কাজিরবাজার ডেস্ক :
‘আমার বুকের ভেতর এখন কেবলই হাহাকার/ এবং হৃৎপিন্ড যেন এক/ প্রবল পালকপোড়া পাখি/ থেকে থেকে শুধুই নির্মম চিৎকারে ওঠে ডেকে/ মুনীর মুনীর, জহির রায়হান/ আত্মার সঙ্গীরা আমার/ তোরা সব কোথায় পালালি…।’ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করতে গিয়ে এভাবেই হাহাকার করে উঠেছিল কবি হাসান হাফিজুর রহমানের বেদনাবিধুর উচ্চারণ।
আজ চৌদ্দই ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী নিধনের মর্মন্তুদ স্মৃতিমাখা একদিন। বাঙালীর মেধা-মনন-মনীষা শক্তি হারানোর দিন কাল। ইতিহাসের পাতায় কালো আখরে উৎকীর্ণ বেদনাবিধুর কালবেলা। পথে পথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব বাঙালির কণ্ঠে আজ উচ্চারিত হবে- ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে, ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই…’। সাড়ে চার দশক পর এবার দিবসটি এসেছে ভিন্ন আবহে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারহীনতার দায় থেকে বেরিয়ে এসেছে দেশ। সকল রক্তচক্ষু ও দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের পরও সাহসিকতার সঙ্গে জাতিকে দেয়া ওয়াদা রক্ষা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে শীর্ষ প্রায় সব ঘাতকের বিচারের রায় ঘোষিত হয়েছে। দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রায়ও কার্যকর করা হয়েছে।
শত চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে একাত্তরের শীর্ষ ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী ও মীর কাশেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। আমৃত্যু জেলের ঘানি টানতে টানতে কারাগারেই মারা গেছে রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযম ও আবদুল আলীম। একাত্তরের ঘাতক আরও ১৮ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী এখন কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গুণছে। বুদ্ধিজীবী পরিবারগুলোর বিচারপ্রাপ্তির স্বস্তি আর সব রায় কার্যকর করে দেশকে আরেকটি কলঙ্ক থেকে পরিপূর্ণ মুক্ত করার দাবি নিয়ে বছর ঘুরে আবার এসেছে বুদ্ধিজীবী দিবস।
একাত্তরের অবরুদ্ধ নয় মাস রক্তগঙ্গা পেরিয়ে গোটা জাতি যখন উদয়ের পথে দাঁড়িয়ে, পূর্ব দিগন্তে টগবগিয়ে বিজয়ের লাল সূর্য যখন উদয়ের অপেক্ষায়, দেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই বাঙালীর কৃতী সন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যা করে পরাজয়ের গ্লানিমাখা পাক হানাদার আর তাদের এদেশী দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা। বধ্যভূমিতে বড় অসহায় নিঃশেষে প্রাণ দেন আমাদের সেরা শিক্ষক-সাংবাদিক-চিকিৎসক- প্রকৌশলী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা।
রণক্ষেত্রে বীর বাঙালির হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে জাতিকে মেধাশূন্য করতে সুদূরপ্রসারী ঘৃণ্য নীলনক্সা আঁকা হয়েছিল। ঘাতকরা চেয়েছিল জাতির মেরুদ- ভেঙ্গে দিতে। স্বাপদীয় জন্তুর মতো আঁধারে নেমেছিল দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে। এ রাতেই তালিকা ধরে ধরে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে। হত্যা করে ফেলে রাখা হয় নিস্তব্ধ ভূতুড়ে অন্ধকারে। জাতি হারায় তার অসংখ্য মেধাবী সন্তান। পরদিন ঘুম থেকে জেগে প্রায় ছুঁই ছুঁই স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেল মানুষ জানতে পারেন এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা। মুহূর্তে স্থবির হয়ে যায় সব আনন্দ-কোলাহল। অন্যদিকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে উল্লাসে ফেটে পড়ে এ দেশীয় নরঘাতকরা।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও বাঙাাল জাতি একই দাবি নিয়ে আজ গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে দেশের শহীদ কৃতী সন্তানদের। শোকাহত মানুষের ঢল নামবে সেদিনের সেই হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিবিজড়িত রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিস্তম্ভে। অর্পণ করা হবে পুষ্পার্ঘ্য। শোকে আপ্লুত বাঙালি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে প্রয়াত বুদ্ধিজীবীদের। বেদিমূল ঘিরে থাকবে তাদের পরিবারের সদস্য, ভক্ত-শুভানুধ্যায়ীদের চাপা কান্না আর অশ্রুতে ভিজবে স্বজনের আনা ভালবাসার অর্ঘ্য। দেশের সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। উড়বে শোকের প্রতীক কালো পতাকাও।
যথাযোগ্য মর্যাদা শোকের আবহে আজ শুক্রবার পালিত হবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এ উপলক্ষে রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে নেয়া হয়েছে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দেশব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়েছে নানা কর্মসূচী। এর মধ্যে রয়েছে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে পুষ্পাঘ্য অর্পণ, আলোচনা সভা, গান, আবৃত্তি, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বিবৃতির মাধ্যমে শহীদ বৃদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
আওয়ামী লীগ : আজ ১৪ ডিসেম্বর (শুক্রবার) শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি পালন করবে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ। সকাল সাড়ে দশটায় সিলেট শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করবেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
দিনের কর্মসূচিতে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসহযোগী সংগঠনের সকলস্তরের নেতাকর্মীকে যথাসময়ে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ও সিলেট মহানগরের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এডভোকেট লুৎফুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ।