মাহফুয আহমদ
রমজান কোরআন নাজিলের মাস। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘রমজান মাস হলো সেই মাস, যে মাসে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজা রাখবে।’ (সূরা আল বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
সুতরাং কোরআনের সঙ্গে এই মাসের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। স্বয়ং নবীজী (সা.)-এর নিয়মে পরিণত হয়েছিল যে পুরো বছর কোরআনের যে অংশগুলো নাজিল হতো; তিনি সবটুকু জিবরাইল (আ.)-কে পুনর্বার পড়ে শোনাতেন এবং জিবরাইল (আ.)ও তাঁকে পড়ে শোনাতেন। যে বছর নবীজী ইন্তেকাল করেন, সে বছর একে অন্যকে দুবার পড়ে শুনিয়েছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৬২৩, সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৪৫০)
তাই এই মোবারক মাসে সলফে সালেহিন তথা পুণ্যবান লোকেরা রোজা রাখার মহান হুকুম পালনের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য নফল ইবাদতের মধ্যে কোরআন তিলাওয়াতকে বেশি গুরুত্ব দিতেন।
রমজানের পুরো মাস পবিত্র কোরআনের জন্য ওয়াকফ করে দিতেন। তাঁদের কেউ কেউ সাধ্যানুযায়ী অধিকবার কোরআন খতমের প্রতি মনোনিবেশ করতেন আর কারো কারো মনোযোগ থাকত কোরআনের গভীরে গিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নিগূঢ় তথ্য ও রহস্যগুলো উদ্ঘাটন করা, কোরআনের মণিমুক্তাগুলো সংগ্রহ করার প্রতি। তাঁদের জীবনের এসব দিক আমাদের সামনে এলে, আমরাও এমনটা করতে অনুপ্রাণিত হতে পারি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এরা এমন ছিল, যাদের আল্লাহ পথ প্রদর্শন করেছিলেন। অতএব, তুমিও তাদের পথ অনুসরণ করো।’ (সূরা : আনআম, আয়াত : ৯০)
কারো মনে সংশয় জাগতে পারে যে এত কম সময়ে দ্রুত কোরআন খতমের কারণ ও বৈধতা কী? মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনে রাজাব হাম্বলি (রহ.) বলেন, তিন দিনের কম সময়ে কোরআন খতম করতে হাদিসে যে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, তা সব সময় এমনটা করার বেলায় প্রযোজ্য। কিন্তু ফজিলতপূর্ণ সময় যেমন রমজান, বিশেষত রমজানের রাত্রি; যেখানে কদরের রাত অনুসন্ধান করা হয় অথবা ফজিলতপূর্ণ স্থান যেমন মক্কা, বিশেষত তাদের জন্য যারা বাইরে থেকে মক্কায় প্রবেশ করে। এসব ক্ষেত্রে অধিক হারে কোরআন তেলাওয়াত করা মুস্তাহাব। ইমাম আহমাদ ও ইসহাক প্রমুখ ইমামের মন্তব্য ও অন্যান্য আলিমের কর্মপন্থা এর সমর্থন করে। (লাতায়িফুল মাআরিফ, ইবনে রাজাব, ১৭১)
রমজানে দুই রাতে কোরআন খতম : আসওয়াদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে কায়স আবু আমর আন নাখায়ি। ইমাম ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। ইবরাহিম নাখায়ি (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আসওয়াদ রমজানের প্রতি দুই রাতে কোরআন খতম করতেন। তিনি মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে নিদ্রা যেতেন। আর রমজান ছাড়া অন্য মাসে তিনি প্রতি ছয় রাতে কোরআন খতম করতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, জাহাবি, ৪/৫১)
মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে কোরআন খতম : সাঈদ ইবনে জুবাইর ইবনে হিশাম একজন প্রথিতযশা আলিম। তাঁর সম্পর্কে হাসান ইবনে সালিহ বর্ণনা করেন, ইবনে হিশাম রমজান মাসে মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে কোরআন খতম করতেন। অবশ্য তখনকার যুগে লোকেরা এশার নামাজ বিলম্ব করে আদায় করত। (প্রাগুক্ত, ৪/৩২৪)
