কাজিরবাজার ডেস্ক :
পবিত্র মাহে রমজানের আজ ১৩তম দিবস। আজ আমরা এখানে একজন পথিকৃৎ মহীয়সী মহিলার সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত অনুধাবন করব। তিনি হলেন উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়শা (রা.)। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর প্রিয়তম সহধর্মিণী। নবীজীর কথা কর্ম ও আদর্শের নিকটতম সাক্ষী এ মহীয়সী মহিলা। মহানবীর তিরোধানের পর ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য জীবন্ত কিংবদন্তি ছিলেন হযরত আয়শা (রা.)। সাহাবি পরবর্তী যুগের প্রখ্যাত তাবেঈ আতা ইবনে আবি রাবাহ (রহ.) বলেন, হযরত আয়শা ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকিহ বা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ, সবচেয়ে জানা ব্যক্তি এবং আমজনতার মধ্যে সুন্দর মতামতের অধিকারিণী (আল মুসতাদরিক)। হযরত আয়শা নিজে বলতেন, আমি গর্বের জন্য নয়, বরং বাস্তব কথাই বলছি। আর তা হলো, আল্লাহ তায়ালা আমাকে এমন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা আর কাউকে দান করেননি। যেমন, ফেরেশতা রাসূলুল্লাহকে স্বপ্নের মধ্যে আমার ছবি দেখিয়েছেন, আমার সাত বছরের বয়সে রাসূল আমাকে বিয়ে করেছেন, নয় বছর বয়সে আমি স্বামী গৃহে গমন করেছি, আমার নির্দোষিতা ঘোষণা করে কুরআন শরিফের আয়াত নাযিল হয়েছে, জিবরাঈল ফেরেশতাকে আমি স্বচক্ষে দেখেছি, আমারই কক্ষে নবীজীর কাছে ওহী নাযিল হয়েছে এবং তার কবর স্থাপিত হয়েছে ইত্যাদি। হযরত রাসূলে কারিম (স.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা জ্ঞানের অর্ধেকই আয়শা হুমায়রা থেকে গ্রহণ কর।’ মহানবী যে প্রিয়তমা স্ত্রী সম্পর্কে উম্মতদেরকে জ্ঞান আহরনের এত উচ্চ তাগিদ দিয়েছেন আজ আমরা তার থেকে জ্ঞানের ফায়দা হাসিল তো দূরের কথা, তার সম্পর্কেও অনেক নারী পুরুষের মোটামুটি ধারণা কম রয়েছে। হিজরী সনের শাওয়াল মাস। হযরত আয়শার সঙ্গে মহানবীর পবিত্র শাদী মোবারক সংঘটিত হয়েছিল।
হযরত আয়শা (রা.) যখন পিতৃগৃহ থেকে বউ হয়ে যে ঘরে এসে ওঠেন তা কোন আলিশান অট্টালিকা ছিল না। মদিনার বনু নাজ্জার মহল্লার মসজিদে নববীর চার পাশে ছোট্ট ছোট্ট কিছু কাঁচা ঘর ছিল, তারই একটিতে তিনি এসে ওঠেন। ঘরটি ছিল মসজিদের পূর্বে। তার একটি দরজা ছিল পশ্চিম দিকে মসজিদের ভেতরে। ফলে মসজিদ ঘরের আঙ্গিনায় পরিণত হয়। হযরত রাসূলে কারিম (সা.) সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেন । তিনি যখন মসজিদে ইতিকাফ করতেন, মাথাটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেন আর আয়শা (রা.) চুলে চিরুনি করে দিতেন। (বুখারি ঃ আল ইতিকাফ)।
ঘরটির প্রশস্ত ছিল ছয় হাতেরও বেশি। দেয়াল ছিল মাটির । খেজুর পাতা ও ডালের ছাদ ছিল । এতটুকু উঁচু ছিল যে একজন মানুষ দাঁড়ালে তার হাতে ছাদের নাগাল পাওয়া যেত। এক পাল্লার একটি দরজা ছিল; কিন্তু তা কখনও বন্ধ করার প্রয়োজন পড়েনি । (বুখারি ঃ বাবুন নিসা; তাবাকাত -৮/৭১)। পর্দার জন্য দরজায় একটি কম্বল ঝুলানো থাকত।
ঘরে আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল একটি খাট, একটি চাটাই, একটি বিছানা, একটি বালিশ, খোরমা খেজুর রাখার দুটি মটকা, পানির একটি পাত্র এবং পান করার একটি পেয়ালা। এর বেশি কিছু নয় । বিভিন্ন হাদিসে একাধিক স্থানে এই সব জিনিসের নাম এসেছে। যে ঘরটি ছিল দুনিয়া ও আখিরাতের সকল আলোর উৎস, সেই ঘরের বাসিন্দাদের রাতের বেলা একটি বাতি জ্বালানোর সামর্থ ছিল না। আয়শা (রা.) বলেন- একাধারে প্রায় চল্লিশ রাত চলে যেত ঘরে কোন বাতি জ্বলতো না।
হযরত আয়শার দ্বীনদারী ও স্বামীভক্তি ছিল অতুলনীয়। আল্লাহর ওয়াস্তে তার আমল ছিল অতি উচ্চাঙ্গের। একবার আরাফাতের দিন আয়শা (রা.) রোজা রাখলেন। প্রচন্ড গরমের কারণে মাথায় পানির ছিটা দিচ্ছিলেন। একজন রোজা ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেন- আমি রাসূলুল্লাহ (স.) এর নিকট শুনেছি যে, আরাফাতের দিন রোজা রাখলে সারা বছরের পাপ মোচন হয়ে যায়, তখন তা কীভাবে ভাঙ্গতে পারি? (মুসনাদ ৬/ ১২৮)। অত্যন্ত কঠোরভাবে হজের পাবন্দ ছিলেন তিনি। এমন বছর খুব কমই যেত, যাতে তিনি হজ্ব আদায় করতেন না।
রাসূলুল্লাহ (স) কে চাশতের নামাজ পড়তে দেখে সারা জীবন তিনি এই নামাজ পড়েছেন। তিনি বলতেন আমার পিতাও যদি কবর থেকে উঠে এসে আমাকে এ নামাজ পড়তে নিষেধ করেন, আমি তার কথা মানবো না। (মুসনাদ ৬/১৩৮)। একবার এক মহিলা আয়শা (রা.) কে জিজ্ঞেস করল- মেহেন্দী লাগানো কেমন? জবাব দিলেন: আমার প্রিয়তমের মেহেন্দীর রং খুব পছন্দ ছিল, তবে গন্ধ পছন্দ ছিল না। হারাম নয়। ইচ্ছে হলে তুমি লাগাতে পার। এভাবেই আমাদেও দৈনন্দিন আচরণে হযরত আয়শার (স.) স্মৃতিচারণ, বাণী, আমল খুব বেশি করে সম্পৃক্ত। এটা নারী পুরুষ উভয়ের বেলায়। তার আচরণের কারণে মহিলারা অসুস্থতা কিংবা অপারগতার সময় হজ্বের ইহরাম পড়তে পারছেন মক্কা শরিফের অদূরে তানঈম নামক স্থান থেকে। যে এলাকাটি আজ তারই স্মৃতি বহন করছে মসজিদে আয়শা বা ওমরা মসজিদ নামে।
আমাদের নবীজী সারাজীবন মাহে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ থাকতেন। ইন্তেকালের বছরে রমজানের শেষ ২০ দিনেই ইতিকাফে সময় কাটান। তার এ পবিত্র সুন্নাহ তার ওফাতের পর সমাজে ধারণ করেছিলেন তার পুণ্যাত্মা স্ত্রীগণ। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে হযরত আয়শার আমল ও কর্ম ছিল উম্মাহর জন্য সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণাদায়ক। কোন কোন বর্ণনায় হিজরী ৫৮ সনের ১৩ রমজান মহীয়সী মা আয়েশা ওফাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।