রামাদ্বান দ্বারপ্রান্তে যা যা করণীয়

230

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

প্রকৃত মু’মিন আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও সর্বাত্মকভাবে তাঁর আনুগত্যে নিজের জীবন অতিবাহিত করে। শেষ নিঃশ্বাস অবধি এ ধারা অব্যাহত রাখে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন: (হে নবী) ইয়াক্বীন (মৃতু) আসা পর্যন্ত আল্লাহর বন্দেগীতে অব্যাহত থাকুন। এছাড়াও আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বিশেষ বিশেষ কিছু সময় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ করে দান করেছেন, যাতে করে সে সময়গুলোতে একটু অতিরিক্ত নেক আমল করে আমাদের ছওয়াবের পরিমাণকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারি। নেকী অর্জনের এমনি ধরনের এক গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম হচ্ছে রামাদ্বানুল মোবারক। এ গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমটি পদার্পণ করছে আমাদের দারপ্রান্তে। মহা সম্মানিত এ মেহমানকে স্বাগত জানাতে আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। প্রিয় নবী (সাঃ) প্রায় দু’মাস পূর্ব থেকে এ মেহমানকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিতেন। রজব মাস এলেই তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকতেন: “হে আল্লাহ আমাদেরকে রজব ও শাবানের মধ্যে বরকত দান করুন, আর রামাদ্বান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।”-(তাবারানী)
জীবনে আরেকটি রামাদ্বান পাওয়া কতই না সৌভাগ্যের ব্যাপার। গত বছর অনেকে রামাদ্বানে আমাদের আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে রমাদ্বান রেখেছিলাম। আজ আমাদের মাঝে অনেকেই নেই। আগামী রমাদ্বান আমাদের পাওয়ার সৌভাগ্য হবে কি? এটা আল্লাহই ভালো জানেন। আর যদি আল্লাহপাকের একান্ত দয়ায় পেয়ে যাই, তাহলে তার জন্য আমরা কি প্রস্তুতি গ্রহণ করছি? প্রিয় নবী (সাঃ) একবার শাবানের শেষ প্রান্তে এসে বিশেষভাবে সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রামাদ্বানের গুরুত্ব, ফযীলত ও আমল সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিলেন :
“হে জনতা! একটি পবিত্র মাস তোমাদের দ্বারপ্রান্তে সমাগত। এমন মাস যাতে রয়েছে লাইলাতুল ক্বাদর। হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসটির দিনে রোযা রাখাকে আল্লাহ ফরয করে দিয়েছেন। আর রাতের বেলায় ইবাদত বন্দেগী করাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ নফল ইবাদতের মর্যাদা দিয়েছেন। কেউ এ মাসে যে কোন ভাল কাজ করলে তার সওয়াব হবে অন্য মাসের ফরযের সমান।আর একটি ফরয আঞ্জাম দিলে তার সওয়াব হবে অন্য মাসের ৭০টি ফরযের সওয়াব। এটি হচ্ছে সবরের মাস। আর সবরের পুরস্কার হচ্ছে জান্নাত। এটি সমবেদনার মাস। এ মাসে রিযিক বাড়িয়ে দেয়া হয়। কেউ এ মাসে রোযাদারকে ইফতার করালে তা তার গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়া ও জাহান্নাম থেকে তার গর্দান মুক্ত হওয়ার কারণ হয়ে যাবে। এবং রোযাদারের সমপরিমাণ সওয়াব হবে, তবে এতে রোজাদারের তার নিজের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের সবার যে রোযাদারকে ইফতার করানোর সক্ষমতা