অমুসলিমের নিরাপত্তা : আইনী ও ইসলামী দৃষ্টিকোণ

13

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :

(পূর্ব প্রকাশের পর)
পরিশেষে নবী করীম (সা:) এর আরো দুটি হাদীসের উল্লেখ করা যেতে পারে। আল-মাওয়ারদী থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সা:) মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় বলেছেন, আমার তরফ থেকে অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছে, নিষ্ঠার সঙ্গে তা প্রতিপালন কর। তিনি আরো বলেছেন যে, কোন অমুসলিমের উপর যে নির্যাতন চালাবে, মেষ বিচার দবিসে সে আমাকে নির্যাতিতের পক্ষে সুপারিশকারী হিসাবে দেখতে পাবে (আবু দাউদ)। নবী করীম (সা:) আমাদের জন্য যে নির্দেশ রেখে গেছেন, নিজের জীবনে পরবর্তীকালের মুসলমানগণ এগুলোকেই আইন হিসাবে বিন্যস্ত করেছেন এবং বাস্তব জীবনে অনুসরণ করেছেন নিষ্ঠার সাথে। এখানে তার কিছু উদাহরণ উপস্থাপন করা হলো :
একবার মহান খরীফা হযরত উমর (রা:) সিরিয়ার গভর্ণরকে রাজস্বের হিসাব সংরক্ষণের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ একজন গ্রীক অধিবাসীকে মদীনায় পাঠানোর নির্দেশ প্রযোজ্য। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার-উপযোগী একটি বিখ্যাত আইন গ্রন্থের নাম হিদায়া। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যে কোন প্রকার নিন্দা বা অপবাধ সেটা মুসলমান অথবা জিম্মী (অমুসলিম) যারা বিরুদ্ধেই হোক না কেন, তা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। ‘বাহর আর রায়ক’ নামক আইন গ্রন্থে আরো উল্লেখ আছে যে, একজন মৃত মুসলমানের দেহাবশেষ যেভাবে সম্মান করতে হয় তেমনি সম্মান করতে হয় একজন অমুসলিম (জিম্মী)-এর মৃতের দেহাবশেষকে। তাকে কোনভাবেই অপবিত্র করা যাবে না। কারণ কোন অমুসলিমকে যদি জীবদ্দশায় নিরাপত্তা দেওয়া হয়, হিফাজত করা হয় অন্যায় অপবাদ থেকে তাহলে তার মৃত্যুর পর সকল প্রকার অপবাদ অপবিত্রতা থেকে রক্সা করাটাও বাধ্যতামূলক। ফকীহগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যেমন শাস্তি সে পেত একজন মুসলিম রমনীর অমর্যাদা করলে। এ ব্যাপারে ইসলামী আইনবিদগণের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই।
খলীফা হযরত উমর (রা:)-এর আমলের ঘটনা। কিছুসংখ্যক মুসলমান একজন ইয়াহুদীর জমিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। খলীফা উমর (রা:)-এর কাছে এ সংবাদ পৌঁছে, তখন তিনি মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলার এবং উক্ত জমিখন্ড ইয়াহুদী মালিককে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে লেবাননের খৃষ্টান শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কারদাহী লিখেছেন : বায়তুল ইয়াহদীর সেই বাড়িটি এখনও বিদ্যামান রয়েছে (প্রাইভেট ইন্টারন্যাশনাল ল অফ ইসলাম, লেকচার সিরিজ, দি হেগ, ১৯৩৩)। দামেশকের প্রধান মসজিদ সম্পর্কেও অনুরূপ একটি মশহুর কাহিনী রয়েছে। ইবনে কাছীর এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকের বর্ণনায় বিষয়টি স্থান পেয়েছে ঘটনাটি এ রকম- একজন উমাইয়া খলীফা একটি মসজিদ সম্প্রসারণের সুবিধার্থে পার্শ্ববর্তী একটি চার্চ দখল করেন। পরবর্তীতে এ অভিযোগটি খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীযের নিকট উপস্থাপন করা হয়। তৎক্ষণাৎ তিনি এ মর্মে নির্দেশ জারি করেন যে, গীর্জার যে অংশে বলপূর্বক মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে, তা ভেঙ্গে ফেলতে হবে এবং উক্ত স্থান গীর্জার জন্য নির্ধারিত থাকবে। যা হোক পরবর্তীতে খৃষ্টানরা অর্থের বিনিময়ে উক্ত ভূমিখন্ডের মালিকানা প্রত্যাহার করে নেয় এবং এভাবেই উভয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এখানে হযরত উমর ইব্ন আবদুল আযীয-এর আরেকটি নির্দেশনামার উল্লেখ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে বিস্তরিত বিবরণ পাওয়া যাবে