এক দিন ও এক রাতে তিন খতম : আবুল হুসাইন ইবনে হুবাইশ একদা আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সাহল ইবনে আতার আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, প্রত্যহ তাঁর এক খতম হতো। আর রমজানে প্রতি এক দিন ও এক রাতে তিন খতম হতো। শেষ বয়সে কোরআনের নিগূঢ় রহস্য এবং সূক্ষ্ম জ্ঞান আবিষ্কার করার মানসে এক খতম শুরু করেছিলেন। ১০ বছর পর্যন্ত পড়েছেন। তবে খতম হওয়ার আগেই তিনি এ পৃথিবী ত্যাগ করেন। (আল মুনতাজাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম, ইবনুল জাওজি : ৬/১৬০)
তিন দিনে এক খতম : আবু আওয়ানা বর্ণনা করেন, আমি কাতাদা ইবনে দিআমা (রহ.)-কে রমজানে কোরআনে কারিমের দারস দিতে দেখেছি। সালাম ইবনে আবি মুতি (রহ.) বলেন, কাতাদা প্রতি সাত দিন অন্তর কোরআন খতম করতেন। রমজান এলে প্রতি তিন দিনে এক খতম করতেন। আর রমজানের শেষ দশকে তিনি কোরআন খতম করতেন প্রতি রাতে। (প্রাগুক্ত : ৫/২৭৬)
রমজানে ৯০ খতম : মুহাম্মাদ ইবনে জুহাইর ইবনে কুমাইর বলেন, আমার আব্বাজান রমজান মাসে কোরআন খতম হওয়ার সময় আমাদের সবাইকে একত্র করতেন। তিনি প্রতি রাত-দিনে তিন খতম, এভাবে পুরো মাসে ৯০ বার কোরআনে কারিম খতম করতেন। (আল মুনতাজাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম, ইবনুল জাওজি : ৫/৪)
সাত দিনে কোরআন খতম : ইবনে আবি শায়বা (রহ.) সূত্রে বর্ণিত, আবু মিজলাজ (রহ.) রমজানে মহল্লার মসজিদে ইমামতি করতেন। তিনি সাত দিনে কোরআনে কারিম খতম করতেন। (আস সিকাত, ইবনে হিব্বান : ৫/৫১৮)
রমজানে ৬০ খতম : ইয়াহইয়া ইবনে নাসর বলেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) অনেক সময় রমজান মাসে কোরআনে কারিম ৬০ বার খতম করতেন। (তারিখে বাগদাদ, খতিব বাগদাদি : ১৩/৩৫৭)
আবু বকর ইবনুল হাদ্দাদ (রহ.) বলেন, আমি এ কথা শুনে আশ্চর্য বোধ করলাম আবার মুগ্ধও হলাম যে ইমাম শাফিয়ি (রহ.) রমজানে নামাজের ভেতরের তিলাওয়াত ছাড়াও ৬০ বার কোরআন খতম করতেন। আমিও চেষ্টা করেছিলাম। তবে সর্বোচ্চ ৫৯ বার খতম করতে সক্ষম হয়েছি। আর রমজান ছাড়া অন্য মাসে ৩০ খতম করেছি।
প্রত্যহ এক খতম : ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আল বুখারি (রহ.) রমজানে প্রত্যহ দিনের বেলায় এক খতম করতেন এবং তারাবির পর (তাহাজ্জুদ) সালাতে প্রতি তিন রাতে এক খতম তিলাওয়াত করতেন। (তারিখে বাগদাদ, খতিব বাগদাদি, ২/১২; তাবাকাতুস সুবকি, ২/২২৩; হাদয়ুস সারি মুকাদ্দামাতু ফাতহিল বারি; ইবনে হাজার, পৃষ্ঠা ৪৮২)
৩৩ খতম : খলিফা মামুন রমজানে ৩৩ বার কোরআনে কারিম তিলাওয়াত করে খতম করতেন। (তারিখে বাগদাদ : ১০/১৯০)
রমজানে প্রতি রাতে কোরআন খতম : উবাইদা ইবনে হুমাইদ মানসুর থেকে, তিনি মুজাহিদ (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আলী ইবনে আবদুল্লাহ আল আজদি (রহ.) রমজানে প্রতি রাতে কোরআন খতম করতেন। (তারিখে বাগদাদ : ৫/১৬৪)
সারা দিনে এক আয়াত : অন্যদিকে এমনও বহু তথ্য পাওয়া যায় যে মনীষীরা কোরআনের অর্থ ও মর্ম নিয়ে চিন্তা ও গবেষণাকর্মে রমজান কাটিয়েছেন।
উদাহরণস্বরূপ বিগত শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ হাদিসবিশারদ আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরি (রহ.)-এর কথা উল্লেখ করা যায়। তাঁর সুযোগ্য ছাত্র আল্লামা ইউসুফ বানুরি (রহ.) বলেন, রমজানে কখনো কখনো এমন হতো যে হযরত কাশ্মীরি (রহ.) সকালে কোরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করতে শুরু করেছেন এবং বিকাল পর্যন্ত একই আয়াত পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন। লক্ষ্য ছিল, ওই আয়াত নিয়ে গবেষণা এবং আয়াত থেকে শিক্ষা ও সূক্ষ্মতর তথ্য উদ্ঘাটন। তাঁর ওই সব গবেষণার একটি লিখিত রূপ হলো তাঁর লেখা ‘মুশকিলাতুল কোরআন’ গ্রন্থটি।