নেই। তিনি বললেন, এমন বিপুল সওয়াব সে ব্যক্তিকেও দান করা হবে, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে দুধ, খেজুর এমনকি শুধু পানি দিয়ে হলেও ইফতার আপ্যায়ন করাবে। যে ব্যক্তি তৃষ্ণার্ত রোজাদারকে ইফতারের সময় পানি পান করাবে, আল্লাহ তাআলা তাকে আমার হাওযে (কাওছার) থেকে এমন পানীয় পান করাবেন, যার ফলে জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত সে আর কোনদিন তৃষ্ণার্ত হবে না। কেউ যদি এ মাসে তার ক্রীতদাস (এমনকি কর্মচারী/চাকর)-এর কাজ কমিয়ে দেয় আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেবেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেবেন। এ মাসের প্রথম হচ্ছে রহমত। মধ্যখানে রয়েছে মাগফিরাত। আর শেষ দিকে রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি। এ মাসটিতে তোমরা ৪টি কাজে বেশি বেশি অভ্যস্ত হতে সচেষ্ট হও। প্রথম দুটোর মাধ্যমে তোমাদের প্রভু সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। আর শেষ দুটো না করে তোমাদের কোন উপায় নেই। যে দু’অভ্যাস দিয়ে তোমাদের প্রভুকে সন্তুষ্ট করবে তা হচ্ছে ১. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহের সাক্ষ্য দেয়া আর ২. আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার করতে থাকা। আর যে দুটো না করে তোমাদের কোন উপায় নেই তা হচ্ছে ৩. আল্লাহর কাছে জান্নাতের আবেদন করতে থাকা এবং ৪. জাহান্নাম থেকে পানাহ চাইতে থাকা। (সাহাবী সালমানের বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন বায়হাকী ও ইবনে খোযাইমা)
এমন মহান একটি মাস আমাদের দ্বারে সমাগত। এ মাসের অফুরন্ত ফায়দা নেয়ার জন্য আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দুনিয়াবী ব্যস্ততা যতদূর পারা যায় কিছু কমিয়ে দিতে হবে। নবী কারীম (সাঃ) রামাদ্বান এলে প্রাত্যহিক সাংসারিক ও দুনিয়াবী ঝামেলা কমিয়ে দিতেন, যাতে বেশি বেশি করে ইবাদত করার সুযোগ পাওয়া যায়। সলফে সালেহীনও তা-ই করেছেন। ইমাম যুহরী (রঃ) বলেছেন, “রামাদ্বান আসা মানেই হলো বেশি বেশি তেলাওয়াতে কুরআন ও অন্যকে খাওয়ানোর প্রচেষ্টা।” অনেকেই মসজিদে বসে থাকতেন আর বলতেন, রোজাকে পাহারা দেই, বাইরে গিয়ে কারো গীবত চর্চায় ব্যস্ত হওয়া থেকে। রোযা আসলে আমরাও কিছুটা প্রস্তুতি নেই। তবে, আমাদের প্রস্তুতি কিছুটা ভিন্ন ধরনের। আমাদের অনেকেই দেখা যায়, রোজার প্রারম্ভে খাদ্য সম্ভারের সমাহারে ঘর ভর্তি করে নেয়া। এমনকি দোকানপাট পর্যন্ত খালি হয়ে যায়। সারা দিনের অভুক্ত থাকার বদলা নেয়ার জন্য ইফতারে রাতের বেলায় এবং সেহরীতে দ্বিগুণ তিনগুণ উদরস্থ করার মানসিকতা। রামাদ্বান এসেছে খাওয়া কমাতে, অথচ আমাদের কেনাকাটা দেখলে মনে হয় রামাদ্বান যেন এসেছে খাবার বাড়িয়ে দিতে। আর এ সুযোগে আমাদের দেশে তো ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে গরীবের নাভিশ্বাস সৃষ্টি করে দেয়। রামাদ্বান আসে মু’মিনকে ঘুমকমিয়ে সদা তৎপর হতে সাহায্য করতে। অথচ অনেকেই দিনের অর্ধবেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে অলসভাবে কাটিয়ে দেন। মূল্যবান সময়গুলো যদি ঘুমেই কেটে যায়, তাহলে কি পাবো রামাদ্বানের নেয়ামত থেকে। তাই, আসুন আমরা পরিকল্পনা গ্রহণ করি, কিভাবে আগত রামাদ্বানের সদ্ব্যবহার করে আমাদের নেকীর পরিমাণ বাড়িয়ে নিতে পারি। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাওফিক দান করুন।
রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতের সুবাস নিয়ে বছর ঘুরে আবারো আমাদের নিকট এসেছে মাহে রামাদ্বান। বেশি বেশি করে ইবাদাত করা আর গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার আর একটা সুযোগ পেয়েছি আমরা। এরপর আর একটা সুযোগ কি আসবে আমাদের জীবনে? এমনতো হতে পারে যে এটা আমাদের জীবনের শেষ রামাদ্বান। তাহলে আসুন পরিকল্পনা গ্রহণ করি কিভাবে এবারের রামাদ্বানে সর্বোচ্চ ফায়দা অর্জন করতে পারি। অন্তরে আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার জন্য প্রথমে আবারো চোখ বুলিয়ে নেই রোজা ও রামাদ্বানের ফযীলত ও গুরুত্ব সংক্রান্ত কিছু হাদীসের উপর। রাসুলে কারিম (সাঃ) এরশাদ করেছেন, আদম সন্তান প্রতিটি ভাল কাজের প্রতিদান দশগুণ থেকে সাত শতগুণ পর্যন্ত বর্ধিত হয়। আল্লাহতাআলা বলেছেন, “তবে রোজা, সেটা তো আমার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তার প্রতিদান আমি নিজেই দিব। আমার (সন্তুষ্ট হাসিলের) উদ্দেশ্যে রোজাদার পানাহার থেকে বিরত থেকেছে… রোযাদারের মুখ থেকে নির্গত দুর্গন্ধ আল্লাহপাকের নিকট মিশকের সুগন্ধের চেয়েও প্রিয়-(বুখারী)। একমাসের সিয়াম সাধনের মত এক নাগাড়ে এত দীর্ঘ ইবাদাতের সুযোগ আমাদের জীবনে আর দ্বিতীয়টি নেই। দিনের বেলায় সিয়াম সাধনা। আর রাতের বেলায় কেয়ামুল্লাইল অর্থাৎ নামাযে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় কুরআন তেলাওয়াতের সুযোগ নিয়ে রামাদ্বান আসে বার বার আমাদের কাছে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেন “রাসূল করিম সাঃ) ইরশাদ করেছেন রোযা এবং আল কুরআন উভয়ে বান্দার জন্য কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রোযা বলবে হে প্রভু আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানো থেকে নিবৃত্ত রেখেছি। আল কুরআন বলবে হে প্রভু, আমি তাকে রাতের বেলা ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। উভয়ে বলবে, হে প্রভু তার ব্যাপারে আমাদের সুপারিশ কবুল করুন। আল্লাহপাক তাদের উভয়ের সুপারিশ কবুল করে নিবেন”-(আহমদ)। আবু সাইদ আল খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেন, “কেউ যদি আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি রোযা সম্পন্ন করে, সে একটি দিনের কারণে আল্লাহ তার চেহারা থেকে জাহান্নামে’র আগুনকে সত্তর বছর দূরে নিয়ে যান”।-(আহমদ) সহুল বিন সা’দ (রাঃ) বর্ণনা করেন, “রাসূল কারিম (সাঃ) এরশাদ করেছেন, জান্নাতে একটি বিশেষ ফটক রয়েছে, তার নাম হচ্ছে রাইয়ান। সেখানে থেকে ডাক দেয়া হবে। রোজাদারগণ কোথায়? সর্বশেষ রোযাদারের প্রবেশ সম্পন্ন হলে ফটকটি বন্ধ করে দেয়া হবে।-(বুখারী ও মুসলিম)।
