিশ্চিত করা, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বেতন-মজুরি নির্ধারণ ও আয়ের বৈষম্যের অবসানকল্পে সমতাভিত্তিক নীতি গ্রহণ করা এবং সকলের জন্য কর্মসংস্থান, শিক্ষিত বেকারদের জন্য বেকার-ভাতা, সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্যবীমা চালু, কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা, শিল্প-বাণিজ্য ও কৃষি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিদ্যুত ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ও আধুনিক করা। স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত অবৈতনিক এবং উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য করার লক্ষ্যে জীবনমুখী শিক্ষানীতি চালু করা, প্রযুক্তিÑবিশেষ করে তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে মানব সম্পদের উৎকর্ষ সাধন করা, জাতীয় উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তৈরি পোশাক শিল্পের অব্যাহত উন্নয়ন এবং শিল্প ও রফতানি খাতকে বহুমুখী করা, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে উন্নয়নের ধারাকে গ্রামমুখী করা, বৈদেশিক কর্মসংস্থান সম্প্রসারণ, ঝুঁকিমুক্ত ও প্রবাসী জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করা এবং তরুণ প্রজন্মের প্রতিভার বিকাশ ও তাদের আধুনিক চিন্তা চেতনাকে জাতীয় উন্নয়নে কাজে লাগানোর জন্য শিক্ষা, তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তিখাতকে অগ্রধিকার দেয়া। সকল প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসানে জাতীয় ঐকমত্য গঠন করা।
সমাবেশে মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। দুর্নীতি-লুটপাট করে আজ অর্থনীতিকে শেষ করে দেয়া হয়েছে। আমাদের অসংখ্য সহযোদ্ধাকে গুম ও হত্যা করেছে। প্রতিদিন কয়েক হাজার গায়েবি মামলা দিচ্ছে। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে ৪ হাজার ৯৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৪ হাজার ৩১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং মামলায় আসামি করা হয়েছে ২ লাখ ৭২ হাজার ৭৩০ জনকে।
সরকার ও পুলিশ প্রশাসনকে উদ্দেশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, এই মিথ্যা মামলার জন্য ভবিষ্যতে জবাবদিহি করতে হবে। সব ঘটনার তদন্ত হবে। তখন কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। তিনি বলেন, এই সরকারকে বিএনপির ভয়ে ধরেছে। তারা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আতঙ্কে ভুগছে।
ফখরুল বলেন, শনিবার একজন আইনজীবী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করতে কারাগারে গিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছেন খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছেন। তাই আমাদের রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করেই খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হবে। তবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ সব জায়গায় বিএনপির ষড়যন্ত্রের ভূত দেখে। তাই তারা স্বপ্নেও খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান বলে চিৎকার করে। তিনি বলেন, দেশের ব্যবসায়ীরা এখন কর আর চাঁদা দিতে দিতে অস্থির হয়ে গেছে। আর করের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের নামে টাকা লুট করছে সরকারের লোকেরা।
সমাবেশের প্রধান বক্তা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সরকারের সমালোচনা করে বলেন, এ সরকার রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ (আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ) ধ্বংস করে দিয়েছে। এই সরকার ফ্যাসিস্ট সরকার। দুর্নীতি আর লুটপাট করে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করে দিয়েছে। খালেদা জিয়ার আহবানে বিভিন্ন দল আজ ঐক্যবদ্ধ। তাই খালেদা জিয়া ছাড়া এদেশে কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবে না।
সরকার গায়ের জোরে ক্ষমতায় আছে অভিযোগ করে ড. মোশাররফ বলেন, জনগণের দাবি মেনে নিন। পদত্যাগ করুন। সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে। তিনি পুলিশ-প্রশাসনকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনারা আওয়ামী লীগের চাকরি করেন না। এ দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় আপনারা বেতন পান। এখনও সময় আছে, আপনারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করুন। আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ভয়ের কোন কারণ নেই। খালেদা জিয়া প্রতিহিংসার রাজনীতি করেন না।
ড. মোশাররফ বলেন, বিএনপি কখনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নির্যাতন করে না। সরকার বিএনপির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। বরং আওয়ামী লীগই সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করেছে। কিভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন প্রধান বিচারপতিকে নির্যাতন করে দেশ থেকে তাড়িয়েছে, সেটা দেশবাসী দেখেছে। তিনি বলেন, রাজপথে গণবিপ্লব ঘটিয়ে খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করা হবে।
ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ৭ দিনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হবে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার একমাত্র পথ রাজপথ। রাজপথের আন্দোলনেই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে।
মির্জা আব্বাস বলেন, জাতীয় ঐক্য হলে ভাল, তবে না হলেও ক্ষতি নেই। সেক্ষেত্রে বিএনপিকে একাই সরকার বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি চাইলে শয়তানের সঙ্গেও ঐক্য করতে আমরা রাজি আছি।
সমাবেশ মঞ্চে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জন্য ‘প্রধান অতিথির আসন ফাঁকা রাখা হয়। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, তিনি কারাগারে থাকলেও আমাদের সঙ্গেই আছেন। তাই তাকে সমাবেশের প্রধান অতিথি রেখে তাঁর জন্য একটি চেয়ার খালি রাখা হয়েছে।