ইব্ন সা’দের ইতিহাসে গ্রন্থে। গভর্ণর আদি বিন আরতাতকে এ মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, অমুসলিমদের প্রতি নজর দাও এবং তাদের সঙ্গে বিনয় নম্র ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ যদি বার্ধক্যে পৌছে এবং নিজের বিষয় সম্পদ না থাকে, তাহলে তার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা নেওয়া তোমার দায়িত্ব। যদি তার কোন আপনজন থাকে, তবে তার কাছ থেকে ভরণ-পোষণ বাবদ অর্থ আদায় কর। যদি কেউ তার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করে তাহলে প্রতিশোধ নাও। আমি জানতে পেরেছি তুমি আমদানিকৃত মদের এক দশমাংশ আদায় কর এবং তা সরকারী কোষাগারে জমা দাও। স্মরণ রেখো যে, এই কোষাগার তোমারও নয়, আমারর নয়। এর মালিকানা আল্লাহর। আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি যে, এ জাতীয় সম্পদ-এর পরিমাণ যত সামান্যই হোক না কেন, আর কখনো তা সরকারী কোষাগারে জমা নেবে না। যদি তুমি সম্পদের পবিত্রতা সম্পর্কে নিশ্চিত হও তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এখানে উমর ইব্ন আবদুল আযীযের আরো একটি পত্রের উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। পত্রের বিষয়বস্তু এ রকম : পুরাতন নথি-পত্রগুলো পর্যালোচনা কর। অন্যায়ভাবে কর আরোপ সংক্রান্ত উত্থাপিত আপত্তি এবং অন্যায় অবিচার করলে তার সংশোধন কর এবং প্রত্যেককেই তার ন্যায্য পাওনা ভোগ করতে দাও। অত্যাচার জর্জরিত কোন লোক যদি মারা যায় তাহলে তার উত্তরাধিকারীর নিকট তার পাওনা হস্তান্তর কর। এটা সকলের জানা কথা যে, কোনকিছু ক্রয় বা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দূরের লোক অপেক্ষা প্রুতিবেশীরা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। ফকীহগণও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। এটা অমুসলিমদের ক্ষেত্রেও একটি স্বীকৃত নীতি। অমুসলিমদের এমন কতকগুলো রীতিনীতি বা প্রথা আছে যেগুলো ইসলামী আক্বীদা বা আচার-আচরণের পরিপন্থী। তদসত্ত্বেও ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিমরা এ সমস্ত রীতিনীতি বা প্রথা মেনে চলার অধিকার ভোগ করে থাকে। যেমন- মদ্যপান মুসলমানদের জন্য হারাম। অথচ অমুসলিম নাগরিকরা ইচ্ছামত মদ্যপান করতে পারে। এমনকি মদ আমদানি, উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয়ের সুযোগ পেয়ে থাকে। অনুরূপভাবে তারা জুয়া খেলতে, নিকটাত্মীয়কে বিয়ে করতে ও সুদী কারবারে লিপ্ত হতে পারে। অথচ অমুসলমানদের জন্য এসবকিছু নিষিদ্ধ বা হারাম।
ইসলামের প্রথম যামানায় অমুসলিমদের এ সমস্ত অনৈসলামিক কাজকর্ম মুসলমানদের উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারত না। এমনকি এ সমস্ত বিষয়ের প্রতি মুসলমানরা বড় একটা আমলও দিত না। তবে আধুনিক আইন বিশারদগণের মতে সুখী সমাজ ও সুন্দর বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য মদের ব্যবসা বা মদ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকলে চলবে না, সমাজের গোটা জনগোষ্ঠীর উপর এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করা আবশ্যক। এ ব্যাপারে অমুসলিম চিন্তাবিদগণও অনুরূপ ধারণা পোষণ করেন। তদানুসারে একজন খৃষ্টানকে মদীনায় পাঠনো হল এবং তাকে নিয়োগ করা হলো রাজস্ব প্রশাসনের প্রধান হিসাবে (দ্র. আল-বালাযুরী, আনসা)
এমনকি কখনো কখনো খলীফা হযরত উমর (রা:) অমুসলিমদের সঙ্গে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনেতিক, প্রশাসনিক বিষয়ে আলোচনা করতেন। ইসলামে ইমামের (মসজিদের ইমাম) পদটি মুসলমানদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। ইসলাম আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব জীবনের মধ্যে সমন্বয়ের বিধান দিয়েছে। সে কারণেই নামাজে ইমামতি করা রাষ্ট্র প্রধানের যেমন দায়িত্ব তেমনি এটা তার একটি অধিকার। এভাবে যদি বিষয়টি বিবেচনা করা হয় তাহলে কোন অমুসলিম মুসলিম দেশের রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচিত হতে পারেন না। বস্তুতপক্ষে এটা একটা ব্যতিক্রম। এর অর্থ এই নয় যে, দেশের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্মকান্ড থেকে অমুসলিম নাগরিককে বাদ দিতে হবে।
