সুনামগঞ্জ বিশাল জনসভায় এরশাদ ॥ মানুষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল আর চায় না

57

আল-হেলাল, সুনামগঞ্জ থেকে :
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রবিবার সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক বিশাল জনসভায় সদর আসনে বর্তমান এমপি পীর ফজলুর রহমান মিসবাহকে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণা করে বলেছেন, বিগত পাঁচ বছর সংসদ থেকে রাজপথে সে আপনাদের পাশে ছিল। সুখে-দুঃখে পাশেই থাকেনি, দাবি আদায়ে এবং অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল। সততার সঙ্গে আপনাদের ভালোবাসা অর্জন করেছে। আপনাদের পীর মিসবাহকে আপনাদের হাতে তুলে দিলাম। এই জেলায় মহাজোটে সদর আসন আমি ছাড় দেব না। তাকে বিজয়ী করার দায়িত্ব আপনাদের। সে বিজয়ী হলে আপনাদের পাশে থাকবে। তিনি বলেন, মানুষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল আর চায় না। মানুষ পরিবর্তন চায়, জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসলে দেশে শান্তি আসবে। মানুষ শান্তিতে থাকবে।
জেলা জাতীয় পার্টির সম্মেলন হলেও কার্যত এটি ছিল সুনামগঞ্জ-৪ (সদর-বিশ্বম্ভরপুর) আসনে জাতীয় পার্টির প্রাক-নির্বাচনী শোডাউন। সকাল থেকে প্রচন্ড তাপদাহ উপেক্ষা করে ঢোলবাদ্য বাজিয়ে হাজার হাজার নারী-পুরুষ মিছিলে মিছিলে চারদিক মুখরিত করে এই সমাবেশে যোগ দেন। তুমুল করতালি আর শ্লোগানের মধ্যে এরশাদ পীর মিসবাহকে প্রার্থী ঘোষণা করে বলেন, এটিই আমার প্রথম দলীয় মনোনয়ন ঘোষণা। এর আগে আমার এলাকাসহ কোথাও কোন প্রার্থীর নাম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করিনি।
এরশাদের আগমন উপলক্ষে গোটা সুনামগঞ্জ শহর তোরণ, ব্যানার, ফেস্টুনে বর্ণাঢ্য সাজে সেজেছিল। জনসভাস্থল ছাপিয়ে লাখো জনতার ঢেউ ট্রাফিক পয়েন্ট থেকে পৌরসভা, আবুল হোসেন মিলনায়তন, রিভারভিউ, উকিলপাড়া ছাপিয়ে ষোলঘর কাজির পয়েন্টে আছড়ে পড়ে।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য, সুনামগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টির আহবায়ক পীর ফজলুর রহমান মিসবাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলন, জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, শ্বেতকপোত উড়িয়ে উদ্বোধন করে দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এরশাদ বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে দেশে গুম, খুন, সন্ত্রাস এবং মাদক আগ্রাসন বেড়েই চলেছে। দেশের মানুষ এ অবস্থার পরিবর্তন চায়। এ পরিবর্তন এনে দিতে পারবে একমাত্র জাতীয় পার্টি। রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে আগামী নির্বাচনে লাঙ্গলে ভোট দিন।
এরশাদ বলেন, আমার আসনে আমি এখনো নিজের প্রার্থীতা ঘোষণা করিনি, কিন্তু পীর ফজলুর রহমান মিসবাহকে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের প্রার্থী ঘোষণা করে গেলাম, তাকে লাঙ্গল প্রতীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করার দায়িত্ব আপনাদের। এরশাদ বলেন, সুনামগঞ্জ জেলা আমি করেছিলাম। এই জেলার উন্নয়ন আমি করেছি। সেই দাবি থেকে বলছি, আগামি নির্বাচন পীর মিসবাহকে নির্বাচিত করুণ। লাঙলকে বিজয়ী করুন।