আল্লাহর কাছ থেকে কতনা অবারিত সুসংবাদের সুবাস নিয়ে হাযির হয় রামাদ্বান প্রতিবার আমাদের কাছে। আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেন, একবার রামাদ্বান মাসের আগমন হলে নবীজি আমাদের লক্ষ্য করে বলেন, “বরকতময় একটি মাস তোমাদের নিকট এসে গেছে, যে মাসে সিয়াম সাধনা তোমাদের উপর ফরয করে দেয়া হয়েছে। এ মাসটিতে জান্নাতের প্রবেশ দ্বারগুলো খুলে রাখা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলোকে বন্ধ করে রাখা হয়, শয়তানগুলোকে শিকল দিয়ে বন্দি করে রাখা হয়। এ মাসে রয়েছে এমন একটি রাত যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত, সে সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত”।-(আহমদ, নাসাঈ, বায়হাকি) অন্য হাদীসে এসেছে, রামাদ্বানের আগমন ঘটার সাথে সাথে একজন ফেরেশতা ডাকতে থাকে হে সুকর্ম সন্ধানী, সুসংবাদ গ্রহণ করো। আর হে দুষ্কৃতি সন্ধানী বিরত হও। রামাদ্বান শেষ হওয়া পর্যন্ত এ ডাক চলতে থাকে-(তিরমিযী, ইব্ন্ মাজাহ, ইবন্ খোযাইমাহ)।
রামাদ্বানের উদ্দেশ্য ও তাহা হাসিলের উপায়? সিয়াম সাধনার প্রক্রিয়া, প্রবৃত্তির চাহিদা ও রিপু দমনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে আত্ম সংশোধনের সৃষ্টি হয় তা একজন মু’মিনকে মুত্তাক্কী পর্যায়ে উন্নত করে। আর এই তাক্কওয়া অর্জন সিয়াম সাধনার প্রকৃত উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলা সূরা আল বাক্কারার ১৮৩ নং আয়াতে রোজার নির্দেশ করে বলেছেন, “আশা করা যায় এর মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে তাক্কওয়া সৃষ্টি হবে”। বছরের পর বছর যদি আমরা রোজা রাখতেই থাকি কিন্তু আমাদের মধ্যে তাক্কওয়া অর্জন হয়না তাহলে রোজার মূল উদ্দেশ্য থেকে আমরা বঞ্চিতই থেকে যাব। আংশিক ছওয়াব পেলেও আমরা পুরো ছওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকবো। শুধু পানাহার আর সহবাস থেকে বিরত থাকলেই প্রকৃত রোযা হয়না। প্রকৃত রোজা হচ্ছে নিজের নফস্ ও শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় পরিচালিত করা। যাবতীয় গুনাহ বা অন্যায়ের কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, যে মিথ্যা কথা, অন্যায় কাজ ও জাহেলী তৎপরতা থেকে নিজেকে বিরত রাখেনা, আল্লাহর কোন দরকারই নেই সে শুধু খানাপিনা থেকে বিরত থাকবে। (বুখারী) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরও পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন, কিছু রোজাদার এমন রয়েছে যে ক্ষুধা আর তৃষ্ণা ছাড়া তাদের রোজার আর কিছুই নেই-(আহমদ)। এমনকি নিজে তো মিথ্যা, অন্যায় এবং এ জাতীয় গুনাহ থেকে বিরত থাকবেই, অন্য কেউও যদি তাকে অন্যায়ভাবে প্ররোচিত করে, সেখানেও তাকে আত্মসংযমের পরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে। তিনি এরশাদ করেছেন আরেকটি হাদীসে, ‘তোমাদের কেউ যেদিন রোযা রাখে সেদিন যে কোন মন্দ কথা উচ্চারণ না করে, গালমন্দ না করে, আর কেউ যদি তাকে অন্যায় কথা বলে বা গালমন্দ করে সে যেন বলে দেয় আমি রোজাদার-(বুখারী)। এ আত্মসংযমই হচ্ছে রোযার মূল শিক্ষা। সাহাবায়ে কেরাম এভাবেই রোজার মর্ম উপলব্ধি করেছিলেন। হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, “তুমি যখন রোজা রাখবে, তখন যেন তোমার কর্ণ ও চক্ষু রোজা রাখে, তোমার কণ্ঠও যেন রোজা রাখে মিথ্যা এবং যাবতীয় গুনাহ থেকে। প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকো। রোজার দিনটিতে তুমি ভাবগম্ভীর ও প্রশান্ত থাকার চেষ্টা কর। রোজার দিনটি এবং রোজা ছাড়া দিনটি যেন তোমার একই রকম না হয়ে যায়”।