খলীফাগণের আমল থেকেই মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমরা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে, এমনকি মন্ত্রীর পদ-মর্যাদার নিয়োগ পেয়েছেন। শাফি’ঈ মযহাবের আল-মাওয়ারদী এবং হাম্বলী মযহাবের আবু ইয়া’লা আল-র্ফারা খলীফা কর্তৃক অমুসলিম নাগরিককে মন্ত্রী হিসেবে এবং নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে নিয়োগ সমর্থন করেছেন। প্রিয়নবী (সা:) নিজেই একজন অমুসলিমকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে আবিসিনিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন। বিশ্বের দরবারে যে সমস্ত দেশ ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ধারক বলে পরিচিত সে সমস্ত দেশেও এরূপ নজীর পাওয়া যাবে না।
ইসলামের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানে অমুসলিমদেরকে সামাজিক এবং বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কুরআনুল করীমে উল্লেখ আছে যে, তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি এর পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের সমর্থক ও সংস্কারকরূপে। সুতরাং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদানুসারে তুমি তাদের বিচার নিষ্পত্তি করবে এবং যে সত্য তোমার নিকট এসেছে তা ত্যাগ করে তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করবে না (৫ ঃ ৪২-৪৮)।
কুরআনুল করীমের এই নির্দেশের প্রেক্ষিতেই নবী করীম (সা:) এবং খলীফাগণ ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদের বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে স্বাধিকার প্রদান করেছিরেন। তারা স্বাধিকার ভোগ করেছিল দেওয়ানী, ফৌজদারী, ব্যক্তি আইন প্রভৃতি সকল বিষয়ে। খলীফাগণের সমসাময়িক কালে খৃষ্টানদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, মুসলিম শাসনামলে খৃষ্টান যাজকদের বিচারের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার-উপযোগী একটি বিখ্যাত আইন গ্রন্থের নাম হিদায়া। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যে কোন প্রকার নিন্দা বা অপবাদ সেটা মুসলমান অথবা জিম্মী (অমুসলিম) যার বিরুদ্ধেই হোক না কেন, তা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। ‘বাহর আর রায়ক’ নামক আইন গ্রন্থে আরো উল্লেখ আছে যে, একজন মৃত মুসলমানের দেহাবশেষ যেভাবে সম্মান করতে হয় তেমনি সম্মান করতে হয় একজন অমুসলিম (জিম্মী)-এর মৃতের দেহাবশেষকে। তাকে কোনভাবেই অপবিত্র করা যাবে না। কারণ কোন অমুসলিমকে যদি জীবদ্দশায় নিরাপত্তা দেওয়া হয়, হিফাজত করা হয় অন্যায় অপবাদ থেকে তাহলে তার মৃত্যুর পর সকল প্রকার অপবাদ অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করাটাও বাধ্যতামূলক। ফকীহগণ ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন যে, একজন মুসলিম কোন অমুসলিম রমনীর অমর্যাদা করলে সে তেমন শাস্তি পাবে যেমন শাস্তি সে পেতো একজন মুসলিম রমনীর অমর্যাদা করলে। এ ব্যাপারে ইসলামী আইনবিদগণের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই।
খলীফা হযরত উমর (রা:)-এর আমলের ঘটনা। কিছুসংখ্যক মুসলমান একজন ইয়াহুদীর জমিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। খলীফা উমর (রা:)-এর কাছে এ সংবাদ পৌছে, তখন তিনি মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলার এবং উক্ত জমি খন্ড ইয়াহুদী মালিককে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দে লেবাননের খৃষ্টান শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কারদাহী লিখেছেন ঃ বায়তুল ইয়াহুদীর সেই বাড়িটি এখনও বিদ্যমান রয়েছে (প্রাইভেট ইন্টারন্যাশনাল ল অফ ইসলাম, লেকচার সিরিজ, দি হেগ, ১৯৩৩) দামেশকের প্রধান মসজিদ সম্পর্কেও অনুরূপ একটি মশহুর কাহিনী রয়েছে। ইবনে কাছীর এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকের বর্ণনায় বিষয়টি স্থান পেয়েছে। ঘটনাটি এ রকম- একজন উমাইয়া খলীফা একটি মসজিদ সম্প্রসারণের সুবিধার্থে পার্শ্ববর্তী একটি চার্চ দখল করেন। পরবর্তীতে এ অভিযোগটি খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীযের নিকট উপস্থাপন করা হয়। তৎক্ষণাৎ তিনি এ মর্মে নির্দেশ জারি করেন যে, গীর্জার যে অংশে বলপূর্বক মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে তা ভেঙ্গে ফেলতে হবে এবং উক্ত স্থান গীর্জার জন্য নির্ধারিত থাকবে। যা হোক পরবর্তীতে খৃষ্টানরা অর্থের বিনিময়ে উক্ত ভূমিখন্ডের মালিকানা প্রত্যাহার করে নেয়। এবং এভাবেই উভয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে হযরত উমর ইব্ন আব্দুল আযীয-এর আরেকটি নির্দেশনামার উল্লেখ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাবে ইবন সা’দের ইতিহাস গ্রন্থে। গভর্ণর আদি বিন আরতাতকে এ মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, অমুসলিমদের প্রতি নজর দাও এবং তাদের সঙ্গে বিনয় নম্র ব্যবহার কর। তবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার-আচরণের ক্ষেত্রে যে বিভিন্নতা রয়েছে মুসলিম আইনবিদগণ সে সব বিষয়ে কোন রকম হস্তক্ষেপ করেন না।
ইসলাম অমুসলিম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একটি পার্থক্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। মুসলমানদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কেও রয়েছে বিভিন্নতা। এদের মধ্যে একটি হল আহলে কিতাবী অন্যটি কিতাব বহির্ভূত জনগোষ্ঠী। যারা আহলে কিতাবী তারা এক আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখে এবং তাদের নবীর উপর যে বিধি-বিধান নাযিল হয়েছে তা মেনে চলে। ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা আহলে কিতাবীদের অন্তর্ভূক্ত। অন্য দলটি এর ঠিক উল্টো। এদের কোন আসমানী কিতাব নেই। অথবা এরা এক আল্লাহর উপর ঈমানে রাখে না। এদের মদ্যে রয়েছে পুতুকল পূজারী ও নাস্তিক শ্রেণীর লোকেরা। অবশ্য সকল সম্প্রদায়ের লোকই ইসলামী রাষ্ট্রে স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বসবাস করবে, জীবনের নিরাপত্তা পাবে এবং মতামত প্রকাশেরও সুযোগ থাকবে। তবু ব্যক্তিজীবনে একজন মুসলমানের সঙ্গে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারতম্য থাকবে। যেমন একজন মুসলমান আহলে কিতাবী মহিলাকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু আহলে কিতাবী নয় এমন মহিলাকে সে বিয়ে করতে পারে না। তাছাড়া মুসলমানের স্ত্রী হয়েও একজন ইয়াহুদী বা খৃষ্টান মহিলা তার নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে চলতে পারে। গীর্জা বা নিজস্ব উপাসনালয়ে যেতে পারে, এমনকি পানীয় পান করতে পারে। কিন্তু একজন মুসলিম মহিলা কখনো অমুসলিম এমনকি আহলে কিতাবীর স্ত্রী হতে পারে না (৬০ ঃ ১০)। আবার একজন মুসলমান আহলে কিতাবী নয় এমন কোন লোকের জবাই করা পশুর গোশত খেতে পারে না। ইসলাম একজন অমুসলিমকে স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম করার অধিকার দিয়েছে। নিষিদ্ধ করেছে জোর করে কাউকে ইসলামে দীক্ষিত করবার উদ্যোগকে। পক্ষান্তরে ইসলাম মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত কঠোর শৃঙ্খলা সংরক্ষণ করে।
ইসলামে জাতীয়তার মূল ভিত্তি হচ্ছে দীন বা ধর্ম। ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা আঞ্চলিকতার প্রশ্নটি এখানে একেবারেই গৌণ। আর সে কারণেই স্বধর্মত্যাগ স্বাভাবিকভাবেই রাজদ্রোহ বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে বিবেচিত হয়। এজন্য ইসলামে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় এই যে, ইসলামের ইতিহাসে জাতীয় রাজদ্রোহের ঘটনা খুবই বিরল। এবং শাস্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তাও বড় একটা দেখা যায়নি। এমন একটা সময় ছিল যখন প্রশান্ত অঞ্চল হতে আটালান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছিল মুসলিম রাজত্ব। বর্তমানে অবস্থার অনেক পরির্তন হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে পড়েছে। এতকিছুর পরেও মুসলিম বিশ্বের কোথাও কোন মুসলমান ধর্ম ত্যাগ করেছে এমন কথা শোনা যাবে না। উপনিবেশিক শক্তির মুসলমানদের ধর্মান্তর করার জন্য সম্ভাব্য সকল উদ্যোগের মুখেও কোনো মুসলিমের ইসলাম পরিত্যাগের খবর শোনা যায় না। বিবেকবান মানুষের জন্য এটা সত্যিকার অর্থেই বিস্ময়কর ব্যাপার। বরং বর্তমান সময়ে পাশ্চাত্য জগতেও ইসলাম যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছে। ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ইটালী, কানাডা থেকে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ থেকে শোনা যাচ্ছে ইসলামের আহ্বান। অথচ এ জন্য মুসলমানদের সুসংগঠিত কোন দাওয়াতী কার্যক্রম নেই।
মুসলমানদের গোটা জীবনটাই আসমানী বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আধ্যাত্মিক ও জাগতিক সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। কেউ যদি কেবলমাত্র লোক দেখানোর জন্য নামাজ পড়ে, আল্লাহকে খুশি করার দৃঢ়তা তার মধ্যে না থাকে, তখন তার নামায ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না। বরং এটা হবে আল্লাহ পাকের সঙ্গে নাফরমানী। এ ধরনের নামাযের জন্য শেষ বিচার দিনে তাকে শাস্তি পেতে হবে।
অপরদিকে কোন মুসলিম যদি এই উদ্দেশ্যে খাবার গ্রহণ করে যে, খাদ্য খাবার খেলে শরীরে শক্তি বাড়বে, এই শক্তি আল্লাহর হুকুম আহকাম পালনে সহায়ক হবে, তখন এই পানাহার বিবেচিত হবে ইবাদত হিসাবে। এমনকি স্বামী-স্ত্রী যদি আল্লাহর প্রতি আনুগত্য রেখে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী সংসার গড়ে তোলে তাহলে সেটাও নেক কাজ হবে। সকল প্রকার যুদ্ধকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে ন্যায়সঙ্গত কারণে যে যুদ্ধের আয়োজন করা হয়, যে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রিত হয় ইসলামী বিধি-বিধান দ্বারা, কেবলমাত্র সে যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ বলা হয়।
নবী করিম (সা:) এর জীবনী পাঠ করলে তিন ধরনের যুদ্ধ সম্পর্কে জানা যায়। যেমন- প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ, শাস্তি প্রদানের জন্য যুদ্ধ এবং প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ। এক তথ্যে জানা যায়, রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে একজন মুসলিম দূতকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ব্যাপারে রোমান সম্রাট হিরাকিলিয়াসের সঙ্গে নবী করীম (সা:)-এর এক ঐতিহাসিক পত্র যোগাযোগ হয়। পত্রে তিনি সম্রাটকে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব দেন। প্রথমত: কলেমা পড়ে ইসলামের পতাকা তলে শামিল হও। দ্বিতীয়ত: ইসলাম গ্রহণ না করলে ‘জিযিয়া’ প্রদান কর। তৃতীয়ত: অন্যথায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। (আবু উবায়দ, কিতাবুল আওয়াল, পৃ: ৫৫)
প্রত্যেক মানুষেরই বিবেকের রায় অনুসারে চলার স্বাধীনতা রয়েছে। এ অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল নবী করীম (সা:)-এর জিহাদের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মুসলমানদের জন্য এটাই হলো প্রকৃত জিহাদ। শোষণ করার মনোভাব নিয়ে এ যুদ্ধ করা যাবে না। মনে রাখা যাবে না নিজের স্বার্থের কথা। আল্লাহর আইন, আল্লাহর হুকুম কায়েম করাই হবে জিহাদের একমাত্র লক্ষ্য। (অসমাপ্ত)