কাজিরবাজার ডেস্ক :
কুরআন নাজিলের পূর্ণ স্মৃতি বিজড়িত রমজানুল মুবারকের আজ ১৮ তম দিবস। ক’দিন পরেই শুরু হবে কুরআন নাজিলের দশক। এ মাসে যেমন আল কুরআন নাজিল হয়েছিল তেমনি অন্য বাকি ৩টি প্রধান আসমানি কিতাব তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিলও আল্লাহ এ মাসে নাজিল করেছিলেন। পবিত্র কুরআন সেসব বিখ্যাত কিতাব ও কিতাবের বাহকদের কথা অকৃপণভাবে তার বিভিন্ন অধ্যায়ে বর্ণনা করেছে। এই ইতিহাস বড় মধুর বড় শিক্ষণীয়। আজ হযরত দাউদ (আঃ) ও তার ওপর অবতীর্ণ যাবুর সম্পর্কে একটু আলোচনা। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ৯টি সূরাতে হযরত দাউদ নবী (আঃ)-এর বর্ণনা পাওয়া যায়। তন্মধ্যে ১৬টি স্থানে তাঁর নাম উল্লেখ রয়েছে। কোন কোন সূরায় সংক্ষিপ্ত আর কোন কোন সূরায় বিস্তারিতভাবে তাঁর অবস্থার বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত দাউদের (আঃ) বীরত্ব, সাহসিকতা এবং যুদ্ধ কৌশলের এক হৃদয়গ্রাহী ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে। তিনি দুর্ধর্ষ ফিলিস্তিনী নেতা জালুতকে হত্যা করে বনী ইসরাঈলদেরকে এক ভয়াবহ বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন এবং তা দ্বারা তিনি ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছিলেন।
দাউদ (আঃ) ছিলেন বনী ইসরাঈলের মহাপরাক্রান্ত সম্রাট ও আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ-ধন্য মহান পয়গাম্বর। তাঁর আগমনের পূর্বে ইসরাঈল জাতির শাসন ক্ষমতা ছিল এক গোত্রের হাতে এবং ধর্মকর্ম ছিল অন্য গোত্রের ওপর ন্যস্ত। আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদকে (আঃ) উভয় দায়িত্ব প্রদানপূর্বক সে-জাতির কাছে প্রেরণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে নবী, রাসূল ও বনী ইসরাঈলদের বাদশাহ। সূরা বাকারায় বর্ণিত হয়েছে: ‘আল্লাহ তায়ালা তাকে বাদশাহী ও নবুওয়াত প্রদান করেছেন এবং তাঁকে যা ইচ্ছা শিক্ষা দিয়েছেন।’
এ মহান পয়গাম্বর ইয়াহুদা বিন হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর বংশধর। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন বিখ্যাত নবী ইবরাহীম (আঃ)। পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে মাত্র ৫ মাইল দক্ষিণে বায়তুল লাহামে তাঁর জন্ম।-(তাওরাত)। তারা ছিলেন ৮ ভাই। দাউদ ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। পিতার নাম ছিল ঈসাস।
তাওরাতে এও বলা হয়েছে যে, সামুয়েল নবী ইঙ্গিত পেয়েছিলেন যে, সম্রাট তালুতের পর দাউদ নামের একজন লোক বাদশাহ হবেন। সুতরাং তিনি বায়তুল লাহামে গেলেন। ঈসাসের সমস্ত পুত্রদেরকে তিনি দেখলেন। দাউদ ঐ সময় ভেড়া চরাতে গিয়েছিলেন। তাঁকে বিশেষভাবে ডাকা হলো। যেহেতু আল্লাহর দেয়া খোশখবরী মতে তিনি হবেন একজন মহান বাদশাহ। সহীফায়ে সামুয়েলে লিপিবদ্ধ আছে যে, হযরত দাউদের শরীরের রং লালাভ এবং তিনি ছিলেন অত্যধিক সুন্দর ও আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী। (১৬/১-১৩)