মোদ্দাকথায়, দেহ এবং আত্মা উভয়ে মিলে যে রোযা রাখে সেটাই হচ্ছে প্রকৃত রোজা। সে রোজার মাধ্যমেই আল্লাহর কাছ থেকে অর্জিত হবে অফুরন্ত মাগফিরাতের সুসংবাদ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রামাদ্বান মাসের রোজা রাখে তার সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রামাদ্বান মাসে রাতে ইবাদতে মশগুল থাকে, তার সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।-(বুখারী/মুসলিম)
ঈমান ও ইহতিসাব দ্বারা বুঝানো হয়েছে-রোজাকে আল্লাহ যে ফরয করেছেন তার সতেজ উপলব্ধি সহকারে তা পালন করা। আল্লাহর কাছ থেকে অফুরন্ত পুরস্কারের প্রবল আকাংখা সহকারে পালন করা। রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছার কুমন্ত্রণা থেকে দূরে থাকা। শুধু গৎ বাঁধা অভ্যেস হিসেবে নয়, বা সবাই যেহেতু রোজা রাখবে কাজেই আমারও না রেখে গতি নেই। অথবা পেট উপোষ রাখলে স্বাস্থ্যবিদদের দৃষ্টিতে অনেক ফায়দা আছে- এসব কিছুর কারণে নয়, সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর হুকুম পালনের পরাকাষ্ঠা নিয়ে। সিয়াম সাধনার এ নির্ভেজাল রূপটির নাম হচ্ছে ঈমান ও ইহতিসাব। ক্বিয়ামুল্লাইল অর্থাৎ তারাবীহ এবং তাহাজ্জুদও অনুরূপভাবে ঈমান ও ইহতিসাবের সহিত আদায় করতে হবে। ঘন ঘন করে কতকগুলো রুকু সিজদা দিয়ে অনেকগুলো রাকয়াতের ফিরিস্তি তৈরী করা ক্বিয়ামুল্লাইলের সার্থকতা নয়। সার্থকতা হচ্ছে খুশু খুযুসহ ভাবগম্ভীর পরিবেশে দীর্ঘ ক্বিয়ামে লম্বা কিরাত ও সময় নিয়ে ধীর স্থিরভাবে রুকু সিজদা করে আল্লাহর সাথে সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ গ্রহণ করা। খতম তারাবীহ হলেই হবে না। কুরআনকে অবশ্যই তাজবীদ সহকারে হৃদয়ঙ্গম করে তিলাওয়াত করতে হবে। চাই খতম হোক আর না হোক। রকেটের গতিতে কুরআন খতম এবং খতম তারাবীর এ নি®প্রাণ রেওয়াজ অনেকের কাছে একটা ঠুনকো রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ক্বিয়ামুল্লাইলের প্রাণ এবং আল্লাহর কালামের তেলাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য তাতে হারিয়ে গেছে। মযলুম তেলাওয়াতের শিকার এ কুরআন কিয়ামতের দিন সুপারিশ করা তো দূরে, বরং তেলাওয়াতকারীর বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে পাল্টা অভিযোগ দায়ের করে বসবে।
আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের প্রত্যাশায় রামাদ্বানের রোযা, তারাবীহ, তাহাজ্জুদ এবং কুরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি আরেকটি নেক আমলকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আদায় করতে হবে। আর সেটি হচ্ছে দান খয়রাত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ আমলটিকে রামাদ্বানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থদ্বয়ে হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, “নবীজী (সাঃ) ছিলেন সবচেযে বেশি দানশীল”। আর রামাদ্বান মাস এলে হযরত জিবরাঈল (আঃ) যখন তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন, তাঁকে নিয়ে কুরআন পাঠের অনুশীলন করতেন, তখন তিনি আরও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। হযরত জিবরাঈল (আঃ) রামাদ্বানের প্রতিটি রাতেই নবীজি (আঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসতেন। কুরআন