বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার নেপথ্যে কারা ॥ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
শোকাচ্ছন্ন নীরবতায় যেন থমকে গিয়েছিল গোটা দেশ। ৪৬ বছর হয়ে গেল, এখনও মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ভোলেনি কৃতজ্ঞ বাঙালি। বরং নতুন করেই নতুন শপথে বলীয়ান হয়ে বাঙালি জাতি রবিবার ৪৬ বছর আগের ভয়াল এক রাতের শোকাবহ স্মৃতি স্মরণ করেছে। যিনি জাতিকে উপহার দিয়ে ছিলেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, লাখো শহীদের রক্তস্নাত লাল-সবুজের পতাকা। শুনিয়েছিলেন সেই অমর বাণী- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর। বাঙালির আশ্রয়স্থল, আশা-ভাবনার মূর্ত প্রতীক। অনিবার্য ঠিকানা আর স্বপ্নের গন্তব্য মহল। রাতের শেষ প্রহর তখন আকাশের গায়ে জেগে উঠতে শুরু করেছে। তখনও ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নারী-পুরুষ। সবার হাতে শ্রদ্ধার ফুল। তাদের ভেতর কেউ কেউ নীরবে তাকিয়ে আছে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখের রঙিন প্রতিকৃতির দিকে। নিয়ন বাতির আলোয় জ্বল জ্বল করছে চমশার ভেতর দিয়ে সে চোখ দু’টো। প্রতিকৃতির সামনের বেদি সকাল হতেই ছেয়ে গেছে ফুলে ফুলে। পেছনে নিস্তব্ধ একটি বাড়ি। যে বাড়ির ভেতর রাখা আছে মোটা ফ্রেমের এ চশমাটি। কারও ব্যবহারের জন্য কোন টেবিলে নয়, জাদুঘরের সামগ্রী হিসেবে। তবে রাজপথের মানুষের প্রাণের স্পন্দনে রবিবার যেন এ প্রতিকৃতির চোখে আলো জ্বলে উঠেছিল।
এবারের জাতীয় শোক দিবসে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলা, পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকরের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের নেপথ্যের মূল কুশীলবদের খুঁজে বের করে মুখোশ উন্মোচন করতে দ্রুত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠন করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি উঠেছে সর্বত্র। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর খুনীদের প্রেতাত্মা এবং স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করার শপথ উচ্চারণ করা হয়।
হাজার হাজার শোকার্ত মানুষের বিনম্র শ্রদ্ধা ও হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার পাশাপাশি ফুল দিয়ে শুভেচ্ছায় সিক্ত হলেন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে এবং টুঙ্গিপাড়ার মাজারে দিনভর বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন জাতির পিতাকে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালী জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকী, জাতীয় শোক দিবস।
করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে দলীয় কর্মসূচী সীমিত আকারে পালন করার কথা থাকলেও বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা বিপুল সংখ্যক কৃতজ্ঞ মানুষের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে এবার সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে শোক দিবসের প্রতিটি কর্মসূচী পালিত হয়।
৪৬টি বছর পার হয়ে গেলেও মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে এতটুকু ভোলেনি কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতি। তাঁর প্রয়াণ দিবসে যেন শোকস্তব্ধ ছিল দেশের সব প্রান্তর। শোকাচ্ছন্ন নীরবতায় থমকে গিয়েছিল গোটা দেশ। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর নশ্বর শরীর কেড়ে নিলেও তাঁর অবিনশ্বর চেতনা ও আদর্শ যে মৃত্যুঞ্জয়ী, ঘাতকের সাধ্য ছিল না ইতিহাসের সেই মহানায়কের অস্তিত্বকে বিনাশ করে- কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি স্বাধীনতার প্রাণ পুরুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি সার্বজনীন শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে প্রতিবছর তারই জানান দেয়। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর সাড়ে চার দশক পরেও সমান ভাবেই রয়েছেন সমুজ্জ্বল।
ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে এবং টুঙ্গিপাড়ার মাজারে দিনভর স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন জাতির পিতাকে। যার দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি মহার্ঘ্য স্বাধীনতা, স্বাধীন-সার্বভৌম মানচিত্র ও পতাকা। হৃদয়ের গভীরতা থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি খুনী মীরজাফর-বেইমানদের প্রতি ঘৃণা-ধিক্কারের মাত্রাও ছিল প্রচন্ড।
রাজধানী ছাড়াও সারাদেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলো বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুলের শ্রদ্ধা নিবেদনসহ নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে জাতির পিতার ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকী, জাতীয় শোক দিবস পালন করে। শোক দিবস উপলক্ষে দিনব্যাপী কোরআন তেলাওয়াত, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, কালো ব্যাজ ধারণ, শোকর‌্যালি, মিলাদ মাহফিল, রক্তদান কর্মসূচী, আলোচনা সভা, আলোকচিত্র প্রদর্শনী এবং দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়।
করোনার কারণে বড় ধরনের জমায়াতের ওপর আগে থেকেই ছিল নিষেধাজ্ঞা। তবুও শোকার্ত মানুষের ঢল থামানো যায়নি। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ভবনটিকে ঘিরে কাকডাকা ভোর থেকেই শোকার্ত মানুষের উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। আজ থেকে ছেচল্লিশ বছর আগে এমনই শেষ রাতে এ বাড়ির সামনে মানুষ নয়, এসেছিল মানুষের রূপধারী একদল পশু। তারা এসেছিল সশস্ত্র অবস্থায়। এখানে এসে তারা হত্যা করেছিল গোলাপের থেকে সুন্দর ও পবিত্র এক শিশু পুত্রকে। তারা হত্যা করেছিল, নতুন করে পৃথিবী সাজাতে মেহেদি রাঙা হাতে যে তরুণী নববধূ হয়ে এসেছিল স্বপ্নভরা যুবকের হাত ধরে- তাকে মেহেদি শুকানোর আগেই।