ভাগ্যক্রমে একসময় সম্রাট তালুতের এমন একজন লোকের প্রয়োজন হলো যিনি বাঁশি বাজাতে খুব পটু। তার কর্মচারীরা বহু খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে এ ক্ষেত্রে একজন বিস্ময়কর প্রতিভা হিসেবে বায়তুল লাহামের ঈসাসের পুত্র দাউদের সন্ধান দিল। এ সাথে তারা তাঁর অন্যান্য গাম্ভীর্যপূর্ণ আচরণ ও বীরত্বেরও সংবাদ দেয়।
দাউদ (আঃ) এবার তালুতের স্নেহভাজন হবার গৌরব অর্জন করলেন। রাজদরবারেই তিনি থাকতেন। শুধু মাঝেমধ্যে এসে পিতাকে ভেড়া চরানোর কাজে সহযোগিতা করতেন। সম্ভবত ওই সময়েই হযরত দাউদ (আঃ) স্বীয় ভেড়ার পালকে হিংস্র প্রাণী থেকে হিফাজতের জন্য তীর ধনুক চালনা শিক্ষা করেন এবং তাতে খুবই পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি একটি বাঘ ও চিতাকে মেরে ফেলেছিলাম।
একপর্যায়ে বনী ইসরাঈল ও পলেস্টীয়দের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধল। এ এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। বাদশাহ তালুত সৈন্যদল নিয়ে পলেস্টীয়দের মোকাবেলায় বের হলেন। পথিমধ্যে একটি গভীর নদী। প্রখর রোদের সময় ক্ষুধাতৃষ্ণাকাতর সৈন্যদলকে তালুত বাধ্যতা ও কষ্টসহিষ্ণুতার পরীক্ষা করার জন্য বললেন, যারা এ নদীর পানি পান করবে তারা আমাদের সঙ্গী হতে পারবে না, কিন্তু যারা পান না করবে তারাই আমার সঙ্গে জিহাদে যোগদানের সুযোগ পাবে। এ’টা তিনি এ জন্য করেছিলেন যে, জালুতের ছিল বিশাল সৈন্যবাহিনী। আর এ বাহিনীকে পরাজিত করতে হলে প্রয়োজন ছিল ঈমানের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সৈন্যদল। অবশ্য, ফলাফল তাই হয়েছিল। জালুত ও তার বিশাল বাহিনী পরাজিত হয়। (দ্রঃ আল-কুরআন : বাকারা ২৫০, ২৫১)।
বুখারী শরীফে ‘কিতাবুত তিজারাহ’ অধ্যায়ে হযরত দাউদ সম্পর্কিত একখানা হাদীস বর্ণিত আছে। রাসুলুলাহ (স) ইরশাদ করেছেন: ‘মানুষের জন্য উত্তম জীবিকা হলো তা যা সে নিজ হাতে কষ্টের মাধ্যমে অর্জন করে। আর নিঃসন্দেহে দাউদ নবী নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন।’
হযরত দাউদ (আঃ) বিশাল সাম্রাজ্যের সম্র্রাট হওয়াতে ধন-ঐশ্বর্য তাঁর কম ছিল না। কিন্তু তিনি হুকুমতকে আল্লাহর আমানত বলে জানতেন এবং তা তিনি প্রজাদের কল্যাণেই শুধু ব্যয় করতেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তিনি অর্থগ্রহণ করা সমীচীন মনে করতেন না। তিনি সর্বদা খোদা তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করতেন: হে আল্লাহ! এমন একটা উপায় আমার জন্য বের করে দাও যে, আমি নিজ হাতে যেন উপার্জন করতে পারি। আল্লাহ পাক তাঁর দোয়া কবুল করেছেন এবং তাঁকে লোহা দ্বারা বর্ম বানানোর কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন।