কাজিরবাজার ডেস্ক :
আজ মাহে রমজানের ২৩তম দিবস। মুমিন মুসলমানের জন্য নিত্য গুরুত্ববহ একটি বিষয় আজ এখানে অবতারণা করতে চাই। সব বিষয়ের নিজস্ব কিছু পরিভাষা থাকে। ইসলামী শরিয়তেরও নিজস্ব কিছু পরিভাষা আছে। এ সব পরিভাষার মাধ্যমে ইসলামী শরিয়তের বিধানগুলো পর্যাক্রমিক গুরুত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব। ইসলামী শরিয়ত ও আইনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও পালনীয় হল ফরজ এরপর রয়েছে ওয়াজিবের স্থান। তৃতীয় পর্যায় রয়েছে সুন্নাত। আমাদের অনেকের কাছে এ শ্রেণীবিন্যাসটি সুস্পষ্ট নয় বলে ইবাদত বন্দেগিতে সন্দিহান হয়ে পড়েন, বিঘিœত হয় তাদের আসল উদ্দেশ্য। মাহে রমজানে এ অখন্ড ধর্মীয় চিন্তা ও অনুশীলনের সময়ে বিষয়টি আমাদের আত্মস্থ করা দরকার। আজ আমরা এখানে শুধু ফরজে আইন ও ফরজে কিফায়া বিষয়টি স্পষ্ট করতে চাই।
শরিয়তের এমন কতগুলো বিধান আছে যেগুলো পালন করা অবশ্য কর্তব্য। অবজ্ঞা সহকারে সেগুলো বর্জন করলে ইমান থাকে না। আর অলসতা করে পালন না করলে কঠিন শাস্তিযোগ্য হয়। এ ধরনের বিধানকে ফরজ বলা হয়। যে সব কাজ কুরআন ও সুন্নাহর অকাট্য দলীল দ্বারা অবশ্য পালনীয় ও অলঙ্ঘনীয় বলে প্রমাণিত তাই ফরজ। ফরজ কাজ কোন অবস্থাতেই পরিত্যাগ করা যায় না। ফরজ কাজ না করলে কবিরা গুনাহ হয় এবং তার অস্বীকারকারী পবিত্র ইসলাম থেকে পদস্খলিত হয়ে কাফির হয়ে যায়।
যেসব ফরজ কাজ সম্পাদন করার জন্য প্রত্যেক মুসলমান ব্যক্তিগতভাবে দায়ী, তাকে ফরজে আইন বলা হয়। শরিয়তসম্মত কোন কারণ ছাড়া ফরজে আইন ত্যাগ করা যায় না। যেমন- দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত কায়েম করা, রমজান মাসের সিয়াম পালন করা, যাকাত আদায় করা, সম্পদশালী সুস্থ ব্যক্তির জীবনে একবার হজ্ব করা ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, দ্বীন সম্পর্কীয় অত্যাবশ্যক বিষয়াদির ইলম হাসিল করাও ফরজে আইন, যা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। এ পর্যায়ে রয়েছে, ইসলামের বিশুদ্ধ আকিদাসমূহ শিক্ষা করা অর্থাৎ যে সমস্ত আকিদা পোষণ করা ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তিকে মুসলমান বলা চলে না, সেই বিশ্বাসাবলীর জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। ইমানে মুফাসসালে এসব বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে:
আমি ইমান আনলাম : ১. আল্লাহর প্রতি, ২. তার ফেরেশতাগণের প্রতি, ৩. তার কিতাবসমূহের প্রতি, ৪. তার রাসুলগণের প্রতি, ৫. আখিরাতের প্রতি, ৬. তাকদিরের ভালমন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, এর প্রতি, ৭. মৃত্যুর পর পুরুত্থানের প্রতি।
কুরআন শরিফের সুরা ফাতিহা ও সুরা বাকারার শেষ রুকুতে এবং অন্যান্য সুরায় এ বিশ্বাসসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। উপরোক্ত বিষয়গুলোর ইলম হাসিল করা ফরজে আইন।
অনুরূপ পাকি-না পাকির আহকাম ও মাসাইল, নামাজ- রোজাসহ অন্যান্য ফরজ-ওয়াজিব ইবাদত এবং হারাম ও মাকরুহ বিষয়সমূহ সম্পর্কে ইলম হাসিল করা ফরজে আইন। হজ্ব যার ওপর ফরজ তার জন্য হজ্বের মাসআলা জানা, কেনাবেচা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানায় নিয়োজিত ব্যক্তির তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জন্য জ্ঞান অর্জন করা এবং বিবাহ শাদির উদ্যোগ গ্রহণকারীর জন্য বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন করা ফরজে আইন।
কাজি সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ.) তাঁর বিখ্যাত ‘তফসিরে মাযহারি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, করণীয় ও বর্জনীয় বাতেনি আমলসমূহ যেগুলোর জ্ঞানকে ‘ইলমে তাসাউফ’ বলা হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাও প্রত্যেকের জন্য ফরজে আইন। এক্ষেত্রে ফরজে আইন বলতে ইলমে তাসাউফের কেবল ঐ অংশের জ্ঞানকে বুঝায় যে সবর-শোকর, কানা’আত (অল্পে তুষ্ট) ইত্যাদির এক বিশেষ স্তর পর্যন্ত।
পক্ষান্তরে, গর্ব-অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, কৃপণতা, দুনিয়ার মোহ ইত্যাদি কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে হারাম। এ সব বিষয়ের স্বরূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কে অবগত হওয়া, গ্রহণীয় বিষয়সমূহ অর্জন করা এবং হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ বর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ। এ সকল বিষয়ের উপরই ইলমে তাসাউফের ভিত্তি যা শিক্ষা করা সকলের জন্য ফরজে আইন।
যেসকল কাজ পালন করা মুসলমানের ওপর ফরজ, কিন্তু সমাজের কতিপয় মুসলমান যদি তা সম্পন্ন করে তবে অবশিষ্ট সবাই ঐ কাজের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়, এরূপ কাজকে ফরযে কিফায়া বলা হয়। যেমন- জানাযার নামাজ, জিহাদ প্রভৃতি।
একইভাবে যে সমস্ত ইলম জরুরী বটে, কিন্তু সকলের জন্য ব্যক্তিগতভাবে অর্জন করা আবশ্যক নয়, সমাজের এক শ্রেণী বিশেষভাবে তা অর্জন করলেই গোটা সমাজ দায়িত্বমুক্ত হয়ে যায়। এই ইলমকে ফরজে কিফায়া পার্যায়ের ইলম বলা হয়ে থাকে।
মুফতী মুহাম্মদ শফীর (রহ.) ‘তাফসিরে মা’আরিফুর কুরআন’ গ্রন্থে ফরজে কিফায়া ইলমের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : গোটা কুরআন মাজিদের সম্পূর্ণ অর্থ জানা এবং কুরআনের বর্ণিত সকল বিষয়াদি অনুধাবন করা, সমুদয় হাদিসের মর্ম উপলব্ধি করা, হাদিস শাস্ত্রের ব্যুৎপত্তি অর্জন এবং কুরআন ও হাদিসের আলোকে গৃহীত বিধানাবলীর জ্ঞান লাভ করা এত ব্যাপক ও গুরুত্ববহ কাজ যে, গোটা জীবন ব্যয় করেও এতে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তাই ইসলামী শরিয়তে একে ফরজে কিফায়া বলে গণ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ কিছু সংখ্যক লোক এসব জ্ঞান অর্জন করে নিলেই অন্যরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। চিকিৎসা বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান প্রভৃতিও এ পর্যায়ে পড়ে। সমাজের একাংশ এ বিদ্যা অর্জন করলেই গোটা সমাজ এর দ্বারা উপকৃত হতে পারে।
মু’আমালাত, অসিয়্যত ও ফারাইয বা উত্তরাধিকার বণ্টনের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যাও এ পর্যায়েরই ইলম। উল্লেখ্য, ফরজ সংক্রান্ত বিষয়াদির ইলম হাসির করা ফরজ। ওয়াজিব সংক্রান্ত বিষয়াদির ইলম হাসিল করা ওয়াজিব আর নফল সংক্রান্ত বিষয়াদির ইলম হাসিল করা নফল।