সিলেটেও শিক্ষার্থীরা দেখছে লাইসেন্স, শ্রমিকরা বাধা দিচ্ছে যান চলাচলে, সংঘাতের আশংকা

83

স্টাফ রিপোর্টার :
সারাদেশের ন্যায় দ্বিতীয় দিনের মতো সিলেট নগরীতে চলে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট। এ কারণে দূরপাল্লার যানবাহন যেমন সিলেট ছেড়ে যায়নি তেমনিভাবে নগরীর বিভিন্ন মোড়ে পিকেটিং করে গণপরিবহন চলাচলে বাধা দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। এই পরিস্থিতিতে চরম দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। এছাড়া গতকাল শনিবার দুপুরে নগরীর রিকাবীবাজার, চৌহাট্টা পয়েন্টসহ বেশ কিছু পয়েন্টে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে চালকদের লাইসেন্স পরিক্ষা করতে দেখা যায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শনিবার সকাল থেকে আম্বরখানা, শাহী ঈদগাহ, সিলেট-তামাবিল সড়কের শিবগঞ্জ, টিলাগড়, ইসলামপুর, শাহপরাণ, পরগনাবাজার, পীরেরবাজারসহ একাধিক স্থানে সড়কে বাঁশ ফেলে পিকেটিং করছে পরিবহন শ্রমিকরা। একই ভাবে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের লামাকাজি, জাঙ্গাইল, টুকেরবাজার, কুমারগাঁও বাস স্ট্যান্ড, মদিনা মার্কেট, সুবিদবাজার ও দক্ষিণ সুরমার হুমায়ন রশিদ চত্বরসহ বিভিন্ন পয়েন্টেও এলাকায় চালকরা পরিবহন শ্রমিকরা পিকেটিং করেছে। এমনকি সিএনজি অটোরিক্সা যাত্রীদের নিয়ে শহর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে তাদের আটকে দেয় লাঠি হাতে শ্রমিকরা। যাত্রীদের গাড়ি থেকে নামিয়ে লোকদের পিকেটিংয়ে বাধ্য করা হয়। তাদের কবল থেকে মুক্ত ছিলো না জরুরি প্রয়োজনে ছুটে চলা যানবাহন। এ্যাম্বুলেন্স-বিদেশগামী যাত্রী কাউকে ছাড়েনি শ্রমিকরা। দলে দলে লাঠি হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শ্রমিকরা যান চলাচল প্রতিহত করে। এতে দূর দূরান্তের অপেক্ষমাণ যাত্রীরা সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েন। উদ্ভুত এমন পরিস্থিতিতে সিলেটে শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষের আশঙ্কা করা করা হচ্ছে।
সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে রাতের বেলা দু’একটি বাস দূরবর্তী জেলার উদ্দেশে ছেড়ে গেলেও সকাল থেকে কোনো গাড়ি যেতে দেখা যায়নি। একই অবস্থা বিরাজ করে কুমারগাঁও বাস স্টেশনেও। ফলে সড়কে বিভিন্ন বাস স্ট্যান্ডে সকাল থেকে যাত্রীদের চাপ দেখা গেলেও গাড়ি না পেয়ে তারা বসে রয়েছে। অনেককেই ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। অনেকে যানবাহন না পেয়ে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। যানবাহন সংকটের কারণে সুযোগে রিকশাওয়ালারাও স্বাভাবিক ভাড়ার থেকে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া নিচ্ছেন যাত্রীদের কাজ থেকে। এদিকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আগত রোগীর স্বজনরা পড়েছে চরম বিপাকে। নারী-পুরুষ অনেককেই পায়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়।
এদিকে, সারাদেশের মতো শনিবার সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ও নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজার পয়েন্টে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। তারা সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে রিকশাকে লাইন মেনে চলতে আহ্বান জানায়। চালকরা তাদের আহ্বানে সাঁড়া দিয়ে কাউকে ওভারটেক না করে লাইন বেঁধে চলাচল করে।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশাররফ হোসেন বলেন, নগরীর চৌহাট্টায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে উঠিয়ে দেওয়া হয়। এসময় তাদের মধ্যে ছাত্রত্ব নেই এমন ৩ জনকে আটক করা হয়। পরে আত্মীয় স্বজনের জিম্মায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে সিলেট পরিবহন মালিক-শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সেলিম আহমদ ফলিক বলেন, শ্রমিক ও গাড়ির নিরাপত্তার কারণে পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে কোথাও হালকা যান চলাচলে বাধা না দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। কেউ হালকা যানবাহন চলাচলে বাধা দিলে তাদের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক নুমেরী জামান জানান, শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরাতে শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতিদের সচেতনতামূলক নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গাড়ি চলাচল বিষয়ে আলোচনা চলছে। নিশ্চয়ই এর একটি সমাধান আসবে।
সেলিম হাসান কাওছার গোলাপগঞ্জ থেকে জানিয়েছেন : ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল গোলাপগঞ্জ। নিরাপদ সড়ক চাই’চাইনা অনিশ্চিত যাত্রা পারদর্শী চালক চাই চাই জীবনের নিরাপত্তা এমন অনেক শ্লোগান নিয়ে ৯ দফা দাবী আদায়ের লক্ষ্যে এবার রাজপথে নেমেছে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। গতকাল শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এমন বেশ কিছু শ্লোগান নিয়ে সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক দখল করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। গোলাপগঞ্জ এমসি একাডেমী স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যনীয়। এ সময় তারা মহাসড়ক দখলের পাশাপাশি গণপরিবহন আটকিয়ে ড্রাইভিং লাসেন্স, কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে। দুপুর সাড়ে ১২টায় পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুরোধে আন্দোলন সমাপ্তি করা হয়। অপরদিকে গোলাপগঞ্জ উপজেলা নিরাপদ সড়ক চাই নিসচার সংগঠন এমসির শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে গোলাপগঞ্জ এমসি একাডেমী স্কুল এন্ড কলেজের সামনে কর্মসূচী পালন করে। নিরাপদক সড়ক নিসচার কর্মসূচী সকাল ১১টায় গোলাপগঞ্জ পৌর চৌমুহনীতে হওয়ার কথা থাকলেও তাদের সংগঠনের লোকদের একত্রিত করতে না পারায় শিক্ষার্থীদের কর্মসূচী সমাপ্তি হওয়ার পর সংগঠনের ৭/৮জন লোক এমসির শিক্ষার্থীদের নিয়ে কর্মসূচী পালন করে। এদিকে কেন্দ্রের অংশ হিসেবে উপজেলা শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা পৌরসভার সানরাইজ কমিউনিটি সেন্টারের সামনে গাছ ফেলে মহাসড়ক দখল করে রাখে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকজন চরম ভোগান্তিতে পড়েন। শ্রমিকরা সিএনজি অটোরিক্সা ও লাঠিসোটা হাতে নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মহড়া দেয়। তবে গণ-পরিবহনের চালকরা অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের যাতায়াত করছে। বহিরাগত গণপরিবহনের চালকদের দীর্ঘক্ষণ গাড়ী আটকিয়ে রাখে উপজেলা শাখার শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। উপজেলার গাড়ীগুলো আটকের মুখ দেখে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এসমন অভিযোগ সিলেটের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা গণপরিবহন চালকদের। বড়লেখা থেকে আসা সাজ্জাদ মিয়া (৪৫) নামে এক নোহা চালক বলেন আমার যাত্রীবাহি গাড়ী আটকিয়ে রাখলেও পরিচিত লোকদের আটকের পর ছেড়ে দেয় গোলাপগঞ্জ উপজেলার শ্রমিক নেতারা। তাছাড়া উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে পুলিশ চেকপোষ্ট বসিয়ে গাড়ীর কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে। দুপুরে এমসি স্কুল এন্ড কলেজ এলাকায় শসাঙ্কা চন্দ্র পাউল নামে উপজেলার এক সরকারী কর্মচারীর সিলেট-ল ১২-০৭৩৯ নাম্বারের একটি মোটরসাইকেল আটক করে কাগজপত্র যাচাই বাছাই করতে দেখায় যায়। এ ব্যাপারে গোলাপগঞ্জ মডেল থানার ওসি একেএম ফজলুল হক শিবলীর সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন শিক্ষার্থী ও স্কুল কালেজের প্রধান শিক্ষকদের অনেক অনুরোধের পর শিক্ষার্থীরা তাদের কর্মসূচী প্রত্যাহার করে। রাত ১০ টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সড়গুলোতে অতিরিক্ত ভাড়ায় যান চলাচল করতে দেখা যায়।
কমলগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা জানিয়েছেন : নিরাপদ সড়কের দাবিতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগর বাজারে স্থানীয় দুটি কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছিল। গতকাল শনিবার (৪ আগষ্ট) বেলা ২টা থেকে আধাঘন্টাব্যাপী কয়েকশত শিক্ষার্থী স্থানীয় চৌমোহনা চত্বরে অবস্থান করে বিক্ষোভ করে। এসময় সকল ধরনের যান বাহনের লাইসেন্সও তল্লাসী করে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা স্থানীয় কিছু সমস্যা সমাধানেরও দাবি জানায়। পুলিশ চৌমোহনা চত্বরে অবস্থান করে বিক্ষোভ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে।
শনিবার বেলা দেড়টায় পরীক্ষা শেষে সুজা মেমোরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা এসে শমসেরনগর চৌমুহনায় জড় হয়। এর পর ছাত্ররা সম্প্রতি ঢাকায় বাস চাপায় একটি কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জন্য দায়ীদের সুষ্ঠু বিচার দাবি করে শ্লোগান দিতে থাকে। কিছুক্ষণের পর মধ্যেই স্থানীয় বিএএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থীরা এসে এ আন্দোলনে যোগ দেয়। এ সময় ছাত্ররা চলমান মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, পিকআপ ও ট্রাক আটিকয়ে যানবাহনের বৈধ কাগজপত্রসহ চালকের লাইসেন্স তল্লাশি করে। এ সময় স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। অবস্থান কর্মসূচীর সময় শিক্ষার্থীরা নানা বর্ণের বিভিন্ন দাবি সম্বলিত ফেস্টুন হাতে নিয়ে শ্লোগান দিয়ে পুরো চৌমুহনা চত্বর সরগরম করে তুলে। বৈধ কাগজপত্র নিয়ে যানবাহন সড়কে বের করা, বৈধ লাইসেন্স নিয়ে দক্ষ চালকরা যানবাহন চালাতে হবে বরে দাবি জানায়। এর মাঝে সারা দেশে নিরাপদ সড়ক দাবি, স্থানীয় শমসেরনগর-মৌলভীবাজার সড়ক সংস্কারসহ যেখানে সেখানে সিএনজি অটোরিক্সা না রাখারও দাবি জানায় শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর মাঝে সুজা মেমোরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী মশিউর রহমান, সাব্বির আহমদ, মহসীন আহমদ, শমসেরনগর বিএএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী মাহিন আহমদ ও মুন্না আহমদ জানায়, সারা দেশের চলমান ছাত্র আন্দোলনের অংশ হিসাবে তারা এ কর্মসূচী পালন করছে। সাথে সাথে স্থানীয় সড়ক ও যানবাহনের কিছু সমস্যা সমাধানেরও তারা দাবি তুলে ধরেছে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের অবস্থানের সময় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো: জুয়েল আহমদ, সুজা মেমেরিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ ম. মুর্শেদুর রহমান, শমসেরনগর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক অরুপ কুমার চৌধুরীসহ কলেজের শিক্ষকবৃন্দ চৌমোহনা এলাকায় এসে অবস্থানকারী ছাত্রদের সাথে আলাপ করেন। তারা স্থানীয়ভাবে পরিবহনখাতে যেসকল সমস্যা আছে, তা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন। বেলা আড়াইটার পর শিক্ষার্থীরা চৌমোহনা এলাকা থেকে চলে যায়।
অন্যদিকে শমসেরনগর বাজারে পরিবহন শ্রমিকরাও শনিবার সকাল ৯টা থেকে শমসেরনগর-কমলগঞ্জ সড়কের শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রের সামনে অবস্থান নিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ চালকের লাইসেন্স তল্লাশি করতেও দেখা যায়।
উল্লেখ্য, কমলগঞ্জে শিক্ষার্থীরা যাতে কোন কর্মসূচীতে যোগ না দিতে পারে সে জন্য গত শুক্রবার (৩ আগষ্ট) বিকাল সাড়ে ৩টায় কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুল হক সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কমিটির সভাপতিকে নিয়ে জরুরী বৈঠক করেছিলেন। এ বৈঠকে কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো: রফিকুর রহমান ও কমলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: মোকতাদির হোসেন পিপিএমও উপস্থিত ছিলেন।