সমাবেশে জনজোয়ার দেখে উচ্ছসিত এরশাদ বলেন, প্রচন্ড রোধে সরকারি জুবিলী স্কুল মাঠে সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে আমি সত্যিই অভিভুত। এতো মানুষ আমাকে ভালবাসে এটা ভাবলে মনে হয় আমার বয়স কমে গেছে।
এরশাদ আরও বলেন, আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা বলছেন, তারা ক্ষমতায় না গেলে দেশে এক লাখ মানুষা মারা যাবে। জাতীয় পার্টিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে আসুন, দেশে একজন মানুষও মারা যাবে না। কারণ জাতীয় পার্টি প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না।
সমাবেশে বক্তব্য রখেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, যুগ্ম মহাসচিব ইয়াহহিয়া চৌধুরী এমপি, জেলা জাপা নেতা সাবেক এমপি অ্যাড. আব্দুল মজিদ, মোহাম্মদ আলী খুশনূর,আব্দুর রশিদ, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান মাস্টার,এডভোকেট আব্দুল গাফফার তালুকদার, সাইফুর রহমান সমছু, সাবেক প্যানেল মেয়র মনির উদ্দিন, হাজী হেলাল, ফারুক মেনর, জসিম উদ্দিন, সাজ্জাদুর রহমান সাজু প্রমুখ। সম্মেলনে পরিচালনা করেন জেলা জাতীয় পার্টি নেতা গোলাম হোসেন অভি।
এরশাদ বলেন, দেশের মানুষ শান্তিতে নেই, নিরাপদে নেই। প্রতিদিন মানুষ খুন হচ্ছে, গুম হচ্ছে। সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আগামি নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ভোট দিন। দেশে শান্তি ফিরে আসবে। মানুষ মুক্তি পাবে। তিনি আরো বলেন তোফায়েল আহমেদ বলেছেন আ.লীগ ক্ষমতায় না থাকলে তাদের এক লক্ষ নেতাকর্মী মারা যাবে কিন্তু ‘আমরা ক্ষমতায় গেলে একজন মানুষও মারা যাবে না’।
তার নিজের কোনো কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই উল্লেখ করে বলেন, আমি মানুষের মুক্তি চাই। পরিবর্তন চাই। আমরা ক্ষমতায় আসলে প্রাদেশিক সরকার হবে। বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন হবে। পুলিশ নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে। বর্তমান উপজেলা নয় আগের উপজেলা ব্যবস্থা কার্যকর হবে।
এরশাদ আরও বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সিলেট বিভাগ থেকে ৮ টি আসনে জয় লাভ করেছিল। এবার আরো বেশি আসনে জয় লাভ করতে হবে। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় গেলে বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে, দলীয় করন হবে না , দেশে গুম খুন থাকবে না। দেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে। বরাবরের মতো ক্ষমতায় গেলে দেশে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথাও বলেন তিনি।
এ সময় এরশাদ উল্লেখ করে বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে আমাদের বিরুদ্ধে করা ৫ হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ৬ হাজার মামলা প্রত্যাহার করেছে। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় গেলে কারো বিরুদ্ধে অন্যায় অবিচার হবে না।
