॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত উসিলার শিরক ও লক্ষ্য করা যায় যেখানে এখনও অনেক মুসলিম বিশ্বাস করেন আল্লাহ তা’য়ালাকে পেতে হলে মাধ্যম ধরা লাগে, গবফরধ লাগে। এটা একটি শিরিকী বিশ্বাস, কুফুরী বিশ্বাস, কাফের মুশরিকদের বিশ্বাস যে আল্লাহকে পেতে হলে গবফরধ লাগবে, মাধ্যম লাগবে। মক্কার কাফের-মুশরেকরাও মূর্তির উপাসনা করতো এজন্যে যে, এ সকল মূর্তির মাধ্যমে তারা আল্লাহ তা’য়ালার নৈকট্য হাছিল করবে। সূরা আয যুমারের ৩ নং আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ “জেনে রাখো! আল্লাহ তা’য়ালার জন্যেই একমাত্র ইবাদত। আর যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা কেবল এজন্যেই তাদের (মূর্তিগুলোর) ইবাদত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহ তা’য়ালার নিকটবর্তী করে দিবে”। আল্লাহ তা’য়ালাকে পাবার জন্যে কোন মিডিয়ার প্রয়োজন নাই, তিনি সরাসরি দেখেন, সরাসরি শুনেন ও সরাসরি জানেন। আমরা আল্লাহ তা’য়ালাকে আল্লাহ বলে ডাক দিব সাথে সাথে আল্লাহ তা’য়ালা আরশে আযীম থেকে বান্দাহ বলে জবাব দিবেন। সূরা মুমিন এর ৬০ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ “আর তোমাদের বর বলছেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব”। সরাসারি আল্লাহর সাথে ঈড়হহবপঃরড়হ, মাঝখানে কোন পি. এস. আল্লাহ পাক রাখেন নাই। সূরা আল বাক্বারার ১৮৬ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, “যখন আমার বান্দাহ আমার সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তার অতি নিকটে। আহ্বানকারী যখন আহ্বান করে তার আহ্বানে সাড়া দিই”। এখনও আমরা মুখ থেকে আল্লাহ শব্দ বের করি নাই অন্তরে শুধু কল্পনা করছি তখনও আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের নিকটে। সুতরাং এত নিকটে আল্লাহ তা’য়ালা থাকা সত্ত্বেও সেই আল্লাহ তা’য়ালাকে পাবার জন্যে, সে আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদত করার জন্যে কোন মাধ্যম কোন উসিলার দরকার নাই। এ উসিলার ধারণা মক্কার কাফের-মুশরেকদের ধারণা। কিন্তু এ উসিলার পিছনে পড়ে আমাদের দেশের অসংখ্য মুসলিম লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি টাকা খরচ করছেন শুধু আল্লাহ তা’য়ালাকে পাবার জন্যে অথচ এটা একটি শিরকি কার্যক্রম।
তারপর শুভ-অশুভ কুলক্ষণে বিশ্বাস করা আমাদের দেশের কিছু মুসলিমদের চিরাচরিত অভ্যাস। শনিবারে, মঙ্গলবারে কোন ভাল কাজ করা যাবে না, এ দিনগুলো ভাল না, অমুক দিন বিয়ে-সাদি করা যাবে না, অমুক মাসে এটা করা যাবে না, জন্ম মাসে এটা করা যাবে না, অমুক দিন গাছ কাটা যাবে না, অমুক দিন ওটা করা যাবে না, এভাবে অসংখ্য বিষয় রয়েছে, এ সবই শির্কী বিশ্বাস। গণকের কাছে যাওয়া, গণকের বিশ্বাসও মুশরিকদের একটা কাজ। আমাদের