আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস, নিরক্ষরমুক্ত সোনার বাংলা চাই

91

অধ্যাপক জ্যোতিষ মজুমদার

আজ ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। ১৯৬৫ সালের ৮ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা বিষয়ক সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কোর উদ্যোগে ইরানের রাজধানী তেহরানে বিশ্ব সাক্ষরতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ১৯৬৫ সাল থেকে ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বর সাক্ষরতা দিবস পালন করে আসছে। ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সমাজের মধ্যে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও তাৎপর্য তুলে ধরার জন্য এ দিবসটি নির্ধারণ করা হয়।
দেশে দেশে সাক্ষরতর সংজ্ঞা অনেক আগ থেকেই প্রচলিত থাকলেও ১৯৬৭ সারে ইউনেস্কো প্রথম সাক্ষরতার সংজ্ঞা চিহ্নিত করে এবং পরবর্তীসময়ে প্রতি দশকেই এই সংজ্ঞার রূপ পাল্টেছে। এক সময় কেউ নাম লিখতে পারলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো। কিন্তু বর্তমানে সাক্ষর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য অন্তত তিনটি শর্ত মানতে হবে। ১) ব্যক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারা, ২) সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারা এবং ৩) দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাব-নিকাশ করতে পারা। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো এই সংজ্ঞাটি নির্ধারণ করে তবে বর্তমানে অনেক আন্তর্জাতিক ফোরাম বা কনফারেন্স থেকে সাক্ষরতা সংজ্ঞা নতুনবাবে নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। সাক্ষরতাকে এখন সরাসরি ব্যক্তির জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়।
সাক্ষরতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবীয় অধিকার হিসেবে বিশ্বে গৃহীত। সাক্ষরতার মাধ্যমে শুধু অর্থনৈতিক মুক্তি নয়, বরং সামাজিক সাংস্কৃতিক ও মানসিক মুক্তি আনয়নের মাধ্যমে প্রত্যাহিক জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এর লক্ষ্য। এটি ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক ও মানবীয় উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণযোগ্য। দারিদ্র্য হ্রাস, শিশু মৃত্যু রোধ, সুষম উন্নয়ন এবং শান্তি ও সমৃদ্ধি বিকশিত করণের ক্ষেত্রে সাক্ষরতা প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মা-বাবা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে প্রেরণে উৎসাহিত হন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রথম সাক্ষরতা দিবস উদযাপিত হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংস স্তুপে পরিণত হওয়া দেশটিকে টেনে তুলতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতির বাইরেও শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে খুবই মনোযোগী ছিলেন। তিনি (বঙ্গবন্ধু) জানতেন নিরক্ষরতা একটি অভিশাপ এবং জাতির উন্নতির চাকার প্রধান প্রতিবন্ধক। তাই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের চাহিদা পূরণে সক্ষম একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-এ-খুদা’র নেতৃত্বে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে একযোগে জাতীয়করণ করেন। এই পদক্ষেপের কারণেই দারিদ্র্যের পর্ণকুটির থেকে জীর্ণ বস্ত্র পরিধান করা শিশুরা প্রাইমারি স্কুলে ছুুটে এসেছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক ও সার্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়ে গেলে উক্ত কমিশন আর আলোর মুখ দেখেনি।
২০০৮ সারে জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় গেলে ২০১ সালের মধ্যে দেশে সাক্ষরতার হার শতভাগ উন্নীত করর যে অঙ্গীকার করেছিল তা এখন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও পিতার পদাংক অনুসরণ করে ২০১৩ সালে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের ঘোষণা দেন যা প্রাথমিক শিক্ষার ইতিহাসে মাইলফলক। বাংলাদেশকে তথ্য নির্ভর পৃথিবীর সামনে মাথা উঁচু করে দাড়াতে হলে আগামী প্রজন্মকে সাক্ষর ও ডিজিটাল প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন হতে হবে। আর এ বিষয়টিকে সামনে রেখেই বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, দারিদ্র্যের কারণে ঝড়ে পড়া রোধে উপবৃত্তি প্রদান এবং শিক্ষার্থীদের স্কুলে ধরে রাখতে স্কুল ফিডিং কর্মসূচীসহ বহুভিত্তিক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
সরকার কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান কিন্তু প্রতি বছরই জরিপ কাজ চালিয়ে সাক্ষরতার হার নির্ধারণ করেনা। সাক্ষরতার হার নিয়ে ২০১০ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো (বিবিএস) জরিপে দেখা যায় দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৫৯ দশমিক ৮২ শতাংশ, ২০১১ সালে ৫৮ দশমিক ০৮ শতাংশ, ২০১২ সালে ৬০ দশমিক ০৭ শতাংশ, এ্যাসেসম্যান্ট সার্ভে নামের একটি সংস্থার ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে সাক্ষরতার হার ৫১ দশমিক ০৩ শতাংশ, (এখানে বয়স ১৫ থেকে ৪৫ বছর)। ইউএনডিপির (জাতি সংঘের উন্নয় কর্মসূচী) সর্বশেষ ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স নিরক্ষর জনগোষ্ঠী হচ্ছে ৫৭ দশমিক।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফছারুল আমীন বলেছিলেন, দেশে সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশে পৌঁছেছে। ঠিক এর পরের বছর (২০১৪ সাল) একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে ৬৫ শতাংশ মানুষ স্বাক্ষর, আবার ২০১৪ সালে জুলাই মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটির পরিকল্পনামন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, দেশে সাক্ষরতার হার ৬৭ শতাংশ। গত বছর (২০০৭ সাল) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে ২০১৬ সালের তথ্যানুযায়ী দেশে সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ০৩ শতাংশ। যদি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যাটি সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে এটা খুব আনন্দের বিষয় এবং এতে সরকারের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু অন্যদিক থেকে দেখলে একটু অবাকই হতে হয় যে, এই আধুনিক যুগেও প্রায় ২৮% মানুষ নিরক্ষর। স্বপ্নে ভরা একটি উন্নয়নশীল দেশের বুকে ২৮% নর-নারী নিরক্ষর এটা ভাবাই যায় না। নিরক্ষর লোক এক ধরনের প্রতিবন্ধী। নিজের নামটা লিখতে না পারার মতো এতো লজ্জা এবং গ্লানি আর কী হতে পারে?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কলেজ ও হাই স্কুল জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা মনে করি গোটা শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের ঘোষণা প্রদান করে শিক্ষাক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূর করে আমাদের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতা প্রদানসহ তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করে সরকারের রুপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এটাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।