কাজিরবাজার ডেস্ক :
আন্দোলনের ভয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস বিরতি বা বন্ধ না রাখার নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। আবার উস্কানিতে যাতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যুক্ত না হয় সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে (ভিসি) দায়িত্ব নিতে হবে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম।
অন্যদিকে ভিসিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আটক ২২ শিক্ষার্থীর মুক্তি দাবি করছেন। বলেছেন, তাদেরকে মুক্ত না করলে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক করা কঠিন হবে। তবে শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি তার এখতিয়ারের বাইরে বলে জানিয়েছেন।
বুধবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যদের সঙ্গে জরুরি মতবিনিময় সভা করেন শিক্ষামন্ত্রী। এ সময় দুই পক্ষে এই কথা হয়।
মত বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নানের সভাপত্বিতে রাজধানীসহ দেশের ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজ চেয়ারম্যান, সদস্য, শিক্ষকসহ অনেকে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন। তারা নিজ নিজ সমস্যা তুলে ধরেন।
গত ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বাস চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহতের পরদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে আন্দোলন হয় তাতে অংশ নেয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাই। তবে টানা ছয় দিনের আন্দোলন শেষে ৫ আগস্ট তারা উঠে গেলে এর পর দিন রাস্তায় নামে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে রামপুরা এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকার সমর্থকদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। আর পরদিন ওই এলাকায় প্রথমে ইস্টওয়েস্ট এবং পরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নর্থ সাউথ ইউনির্ভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও বহিরাগতদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
সেদিন তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ। তবে আটক হয় ২২ জন শিক্ষার্থী, যাদেরকে ৭ আগস্ট দুই দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়।
শিক্ষা বলেন, ‘স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন যৌক্তিক ছিলো। আমরা তাদের এ দাবিকে সমর্থন করি। যৌক্তিকভাবে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, দাবি জানিয়েছেন, আন্দোলন করে গেছেন।’
‘এতে করে আমরা অনেক অজানা কিছু জানতে পেরেছি। অনেকে ট্রাফিক আইন মেনে চলেন না, রাস্তায় ফিটনেস বিহীন গাড়ি চলানো হচ্ছে, ভিআইপিরা আইন অমান্য করছেন, অনেকে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাচ্ছেন। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের যে সকল সমস্যা তা তারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন।’
‘প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি মেনে নিয়েছেন। বর্তমানে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। নতুন সড়ক আইন তৈরি করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। দ্রুতই এটি বাস্তবায়ন করা হবে। তাই আর ছাত্রদের রাস্তায় থাকার কোন অবকাশ নেই।’
উপাচার্যদেরকে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাতে রাজধানীর সকল প্রধানদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করেছি। এরপর আর তারা রাস্তায় না নামলেও এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামছেন। তৃতীয় পক্ষ এতে সুবিধা নিচ্ছে। তাই আন্দোলনের ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখবেন না। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। শিক্ষার্থীদের মটিভেট করে তাদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে হবে।’
শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবির নিয়ে যা বললেন মন্ত্রী : এ সময় গ্রেফতারের শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবি জানান একাধিক উপাচার্য। জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘ক্ষমা করার দায়িত্ব আমাদের নয়, যারা বিনা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাদের জন্য আমরা পাশে রয়েছি। আর যারা সত্যিকারে অপরাধী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিচার করবে।’
‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করতে নতুন করে একটি সেন্টার কাজ তৈরি করা হবে। যাতে কোন জরুরি অবস্থায় সকলে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। এটি ইউজিসি নিয়েন্ত্রণ করবে।’
বেসরকরি বিশ্ববিদ্যালয়কে আরো সর্তক হতে হবে উল্লেখ করে নাহিদ বলেন, ‘সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে প্রধান ভুমিকা পালন করতে হবে। ক্লাস, পরীক্ষা, সাংস্কৃতিসহ নানা কাজে ব্যস্ত রাখতে পারলে কোন শিক্ষার্থী আন্দোলনে যুক্ত হবে না। শুধু বই পড়ে, সিলেবাস দিলে মাথা ভর্তি করলেই হবে না। জঙ্গিবাদ, অপরাধ থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে হবে। অভিভাকদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
৬ আগস্টেও সংঘর্ষের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘এই কর্মকা- কোন ভাবেই আমাদের কাছে কাম্য নয়, তাদের কেউ উস্কানি দিয়েছেন বা কেউ তাদের রাস্তায় নামিয়েছেন।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা সচিব মোহাম্মদ হোসরাব হোসাইন বলেন, ‘সঠিক তথ্যের মাধ্যমে প্রতিবাদ করা দরকার, মিথ্যা গুজবে বিচার বিশ্লেষণ না করে প্রতিবাদ কারা উচিত নয়।’
‘কোনো শিকষার্থী যাতে ক্ষতিগ্রসত না হয় সেটিকে গুরুত্ব দিতে আমি পুলিশ প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এ বিষয়ে আমরারও সজাগ রয়েছি।’
উপাচার্যরা যা বললেন : নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত ৬ আগষ্ট ক্যাম্পাসের সামনে পুলিশ ও বহিরাগতদের সংঘর্ষে অপ্রতাশিতভাবে আমাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে বেশ কিছু বহিরাগত ও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢুকে পড়ে। এরপর আমরা তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে নিরাপদভাবে বের করে দেই। পরে এ সংর্ঘষে আমাদের কয়েকজন শিক্ষার্থী যোগ দেয়।’
‘এ পরিস্থিতিকে আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেই, কিন্তু রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক না থাকায় আমাদের অনেক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমে যায়। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের এক ধরনের গুজবেও পরদিন শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম হয়। পরে আমরা একটি এ বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করার পর শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেড়ে গেছে।’
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য আব্দুল মান্নান বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যে কারণেই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে, তাদের সকলকে সাধারণ ক্ষমা করা দরকার। পাশাপাশি তাদের মধ্যে যারা পুলিশের হাতে আটক রয়েছে তাদের মুক্তি দেয়া দরকার।’
প্রাইম এশিয়ার উপাচার্য আব্দুল হান্নান চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ না করে ক্লাস চালু রাখতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যা গিয়ে ক্লাসে ব্যস্ত থাকে। যদি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয় তবে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠতে পারে।’
হামদার্দ ইউনির্ভার্সিটির উপাচার্য আবদুল মান্নানও পুলিশের হাতে আটক হওয়া শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবি জানান। তবে যারা প্রকৃতপক্ষে অপরাধী তাদের বিচার কারা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
উত্তরা ইউনিভার্সিটির উপ-উপচার্য ইয়াসমিন আরা প্রভা বলেন, ‘বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা না বুঝেই আন্দোলনে যুক্ত হয়। শিক্ষকরা যদি শিক্ষার্থীদের সামনে গিয়ে দাড়াঁয় এবং তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন তবে শিক্ষার্থীরা আর আন্দোলনে যুক্ত হয় না।’
বেসরকরি বিশ্ববিদ্যালয় এসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির বলেন, ‘বেসরকরি বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে তা অনেক জটিল বিষয় ছিল। এর মাধ্যমে আমরা শিখেছি। বিভিন্নভাবে আমরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়েছি। সম্মলিতভাবে কাজ করলে সুবিধা পাওয়া যায়।’
এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বেনজির আহমেদ বলেন, ‘আমাদের সকলকে মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তবেই আমরা যেকোনো সমস্যাকে সহজেই মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সর্তক থাকা প্রয়োজন।’