দেশের অনেক মুসলিম এখনও গণকে, রাশিতে বিশ্বাস করেন, বিভিন্ন তারকাপূজারীদের কথাবার্তা বিশ্বাস করেন। শুধু তাই না, এদেশের অসংখ্য মুসলিমদের গলায়, হাতে, কোমরে তাবিজ-তুমার পাওয়া যায়। এই তাবিজ-তুমার গলায়, হাতে, কোমরে নিয়ে রামাদান মাসে যত রোযা পালন করেন, যত তারাবীহ্ আদায় করেন, যত লাইলাতুল ক্বদর করেন কিছুই আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে ফায়দা আসবে না। কোরআনুল কারীম দিয়েও তাবিজ ব্যবহার করা যাবে না। কোরআন আল্লাহ তা’য়ালা তাবিজ-তুমারের জন্যে নাযিল করেন নাই। নবী (সাঃ) এর পুরো জিন্দিগীতে তাঁর হাত মোবারক দিয়ে বা কোন সাহাবীর হাত দিয়ে একটি কোরআনের আয়াতও লিখে কাউকে দেন নাই যে, তুমি এ আয়াতটি হাতে বেঁধে রাখো, গলায় বেঁধে রাখো, গলায় ঝুলে রাখো, কোমরে বেঁধে রাখো। এ রকম তথ্য কোন একটা জাল হাদিসেও আসে নাই। তাহলে যে কোরআনুল কারীমকে নবী (সাঃ), সাহাবায়ে কেরাম এ কাজে ব্যবহার করেন নাই সে কোরআনকে এ কাজে ব্যবহার করা শিরক। এরপর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করা শিরক। আমাদের দেশে অনেক কবরের কাছে গেলে দেখা যায় মানুষ ঐ কবরে সেজদা করছে। মান্নত করছে বিভিন্ন কবরের উদ্দেশ্যে, মাজারের উদ্দেশ্যে। সন্তান চাচ্ছে, বিপদ আপদ থেকে মুক্তি চাচ্ছে, এটা সেটা চাচ্ছে, এ সবই শির্কী কার্যক্রম। এ শির্কী কার্যক্রম যাদের মাঝে আক্বীদাগত ও আমলগত থাকবে তারা যতই সিয়াম, ক্বিয়াম, লাইলাতুল ক্বদরে ইবাদত করুক নবী (সাঃ) বলেন, আল্লাহ পাক তাদের কোন গুনাহ মাফ করবেন না।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলোঃ এহতেছাবের সাথে সিয়াম (রোজা) পালন করতে হবে। কোরআন ও সুন্নায় এহতেছাব তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম অর্থটি হলো, আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টি এবং রহমত পাবার উদ্দেশ্যে যে কোন ইবাদত, যে কোন আমল করতে হবে, অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকা যাবে না। এটাকে বলা হয় এহতেছাব। সূরা আল বাকারার ২০৭ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ “মানুষের মধ্যে এমনও কিছু মানুষ আছে যারা আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজেদেরকে তাঁর কাছে বিক্রি করে দেয়। আল্লাহ পাক এ ধরনের বান্দাদের প্রতি স্নেহশীল”।
নিজের যত কষ্ট হোক, নিজের কষ্টকে কষ্ট মনে না করে আল্লাহ তা’য়ালার হুকুমের সামনে নিজেকে মাথা নত করে দেয়া। সূরা আল বাকারার ২১৮নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ “নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, যারা হিজরত করেছে ও যারা আল্লাহ তা’য়ালার রাস্তায় জিহাদ করেছে এ মানুষগুলো আল্লাহ তা’য়ালার রহমতের প্রত্যাশা করে। এ মানুষগুলোর প্রতি আল্লাহ তা’য়ালা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। তাহলে ঈমান আনা, হিজরত করা, জিহাদ করা, আমলে সালেহ করা, সিয়াম পালন করা, কিয়াম করা, লাইলাতুল ক্বাদর করা, সমস্ত ইবাদত করতে হবে আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, অন্য কোন উদ্দেশ্যে করা যাবে না, এটার নাম হলো এহতেছাব। এহতেছাবের আরেকটা অর্থ হলো আল্লাহ তা’য়ালাকে একমাত্র সাহায্যকারী হিসাবে যথেষ্ট মনে করা। সূরা আল আনফালের ৬৪ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ “হে নবী, আপনার জন্যে এবং আপনাকে যেসকল মু’মীনেরা অনুসরণ করেন তাদের সকলের জন্যে আমি আল্লাহ তা’য়ালাই যথেষ্ট”। এ আয়াত থেকে বুঝা যায় মু’মীনদের মধ্যে সবাই নবীর অনুসরণ করেন না, এজন্যে বলা হয়েছে মু’মীনদের মধ্য থেকে যারা আপনার অনুসরণ করে তাদের জন্যে আমি আল্লাহ তা’য়ালাই যথেষ্ট। তাই আল্লাহ তা’য়ালাকে যথেষ্ট মনে করা এটি হলো এহতেছাব। সূরা আত্ তাওবার ১২৯নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ “যদি তারা আপনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আপনি বলুন, আমার জন্যে আল্লাহ তা’য়ালাই যথেষ্ট”। এহতেছাবের আরেকটা অর্থ হলো কষ্টের মধ্যে, বিপদের মধ্যে সবর ধৈর্যধারণ করা। রামাদান মাসের সিয়াম পালন করা এটা কিন্তু স্বাভাবিকভাবে একটা কষ্টের বিষয়। কিন্তু ঈমানের কারণে আমাদের কাছে কষ্ট লাগে না, বরং মজা লাগে, ভাল লাগে। কিন্তু যাদের ঈমানের দুর্বলতা আছে, ঈমানে গন্ডগোল আছে তাদের জন্যে কিন্তু এ রোযা পালন করা, এ ক্বিয়াম করা, এ লাইলাতুল ক্বাদর করা অনেক কষ্টকর। এজন্যে রামাদান আসার পরে প্রথম ৪/৫ দিন তারাবীহ এর নামাযে আমাদের দেশের মসজিদগুলিতে জায়গা হয় না। কিন্তু ৫/৭ দিন অতিবাহিত হবার পর দেখা যায় মসজিদগুলি আস্তে আস্তে খালি হতে থাকে। আবার দেখা যায় রমাদানের শেষের দিকে ২৬/২৭ তারিখে তারা মসজিদে আসেন। মাঝখান দিয়ে থাকতে না পারার কারণ হলো এহতেছাব নাই, সবর নাই, কষ্টের মাঝেও এ ইবাদত করার মত ধৈর্য নাই। এই সবরের নাম হলো এহতেছাব। সূরা বাক্বারার ১৫৩নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, “হে মু’মিনগণ, ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে আল্লাহ তা’য়ালার কাছে সাহায্য চাও। নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন”। সূরা বাক্বারার ১৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, “আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। অতএব, (হে নবী) তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও”।
তৃতীয় শর্তটি শুধু সিয়ামের সাথে সম্পৃক্ত নয় এটা সকল ইবাদত কবুল হওয়ার জন্যে শর্ত আর তা হলো হালাল রিযিক তথা হালাল উপার্জন। রিযিক হালাল না করে, সুদ-ঘুষ না ছেড়ে রামাদান মাসে সিয়াম, কিয়াম ও লাইলাতুল ক্বাদর করলে তা কোন কাজে আসবে না। পরিবার পরিজনের জন্যে যে আয় করা হচ্ছে এবং যা ব্যয় করা হচ্ছে তা বৈধ পন্থায় অর্জিত হচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে। ঈদের সময় কেনাকাটার জন্যে যে টাকা পয়সা খরচ করা হচ্ছে সেসব টাকা পয়সা কোন পন্থায় অর্জিত হচ্ছে তা দেখতে হবে। এটা না করে রামাদান মাসে যত সিয়াম, ক্বিয়াম, লাইলাতুল ক্বদর, হাজার হাজার মানুষকে ইফতার করানো হোক না কেন, যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করা হোক না কেন আল্লাহ তা’য়ালা এর মাধ্যমে বিন্দুমাত্র ফায়দা দিবেন না। সহীহ আল মুসলিমের হাদিসে নবী (সাঃ) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’য়ালা পূতপবিত্র, হালাল রিযিক ছাড়া কোন ব্যক্তির ইবাদত তিনি কবুল করেন না”। হালাল রিযিক অন্বেষণ করা থেকে কোন নবী রাসূলকেও আল্লাহ তা’য়ালা মুক্তি দেন নাই। সূরা আল মুমিনুনের ৫১ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ “হে রাসূল! হালাল রিযিক খাও, তারপর আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদত করো”। যেসব নবী রাসূল মা’সুম বেগুনাহ, যাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহসমূহ আল্লাহ তা’য়ালা ক্ষমা করে দিয়েছেন তাদেরকেও হালাল রিযিক খাওয়ার জন্যে আল্লাহ তা’য়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশ আগে হালাল রুজির ব্যবস্থা করে তারপর আমলে সালেহ তথা ভাল আমল করতে হবে। এজন্যে নবী রাসূলেরা প্রত্যেকে কেউ কামারের পেশা, কেউ কুমারের পেশা, কেউ দর্জির পেশা, কেউ ছাগল চরানোর পেশা, ইত্যাদি সব পেশা নবী রাসূলরা গ্রহণ করে হালাল রিযিকের ব্যবস্থা করে আল্লাহ তা’য়ালার দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। সহীহ আল মুসলিমে বর্ণিত হাদিস, নবী (সাঃ) বলেন, “কোন মোসাফির মরুভূমির রাস্তা দিয়ে হাটছেন, তার জামা-কাপড় ময়লা, তার দাড়ি উস্ক খোস্ক হয়ে আছে, এমন অবস্থায় আছে যে, সে আল্লাহ তা’য়ালাকে আল্লাহ বলে ডাক দিবার আগেই আল্লাহ তা’য়ালা বলেন বান্দাহ আমি হাজির। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে থাকা সত্ত্বেও নবী (সাঃ) বলছেন, “এ লোক বলছেন, হে আমার রব! হে আমার রব! কিন্তু তার খাবার হারাম, তার পানীয় হারাম, তার গেজা হারাম, কেমন করে আল্লাহ তা’য়ালা তার ডাকে সাড়া দিবেন”? এরকম দোয়া কবুলের ঘনিষ্টতম মুহূর্তে থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তা’য়ালা তার ডাকে সাড়া দেন না। মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হাদিস হযরত ইউসুফ বিন আসবাত (রাহঃ) বলেন, কোন যুবক যখন ইবাদতে মনোনিবেশ করে, তখন শয়তান নিজের সহকর্মীদেরকে বলে, খোঁজ নাও লোকটি কী খায়! সে যদি হারাম খায়, তাহলে সে যত ইচ্ছা ইবাদত করে ক্লান্ত হোক, বাধা দিও না। কেননা সে নিজেই নিজের ইবাদত ধ্বংসের জন্যে যথেষ্ট। হারাম খাওয়া অব্যাহত রেখে ইবাদত তার কোন কাজে আসবে না।” সুতরাং এ রামাদান মাসের ফযিলত, রহমত, বরকত, মাগফিরাত লাভ করতে হলে আমাদের রিযিক হালাল করতে হবে। প্রয়োজনে হালাল রিযিকের মাধ্যমে আমাদের যতটুকু খাবার অর্জিত হয় তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে, হারাম বর্জন করতে হবে।
