বৃহত্তর ঐক্যে জামায়াতকে ছাড়ছে বিএনপি

52

কাজিরবাজার ডেস্ক :
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর ঐক্যের পথের বাধা সরাতে চায় বিএনপি। আর এই পথের প্রধান সংকট মনে করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীকেই। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে, এই সংকট কাটিয়ে উঠতে দলটিকে ছাড়তে হবে দীর্ঘ দেড়যুগেরও বেশি সময়ের জোটবন্ধু জামায়াতকে। এই সংকট দূর করতে সামনে আনা হচ্ছে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের নানা দিকও। পর্যালোচনা করা হচ্ছে অতীত কার্যক্রম। বিএনপি-জামায়াতের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে আলাপকালে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
আগামী দিনে বাংলাদেশের ক্ষমতাপ্রত্যাশী এমন প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব দলকে একমঞ্চে আনতে আগ্রহী বিএনপি। এ কারণে সম্ভাব্য এই ঐক্যের পথে ‘বাধা’ জামায়াতের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক যেকোনও কৌশলে নিষ্পত্তি করতে চান দলটির নীতি-নির্ধারকরা। তবে কোন পদ্ধতিতে দীর্ঘদিনের সঙ্গীকে দূরে রাখা হবে, এর পরিকল্পনা ও গ্রাউন্ড ওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দলের পৃথক প্রার্থী ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ প্রক্রিয়া সামনে এসেছে। ঐক্যে আগ্রহী দলগুলো প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, জামায়াতকে পাশে রেখে বিএনপির সঙ্গে কোনও ঐক্য নয়। আর বিএনপিও এই ঐক্যের বিকল্প দেখছে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য বলেন, ‘সিলেটে যদি তারা প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করে, তাহলে আমি কনভিন্স যে, জামায়াত আসলেই আমাদের যোগ্য বন্ধু না।’
এ প্রসঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘কী কারণে, কোন পরিস্থিতিতে সিলেটে প্রার্থী রেখেছি, সেটা বিএনপির কাছে পরিষ্কার করেছি। ১২ জন মেয়রের একটি পদেও আমরা নির্বাচন আমরা করবো না এত বড় দল হয়ে। স্থানীয় সরকারে জোটবদ্ধতার ব্যাপারে কোনও বাধ্যবাধকতাও নেই। আমরা পরিষ্কার করেছি, আমাদের প্রার্থী সিলেটে থাকবে।’
বিএনপির সঙ্গে ঐক্যে আগ্রহী যুক্তফ্রন্টের সমন্বয়ক ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘জামায়াতকে নিয়ে সবার আপত্তি আছে। জামায়াত আলাদা থাকবে, তাদের জোটেই থাকতে হবে, এটার তো দরকার নেই। তারা যদি মনে করে, তাদেরই জোট দরকার, তাহলে জামায়াতকে অ্যাডজাস্ট করেই জোটটা করতে হবে। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আসলে তো হবে না।’
জাতীয়তাবাদী ঘরানার বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, ‘জামায়াত সরে যাবে, আশা করি। আমি নেতাদের সঙ্গে কথা বলবো। তারা না গেলে জাতীয় ঐক্য হবে না। এটা খুব দরকার।’
বিএনপির নেতারা গত ১৮ বছরের রাজনীতির মূল্যায়ন শুরু করেছেন। বিশেষ করে ১৯৯৯ সালে চারদলীয় জোট গঠনের পর ২০০১ সালে সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় বিএনপি। নেতাদের ভাষ্য, জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রিসভার সদস্য হন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ৫ জনের কিচেন কেবিনেটে যুক্ত করেন জামায়াতের এই দুজনকেই। তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়াকে গণভবনের ড্রইংরুমে অপেক্ষাধীন থাকতে হলেও মুজাহিদকে নিয়ে একান্তে বৈঠক করেছেন খালেদা জিয়া। মন্ত্রী হলেও এই দুই জামায়াত নেতা জাতীয় দিবসগুলোয় যাননি জাতীয় স্মৃতিসৌধ বা একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে।
জামায়াত সঙ্গের প্রভাব পড়ে বিএনপির রাজনীতিতেও। ৯১ সালে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া ও ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে তারেক রহমান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করলেও ধীরে-ধীরে রাজনৈতিক সহানুভূতিপূর্ণ অবস্থান পাল্টাতে থাকে বিএনপির।
বর্তমানে বিএনপির ইশতেহার নিয়ে কাজ করা একজন বিএনপিপন্থী গবেষক বলেন, ‘চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে চট্টগ্রামে জেটিতে দশ ট্রাক অস্ত্র পাওয়া গেছে। ওই সময়ে শিল্পমন্ত্রী ছিলেন নিজামী। বাংলা ভাইয়ের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে একটি পরামর্শ আসে তৎকালীন বিএনপির সরকারের কাছে। ওই সময়ে মন্ত্রী আমিনুল হক, আলী আহসান মোহামম্মদ মোজাহিদ ও রুহুল কুদ্দুছ তালুকদার দুলুকে সরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ এলেও তা গুরুত্ব দেননি খালেদা জিয়া।’
বিএনপির আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা ও ইশতেহারের কাজে যুক্ত একাধিক দায়িত্বশীল জানান, পশ্চিমা দেশগুলোতে জামায়াতের নেতিবাচক প্রচারণা আছে। কয়েকবার জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে বিভিন্ন পশ্চিমা সংগঠন।
বর্তমান দলীয় কৌশল নিয়ে কাজ করছেন সিনিয়র এমন এক নেতার ভাষ্য, বিএনপিকে অতীতের চেয়ে আরও উদারপন্থী ও আরও প্রগতিশীল পন্থা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে বর্তমান দুনিয়ার বাস্তবতায় জামায়াতের মতো ধর্মভিত্তিক দলকে সঙ্গে রাখলে নির্বাচনকেন্দ্রিক সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
বিএনপির নেতাকর্মী ও বিএনপিন্থী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি চায় জামায়াতমুক্ত হতে। গত প্রায় দুই যুগের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরিমাণই বেশি। এক্ষেত্রে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে জামায়াত বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা জরুরি। বিশেষ করে হাইকোর্টের রায়ে নিবন্ধনহারা, ইসির নিবন্ধন স্থগিত থাকা দলটিকে রেখে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। আর এ কারণে জামায়াতকে ছাড়তে চায় বিএনপি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরাসরি ঘোষণা দিয়ে জামায়াতকে সরাতে চায় না বিএনপি। এমনকি জামায়াতও নিজে থেকে সরতে অনাগ্রহী। জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা চাইছে বিএনপিই তাদের ‘না’ বলুক। অন্যদিকে বিএনপির প্রত্যাশা, ধীরে-ধীরে এই সম্পর্ক উষ্ণতা হারাক। এ কারণে চারপাশে পরিবেশ তৈরি করতে চান বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা।
জামায়াতের প্রভাবশালী নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ারের বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যে জামায়াত সমস্যা, এমন কোনও আলোচনা আমাদের কাছে আসেনি। তবে জোট তো একাধিক হতেই পারে। আমরা দেখছি, ২০ দলীয় জোট যেমন আছে, যারা হয়তো আদর্শিক কারণে যুক্ত। আমরাও আদর্শিক কারণে সবার সঙ্গে জোট করতে পারি না। এমন দৃষ্টিভঙ্গি তো আমাদেরও থাকতে পারে। এরকম বিভিন্ন দলের অধিকার আছে, তারা সমমনা দল-তিনদল, পাঁচ দল, সাত দল। কাজেই একাধিক জোট হতে পারে।’