প্রধান বক্তার বক্তব্যে জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, আমরা এখন একটা কঠিন সময় পার করছি। দেশে অন্যায় অবিচার চলবে কিন্তু প্রতিবাদ করা যাবে না, প্রতিবাদ করলেই মামলার ভয় দেখানো হয়। কিন্তু জাতীয় পার্টি যখন ক্ষমতায় ছিল, কারো বিরুদ্ধে মামলা করিনি। কাউকে হামলা করিনি। নানান সমালোচনা হয়েছে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে, আন্দোলন করা হয়েছে কিন্তু কাউকে মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের সময়ে হয়রানি করা হয়নি। আমরা নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিতে প্রস্তুত আছি। গত ২৭ বছরে দেশে তেমন উন্নয়ন হয়নি আমরা দেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক হুসেইন মো.এরশাদের নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন করব। রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন,আমি এরশাদ সাহেবের সাথে ২৭ বছর আগে সুনামগঞ্জে এসেছিলাম। আমার নেতা সেদিন বলেছিলেন,আমি সুনামগঞ্জ কে জেলা করেছিলাম। তিনি সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউস, ব্রীজ কালভার্টসহ এই জেলার অনেক উন্নয়ন করেছেন। সেদিন আমরা সুনামগঞ্জে এসে চারিদিকে পানি আর পানি ছাড়া কোন কিছু দেখতে পাইনি। এখন এসে দেখছি ২৭ বছর আগের জেলার কোন পরিবর্তন হয়নি। সরকার আসে আর যায় কল্পকাহিনী বলে উন্নয়নের কথা বলে কিন্তু কোথায় সোনা আর কোথায় বাংলা সুনামগঞ্জের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন কেন হয়না। আজ থেকে ৫ বছর আগে নির্বাচিত হয়ে আপনাদের এমপি মিছবাহ জনগণের সাথে দু:খী মানুষের সাথে মিশে গেছে। সে যখন সংসদে কথা বলে আমরা অভিভুত হয়ে যাই। সংসদে সে মজলুম মানুষের কথা উন্নয়নের কথা বলে। এলাকার সুখ দু:খের কথা সংসদে তার কন্ঠেই উচ্চারিত হয়। আপনারা আগামীতে তাকেই নির্বাচিত করবেন। তার গাড়িতে পতাকা উড়বে। তিনি বলেন, এখানে এসে শুনলাম লাঙ্গলের বিরুদ্ধে কে নাকি বিষোদগার করে। লাঙ্গল আমাদের সকলের, লাঙ্গল দেশের সকল জনগণের, লাঙ্গলের ফলায় সোনার ফসল উঠে এই লাঙ্গলকে আঘাত করার অধিকার একটি শিশু সন্তানের নেই। মিসবাহ নির্বাচিত হলে সুনামগঞ্জ হবে একটি আধুনিক জেলা একটি মডেল জেলা। লন্ডনে যারা অবস্থান করছে তারা সুনামগঞ্জে ফিরে আসবে। মিসবাহর মতো যোগ্য সন্তানরা যুগে যুগে আসেনা। ইচ্ছা করলেই তার কন্ঠ স্তব্ধ করা যায়না। আপনারা লাঙ্গলে ভোট দেন। আবার সকলের জীবনে পরিবর্তন আসবে। মিছবাহকে আপনাদের কাছে রেখে গেলাম।
জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষ সুখে থাকে, শাস্তিতে থাকে। তাই আগামীতে লাঙলে ভোট দিন।
সভাপতির বক্তব্যে পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর কথা দিয়েছিলেন সততার সাথে এই অঞ্চলের মানুষের উন্নয়ন করে যাব। আমি আপনাদের কাছে দেওয়া সেই ওয়াদা রক্ষা করেছি। প্রতিটি এলাকায় গিয়ে মানুষের সুখ-দুখের কথা শুনেছি। সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করেছি। আমি সাহেব বা নেতা হইনি, একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে আপনাদের সেবা করেছি। আবার বিজয়ী হলে আমি আমার এই সেবা অব্যাহত রাখব। তিনি বলেন, গত ৫ বছরে আমি কারো মনে আঘাত দেইনি। কারো সঙ্গে দম্ভ দেখাইনি। চেষ্টা করেছি সবার বিপদে-আপদে পাশে থাকতে। আমার বাড়ির দরজা সবার জন্য দিনরাত খোলা রেখেছি। সংসদ অধিবেশন ছাড়া ঢাকায় থাকিনি। এলাকায় পড়ে থেকেছি। তারপরও রাজনীতির ‘নাবালক ছেলে’ বলে এই আসন থেকে লাঙ্গল হঠাবে। লাঙ্গল মানুষের হৃদয়ে, মাটির গভীরে জায়গা করে নিয়েছে। আর মানুষের ভালবাসাই আমার শক্তি। এই শক্তিতে ইনশাআল্লাহ আবার বিজয়ী হয়ে আপনাদের সেবা করব। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ভালবাসায় কাছে টেনেছি। তাই মানুষও আমাকে ভালবাসা দানে কার্পণ্য করেননি।