প্রসঙ্গত : রামাদান মাসের কিয়ামুল লাইল তথা তারাবীহ নামাযের রাকাতের সংখ্যা নিয়ে আমাদের সমাজে কিছু বিতর্ক লক্ষ্য করা যায়। এ বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার বড় কারণ হলো তারাবীহ নামায সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা। ক্বিয়ামুল লাইল বা তারাবীহ এর নামায নবী (সাঃ) রাত্রির প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগে আদায় করতেন। নবী (সাঃ) এশার নামাজের পরে রামাদান মাসে অল্প কিছুক্ষণ সময় ঘুমাতেন, এরপর উঠে তিনি ক্বিয়ামে রমাদান/ক্বিয়ামুল লাইল তথা তারাবীহ এর নামাজ আদায় শুরু করতেন। সহীহ আল বুখারী ও সহীহ আল মুসলিমে বর্ণিত যে হাদিসটি ইমাম বুখারী (রাহঃ) তারাবীহ নামাযের অধ্যায়ে বর্ণনা করেন, হযরত আবু সালামাহ ইবনু আব্দুর রহমান (রাঃ) হতে বর্ণিত, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) রামাদানে ও রামাদানের বাইরে জীবনে কোন দিন ১১ রাকাতের বেশী ক্বিয়ামুল লাইল নামাজ আদায় করেন নাই। কিন্তু নবী (সাঃ) এর এ ১১ রাকাত কেমন ছিল, কত সুন্দর ছিল সে সম্পর্কে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেন, “নবী (সাঃ) এর এ নামাজ কত সুন্দর ও কত লম্বা হতো সে সম্পর্কে তুমি আমাকে প্রশ্ন করো না”। অর্থাৎ নবী (সাঃ) এর এ ১১ রাকাত নামায এত লম্বা সময় ধরে আদায় করতেন যা শেষ হতে প্রায় ফজর ওয়াক্ত হয়ে যেত। এশার নামাজের ১ বা ২ ঘণ্টা পরে শুরু করতেন, শেষ হতে ফজরের ওয়াক্ত হয়ে যেত, সাহরীর সময়ের শেষ দিকে চলে যেত, তিনি ফজরের পূর্ব মুহূর্তে তাড়াতাড়ি সাহরী খেতেন। এর আগ পর্যন্ত নবী (সাঃ) ক্বিয়ামে রামাদান আদায় করতেন। সাহাবায়ে কেরামের সময় এশার পরে ক্বিয়ামে রমাদান শুরু হয়ে সেই ফজর পর্যন্ত সারা রাত চলতো এই ক্বিয়ামে রমাদান। এরপর তাবেয়ীনের কেরামের আমলেও এ রকম তারাবীহ নামাযে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে কষ্ট হতো। হাদিসের মধ্যে এসেছে এত লম্বা কেরাত পড়া হতো যে তাঁরা স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন না, তখন অনেকে হাতের মধ্যে লাঠি নিয়ে তার উপর ভর করে দাঁড়িয়ে এ তারাবীর নামাজ আদায় করতেন।
পরবর্তীতে মক্কা মোকাররমায় যে সকল সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন, তাবেয়ীনে কেরাম ছিলেন তাঁরা চিন্তা করলেন এভাবে আট রাকাতে এ রকম লম্বা কেরাতে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। আট রাকাতে যদি ৬ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাহলে প্রতি রাকাতে প্রায় ৪৫ মিনিট। তাই তাঁরা গবেষণা (ইজতেহাদ) করলেন যে, নবী (সাঃ) তো আমাদেরকে বলেন নাই যে আমি আট রাকাত তারাবীহ এর নামাজ পড়ি তোমদেরকেও আট রাকাত পড়তে হবে। নবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি রমাদান মাসে ক্বিয়াম (তারাবীহ) করবে, কয় রাকাত পড়বে তা নির্দিষ্ট করেন নাই। তখন সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা এর রাকাতের সংখ্যা বাড়িয়ে দিই, ৬ ঘণ্টাই তারাবীহ হবে, তবে ৬ ঘণ্টায় ৮ রাকাতের পরিবর্তে ২০ রাকাত তারাবীহ পড়বো। মক্কা মোকাররামার সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীনে কেরাম তাঁরা এই তারাবীহ এর আট রাকাতকে বৃদ্ধি করে ২০ রাকাতে করে নিলেন যাতে ১ রাকাতে ৪৫ মিনিটের পরিবর্তে ১ রাকাতে ২০ মিনিট দাঁড়াবেন বা ২৫ মিনিট দাঁড়াবেন যাতে এর রাকাতের সংখ্যা বেড়ে যায় মাঝখানে একটু উঠানামা করলে দাঁড়াতে কষ্টটা কম হবে। এজন্যে মক্কা মোকাররামায় তারাবীহকে পরবর্তীতে ২০ রাকাতে বাড়ানো হলো। আর মদীনা মুনাওয়ারাতে যে সকল সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীনে কেরাম ছিলেন তাঁরা বললেন না, ২০ রাকাতেও কষ্ট হয়। তাই মদীনা মুনাওয়ারাতে এটাকে ৪০ রাকাতে বৃদ্ধি করা হলো। ইমাম মালেক (রাহঃ) মাসজিদে নববীর যখন ইমাম ছিলেন তখন তিনি ৩৮ রাকাত তারাবীহ পড়াতেন এবং ৩ রাকাত বিতর পড়াতেন, অর্থাৎ মাসজিদে নববীতে সর্বমোট ৪১ রাকাত তারাবীহ ও বিতর পড়াতেন। তাই তারাবীহ এর নামাজ ৮ রাকাত থেকে শুরু করে ৩৮ রাকাত বা ৪০ রাকাত পর্যন্ত পড়ার হাদীস পাওয়া যায়। অর্থাৎ ক্বিয়ামে রামাদান (তারাবীহ) কত রাকাত হবে এটা নবী (সাঃ) নির্দিষ্ট করেন নাই, আল্লাহ তা’য়ালা ও নির্দিষ্ট করেন নাই।
কয় রাকাত তারাবীহ আদায় করা হলো এটা মুখ্য বিষয় না, মুখ্য বিষয় হলো তিনি কতক্ষণ সময় ধরে তারাবীহ আদায় করলেন। তিনি কি ক্বিয়ামে রামাদান ৫ ঘণ্টা যাবৎ আদায় করলেন, ৩ ঘণ্টা যাবৎ আদায় করলেন নাকি ২ ঘণ্টা যাবৎ আদায় করলেন? এটাই হলো আল্লাহ তা’য়ালার নিকট মুখ্য বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায় ঐটা বাদ দিয়ে অপ্রয়োজনীয় জিনিষ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করেন যা শয়তানের ওয়াছওয়াছা, শয়তানের কাজ। এটা কোন জরুরী কোন বিষয় না যে, তারাবীহ ৮ রাকাত হবে নাকি ২০ রাকাত হবে। কিন্তু তারাবীহ ৪০ রাকাত হবে এটা নিয়ে কেউ বিতর্ক করেন না, কথাবার্তাও বলেন না, এবং এটা আমরা অনেকে শুনিও নাই যে তারাবীহ ৪০ রাকাত পড়া যায়, অথচ মাসজিদে নববীতে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীনে কেরাম ৪০ রাকাত পর্যন্ত তারাবীহ আদায় করেছেন। তাহলে ২০ রাকাত কেন আমরা ৪০ রাকাত তারাবীহ ও পড়তে পারি। কিন্তু শর্ত হলো আমরা যেভাবে দ্রুতগতিতে তারাবীহ পড়ি এভাবে পড়া যাবে না। তারাবীর নামাজ আদায় করতে হবে কোরআনে কারীমের তেলাওয়াত সহীহ তাজবীদ সহকারে স্পষ্ট করে উচ্চারণের মাধ্যমে। আমাদের দেশে যেভাবে দ্রুতগতিতে তারাবীর নামাজ আদায় করা হয়, কিছুই বুঝা যায় না কী তেলাওয়াত হচ্ছে? একটা শব্দ, একটা বাক্য সুন্দর করে বুঝা যাচ্ছে না, যেখানে টানার কখা সেখানে টান নাই, যেখানে টানার দরকার নাই সেখানে লম্বা টান। আমাদের দেশে তারাবীর নামাযের তেলাওয়াতের মধ্যে শেষে লম্বা টান শুনা যায়, মাঝখানে আর কোন লম্বা টান শুনা যায় না, অথচ মাঝখানে ৪ আলিফ, ৩ আলিফের অনেক টান আছে কিন্তু এ টান আর শোনা যায় না। শেষে ৭ আলিফ, ১০ আলিফ পর্যন্ত একটা লম্বা টান দিয়ে রুকুতে চলে যায়। আমাদের দেশে যে হাফেজ সাহেব যত তাড়াতাড়ি তারাবীহ পড়াতে পারেন ঐ হাফেজ সাহেবের পদবীও তত বেশী যে ওনি খুব ভাল হাফেজ, একেবারে আধা ঘণ্টায় তারাবীহ শেষ করে ফেলেন, খুব গরম হাফেজ। অথচ তিনি কোরআনুল কারীমকে ধ্বংস করলেন, ইসলামকে ধ্বংস করলেন। এজন্যে তারাবীহ নামাজের ক্ষেত্রে কত রাকাত পড়া হচ্ছে, কত পারা তেলাওয়াত হয়েছে এটা মুখ্য বিষয় না, মুখ্য বিষয় হলো কতক্ষণ সময় ধরে এই কিয়ামে রামাদান আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আদায় করা হলো, এটাই হলো আল্লাহ তা’য়ালার নিকট মুখ্য বিষয়।
নবী (সাঃ) ক্বিয়ামে রামাদানের শুধু ফযিলত বর্ণনা করতেন, নির্দেশ দিতেন না। কারণ তিনি নির্দেশ দিলে সেটা আদায় করা উম্মতের জন্যে ওয়াজিব হয়ে যাবে এ আশংকায়। নবী (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে নিয়মিত জামায়াতের সাথে তারাবীহ এর নামায আদায় করতেন না। কারণ তিনি আশংকা করতেন আল্লাহ তা’য়ালা যদি আমার এ উম্মতের উপর ক্বিয়ামে রামাদানকে ফরজ করে দেন তাহলে আদায় করা উম্মতের কষ্ট হবে।
রাসূল (সাঃ) হলেন উম্মতের জন্যে রাহমাতুল্লিল আলামীন, রাউফুর রাহীম। তিনি সর্বদা চিন্তা করতেন এ উম্মতের জন্যে দ্বীনকে/ শরীয়তকে কত সহজ করা যায়, কত হালকা করা যায়। যেসকল শ্রমিক ভায়েরা রামাদান মাসে রোজা রেখে দিনের বেলায় কাজ করেন, রিকশা চালান, ইট ভাঙ্গেন, কঠিন পরিশ্রমের কাজ করেন, আল্লাহ তা’য়ালা যদি এ রকম উম্মতের জন্যেও যদি ক্বিয়ামে রামাদান (তারাবীহ) আদায় করা ফরজ করে দেন তাহলে উম্মতের কষ্ট হবে। দিনের বেলায় কষ্ট করে রোজা রেখে রাতের বেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারাবীহ আদায় করা তাদের জন্যে কষ্টকর। এজন্যে নবী (সাঃ) নিয়মিত সাহাবাদেরকে নিয়ে জামায়াতের সাথে তারাবীহ এর নামাজ আদায় করেন নাই। জামে আত তিরমীযিতে পাওয়া যায় মাত্র ৩ দিন বা ৪ দিন নবী (সাঃ) মাসজিদে নববীতে সাহাবাদেরকে নিয়ে জামায়াতের সাথে তারাবীহ আদায় করেছিলেন। (সমাপ্ত)