মিয়া গোলাম পরওয়ার আরও বলেন, ‘আবার এই ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সেই জোটগুলোর মধ্যে যদি একটা দফার বিষয়ে একমত থাকে, তাহলে জোটে-জোটে লিয়াঁজো হয়ে তো আন্দোলন হতে পারে।’
বিএনপির নেতারাও মনে করেন, জামায়াতকে ধরে রাখার পেছনে খালেদা জিয়াই অন্যতম কারণ। এছাড়া দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য, জামায়াতপন্থী একজন সাংবাদিক, একজন সাংবাদিক নেতার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ২০০৮ সালে ওই সাংবাদিকের পত্রিকা থেকেই বিএনপির প্রার্থীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। ফলে, খালেদা জিয়াকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলবেন, নাকি জামায়াতকে রেখে বাকিদের দূরে ঠেলবেন। আর ওই সাংবাদিক নেতাই ১৫ আগস্টে খালেদা জিয়াকে কেক কাটতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন মির্জা আব্বাসের মাধ্যমে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) শেষের দিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, পক্ষ নেননি। আর তিনি চাইতেন একটা ইলেক্টোরাল অ্যালায়েন্স হতে পারে। এই ঐক্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের হয়েছে, অন্যদেরও হচ্ছে। তাদের সঙ্গে ইলেক্টোরাল অ্যালায়েন্স বলতে বিএনপির প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে, বিএনপির স্বার্থ দেখবে না, এটা হবে না। খালেদা জিয়া ওইভাবেই দেখেছিলেন। আদর্শিক ভিত্তিতে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির কোনও সম্পর্ক নেই।’
জামায়াতের পক্ষাবলম্বনকারী স্থায়ী কমিটির প্রবীণ এক সদস্য বলেন, ‘জামায়াতের পক্ষে কেবল খালেদা জিয়া আর আমি আছি। ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করার আগে জামায়াত রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে বিএনপিকে সমর্থনের বিষয়ে বলে এসেছিল। ওই সময় থেকেই বিএনপির উইকনেস তৈরি হয়েছে। কিন্তু জামায়াতের অ্যাডভানটেস নিয়েছে বেশি। আর সিলেটে যদি তারা মেয়র প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করে তাহলে আমি তো বুঝবো, তারা আসলেই বিএনপির বিরুদ্ধে। এটা নেত্রীও বুঝবেন।’
জামায়াতসঙ্গ থাকার উপকারিতা প্রসঙ্গে এই নেতার মূল্যায়ন, ‘জামায়াত সঙ্গে থাকলে বিএনপি ৪ সিট পাবে, না থাকলে ৩টি। এই পার্থক্য।’ এছাড়া দু’টি কারণে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক কমিয়ে আনার পক্ষে এই নেতা। তিনি বলেন, ‘প্রথমত তাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার অভিযোগ আছে। দ্বিতীয়ত, দলের অনেকে তাদের নিয়ে হ্যাপি না। তারা যা করছে এবং করেছে, তাদের নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি আছে।’
যদিও চেয়ারপারসন কার্যালয়ের প্রভাবশালী একটি সূত্র বলছে, জামায়াত আরও ছয়মাস আগেই বিএনপিকে এই প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে যে, ঐক্যের খাতিরে তাদের প্রয়োজনে দূরে ঠেলতে পারে। এক্ষেত্রে যৌক্তিক বোঝাপড়ায় উন্নীত হতে হবে দল দু’টিকে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য বলেন, ‘আলোচনার মাধ্যমে আলাদা হলেও বোঝাপড়া ঠিক হতে হবে। বিএনপি কত আসনে ছাড় দেবে, কত আসনে আমরা ছাড় দেব ইত্যাদি বিষয় পরিষ্কার থাকতে হবে।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘জামায়াতকে নেন বা না নেন, আগে ঐক্যটা জরুরি। ঐক্যটা আগে হোক। ঐক্যে কে লিড দেবে, কে সমন্বয় করবে, এই বিষয়গুলো হলে ঐক্যটা হবে। বি চৌধুরী, ড. কামাল হোসেনসহ অনেকেই ইতিবাচক। ফলে, জামায়াত নিয়ে ভাবনার কিছু নেই।’