পাঠের অনুশীলন করতেন। জিবরাঈল (আঃ)র সাথে সাক্ষাতের সময়গুলোতে তিনি মেঘবাহী বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। অন্য রেওয়াতে এসেছে, কেউ কিছু চাওয়ামাত্র তিনি তা দান করে দিতেন-(আহমদ), কারণ জান্নাতের আকাক্সক্ষা থাকলে অবশ্যই আল্লাহর রাস্তায় অবারিতভাবে দান করতে হবে। আলী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, “জান্নাতে এমন কিছু প্রাসাদ রয়েছে যেগুলো এত সুন্দর করে তৈরী করা হয়েছে যে সেগুলোর বাইরে থেকে ভিতরের সবকিছু দেখা যাবে এবং ভিতর থেকে বাইরের সবকিছু দেখা যাবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, কাদের জন্য সে সুযোগ হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)? তিনি বললেন, ঐসব লোকদের জন্য যারা মিষ্টভাষী, অন্যদেরকে আহার সরবরাহ করে, সর্বদা রোজা পালন করে আর রাতের অন্ধকারে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে নামাযে দাঁড়িয়ে যায়”। (আহমদ/ইবনে হাব্বান/বায়হাকী)
রামাদ্বানে উপরোল্লিখিত নেক আমলগুলোর পাশাপাশি আরোও যে আমলটার সুযোগ বেশি করে নিতে হবে সেটা হচ্ছে তাওবা এবং ইস্তেগফার। রোযা ও অন্যান্য নেক আমলের কারণে এ মাসে বান্দার প্রতি আল্লাহর করুণা অনেক বেড়ে যায়। বান্দাও এ মাসে তুলনামূলকভাবে গুনাহ কম করে এবং বেশি করে নেক আমলের কারণে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলে অনেকখানি এগিয়ে যায়। আর এটাই মোক্ষম সময় আল্লাহর কাছে তাওবাহ করার, গুনাহসমূহ ছেড়ে দেয়ার খাঁটি অঙ্গীকার করে অতীতের গুনাহের জন্য আল্লাহর মাফ চাওয়ার। রামাদ্বানের প্রথম বিশ দিনের তুলনায় শেষের দশ দিনের আমলকে আরও বাড়িয়ে দিতে হবে। দশ দিনের ঐ বিশেষ সুযোগের মধ্যেই নিহিত রয়েছে হাজার মাসের চেয়েও সেরা লাইলাতুল ক্বদরে রাতটি। যা লুকিয়ে রয়েছে পাঁচটি বেজোড় রাতের যে কোন একটি রাতে। তাই ঐ পাঁচটি রাতের আমল অবশ্যই অন্য রাতের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত। আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রামাদ্বানের শেষ দশটি দিন এলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কোমরে কাপড় বেঁধে নামতেন, রাতে ইবাদতে মশগুল হয়ে েেতন, পরিবারের অন্যান্যদেরকেও জাগিয়ে দিতেন।-(বুখারী/মুসলিম)
অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে, তিনি এ দশদিনে এত বেশি আমল করতেন যা তিনি অন্যান্য সময় করতেন না।-(মুসলিম) লাইলাতুল ক্বাদরকে পাওয়ার জন্যই এ দশদিনে ইতিফাক করতেন এবং এত আমল করতেন। তিনি এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিছাবের সাথে লাইলাতুল ক্বদরে ইবাদত করবে তার অতীত গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারী/মুসলিম) আয়েশা (রাঃ) জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমি যদি লাইলাতুল ক্বাদর পাই তাহলে কোন দোয়া বেশি পড়বো? বিললেন, বলো, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী।-(তিরমিযী) অর্থাৎ হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাকে আপনি খুবই পছন্দ করেন, অতএব আমাকে মাফ করে দিন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রামাদ্বানের এই সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।