আর যে চশমাটি এখন এ বাড়ির জাদুঘরসামগ্রী- গুলিতে ছিটকে পড়েছিল, সে চশমাটি। তাদের গুলিতে বুক ঝাঝরা হয়ে রক্তাক্ত হন হিমালয়ের চেয়ে বিশাল এক মানুষ। হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে, তাঁর সময়ের তিনি ছিলেন পৃথিবীর সব থেকে উঁচু মানুষ। তিনি আমাদের জাতির জনক। আমাদের রাষ্ট্রের গ্রষ্টা। চিরকালের অবহেলিত, নিপীড়িত একটি পশ্চাৎপদ জাতির তিনি পিতা। তাঁকে যারা হত্যা করেছিল তাদের সামনেও তিনি নেমে এসেছিলেন পিতার মতো বিশাল এক বুক নিয়ে। নির্মম ঘাতকরা সে বুকেই চালিয়েছিল গুলি।
তারপর ৪৬ বছর কেটে গেছে এ জাতির জীবন থেকে। জাতি কেবলই পরিচিত হয়েছে পিতৃহন্তারক জাতি হিসেবে, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। কয়েক খুনী আর ষড়যন্ত্রকারীর কাজের দায় বহন করতে হয়েছে প্রতিমুহূর্তে, প্রতিক্ষণে জাতিকে। কিন্তু রবিবার ভোর থেকেই এখানে যারা এসেছিল, তাঁরা অনেকটাই ভারমুক্ত। তাদের মুখের ভাষা, বুকের ভাষা বার বার বলতে থাকে, পিতা তোমার হত্যাকারীকে আমরা ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়েছি। আমরা কিছুটা হলেও পাপমোচন করেছি। ইতিহাসের চরম সত্যকে প্রকাশ ঘটিয়ে তাই তারা যেন জানিয়ে যায়- খুনীরা এসেছিল তস্করের মতো আর আমরা এসেছি বিজয়ী বেশে। তারা তোমার এ বাড়ির সামনে এসেছিল রাতের অন্ধকারকে আরও গাঢ় করতে, আমরা এসেছি নতুন দিনের সূর্যকে আহ্বান জানাতে।
তাই রবিবার শ্রদ্ধাবনত চিত্তে জাতি স্মরণ করেছে ইতিহাসের মহামানব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। সবার বুকে ছিল শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ। আর চোখেমুখে শোকের ছায়া। দিনভর আবালবৃদ্ধবনিতার ভিড় ঘিরে রেখেছিল সবুজ ছায়াঘেরা বঙ্গবন্ধু ভবন আর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকাটিকে। করোনার ভয় দমাতে পারেনি জনতার আবেগ-হৃদয়ের গভীরে বিঁধে থাকা শোকের সমুদ্রকে। তবে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং সামাজিক দূরত্ব মেনেই শ্রদ্ধা নিবেদনসহ অন্যান্য কর্মসূচী পালন করতে দেখা গেছে।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রবিবার ভোরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দলের ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন ইউনিট কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারী ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। দিবসটি উপলক্ষে শনিবার সন্ধ্যা থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা, পাড়া-মহল্লায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ও দেশাত্মবোধক গান বাজানো হয়।
রাষ্ট্রীয় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার ভোরে রাজধানীর ৩২ নম্বরে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রতিকৃতির বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকস দল এ সময় রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়, বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শহীদদের স্মরণে অনুষ্ঠিত বিশেষ মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের পর প্রধানমন্ত্রী ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে প্রবেশ করে সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন। সেখানে ৪৬ বছর আগে ইতিহাসের এক বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয় এবং পরে বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী সেখান থেকে বনানী কবরস্থানে যান। যেখানে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তাঁর তিন ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেলসহ ১৫ আগষ্টের শহীদরা শায়িত রয়েছেন। আবেগেজড়িত প্রধানমন্ত্রী তাঁদের কবরে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দেন। এ সময় তাঁর দুই চোখে ছিল স্বজন হারানোর তীব্র বেদনার অশ্রু। সেখানে তিনি ফাতেহা পাঠ করেন এবং তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা ও দোয়া করেন।
প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তিনি নীরবে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকেন এবং বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্টের সকল শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করেন। এরপর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে বিচারপতিরা জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় আপীল বিভাগের বিচারপতি মোঃ নুরুজ্জামান ননী, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীম, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, বিচারপতি জাহাঙ্গির হোসেন, বিচারপতি জেবিএম হাসান, বিচারপতি মোঃ খসরুজ্জামান, বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সকালে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বেগম মতিয়া চৌধুরী, জাহাঙ্গির কবির নানক, আবদুর রহমান, শাজাহান খান, মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডাঃ দীপু মনি, ড. হাছান মাহমুদ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আহমদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল হক, এস এম কামাল হোসেন, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, আফজাল হোসেন, মৃণাল কান্তি দাস, অসীম কুমার উকিল, ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, নজিবুল্লাহ হীরু, আবদুস সবুর, সামসুন্নাহার চাঁপা, ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ।
করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে আওয়ামী লীগের দুই জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ আলাদাভাবে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সরকারের মন্ত্রী সভার সদস্য, পুলিশের আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ, র‌্যাবের ডিজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ সরকারী বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একে একে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এ বছর করোনার কারণে টুঙ্গিপাড়ায় যেতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী জাতির পিতার সমাধিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল অনার গার্ড প্রদান করে। বেজে ওঠে বিউগলে করুণ সুর। বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের নিহত সদস্যদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে ফাতেহা পাঠ ও বিশেষ মোনাজাতে অংশ নেন তিনি।
এরপর আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব) মুহাম্মদ ফারুক খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একটি প্রতিনিধি দল বঙ্গবন্ধুর মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, এডভোকেট জাহাঙ্গির কবির নানক, শাজাহান খান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, মাহবুব-উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, এস এম কামাল হোসেন, মির্জা আজম, আফজাল হোসেন, সায়েম খান, আমিরুল ইসলাম মিলন, এবিএম রিয়াজুল কবির কাওছার, আনিসুর রহমান, সাহাবুদ্দিন ফরাজী, ইকবাল হোসেন অপু, আজিজুস সামাদ আজাদ ডন, সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম প্রমুখ।
প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য খুলে দেয়া হয়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে দলীয় কর্মসূচী সীমিত আকারে পালন করার কথা থাকলেও ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দলীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়।
এ সময় ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, তাঁতি লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, বিএমএসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি হাজারো মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সফিকুল বাহার মজুমদার টিপুর নেতৃত্বে একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে আরও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, মোহাম্মদ নাসিম ফাউন্ডেশন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব পরিষদ, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ বেতার, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, শেখ রাসেল শিশু কিশোর পরিষদ, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ বিভিন্ন দল, অজগ্র সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সর্বস্তরের হাজারো মানুষ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতীয় হাইকমিশন। রবিবার বাংলাদেশ হাইকমিশনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি এই শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে ভারতীয় হাইকমিশনের এক টুইটে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা। বাংলাদেশের শোকে ভারত সমব্যথী। বঙ্গবন্ধুর যে মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন আমরা তা রক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়েছি।’
শ্রদ্ধা নিবেদন ছাড়াও দিনভর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে ঘুরে নতুন প্রজন্মের শিশু-তরুণ দেখেছে ভয়াল ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও নারকীয় পৈশাচিকতার দৃশ্য। স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে ইতিহাসের নৃশংসতম সেই হত্যাকা-ের ঘটনাবলীর সঙ্গে পরিচিত হতে গিয়ে অনেকের চোখেই নেমেছিল অশ্রুধারা। এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে স্বেচ্ছাসেবক লীগের আলোকচিত্র প্রদর্শনী ঘুরে ঘুরে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেন শ্রদ্ধা জানাতে আসা হাজারো বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ, শিক্ষার্থীরা।
রাজধানী ছাড়াও সারাদেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলো বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুলের শ্রদ্ধা নিবেদনসহ নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে শোক দিবস পালন করে। শোক দিবস উপলক্ষে দিনব্যাপী কোরান তেলাওয়াত, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার, বঙ্গবন্ধুর সমাধি ও প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, কালো ব্যাজ ধারণ, মিলাদ মাহফিল, রক্তদান কর্মসূচী, আলোচনা সভা, আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়। জাতীয় শোক দিবস স্মরণে দোয়া মাহফিল কর্মসূচী পালন করেছে রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)।
ভোরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দলের ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন ইউনিট কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারী ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে শোক দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা সরাসরি সম্প্রচারসহ বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার এবং সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। বায়তুল মোকাররম মসজিদসহ সারাদেশের মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডায় বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সকালে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে ১৫ আগষ্ট নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়াও জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাতীয় প্রেসক্লাব, বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড ও পাড়া-মহল্লায় দুস্থ ও গরিব মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়। এদিকে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সারাদেশের সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। এছাড়াও আওয়ামী যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক দিবসের আলোচনা ও দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়।