জামালগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, দিরাই-শাল্লা ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ সহ প্রায় উপজেলাতেই দেশী জাত ধানের সাথে বিআর-২৮ ধান কাটা শুরু হয়েছে। বুকভরা আশা নিয়ে সোনাধান ঘরে তোলতে দিন গুণছেন কৃষকরা। গত বোরো মওসুমে এই সময় ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে একরে পর এক তলিয়ে গিয়েছিল জেলার সব ক’টি হাওরের বোরো ফসল। এ বছর এই সময় বোরো ধানের ভান্ডার খ্যাত পাকনা হাওর, হালির হাওর, ধারাম হাওর, ধানকুনিয়া হাওর, মাটিয়ানী হাওর, খরচার হাওর, শনির হাওরসহ জেলার হাওর গুলোতে ধান কাটাছেন কৃষকরা। জেলা জুড়ে হাওর পারে উৎসবের আমেজ বিরাজ করতে দেখা গেছে কৃষকদের। ইতোমধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কাটার শ্রমিকরা আসতে শুরু করেছেন কৃষকদের বাড়িতে বাড়িতে। তবে তুলনা মূলক ভাবে শ্রমিক সংকটের কারণে কিছুটা উদ্বিগ্ন রয়েছেন কৃষকরা।
জেলার সব ক’টি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে-গ্রামে এখন চলছে বোরো ফসল কাটার ব্যাপক উৎসব। বিস্তৃীর্ণ ফসলী মাঠ জুড়ে পাকা-অধাপাকা ধানের মৌ-মৌ গন্ধে ভরে গেছে জেলার সব ক’টি হাওর। যে দিকে চোখ যায় শুধুই ধান আর ধান। বছরে একটি মাত্র বোরো ফসলকে ঘিরেই এ অঞ্চলের মানুষের যত স্বপ্ন। বহু প্রতিক্ষা ও ত্যাগের পর কৃষকদের বছর জুড়ে থাকা অভাব-অনটন আর জমাট বাধা দুঃখ-কষ্ট পেরিয়ে, এবার কিছুটা হলেও সোনাঝরা হাঁসি ফোটছে তাদের মুখে। বহু প্রত্যাশিত সোনালী ফসল ঘরে তুলতে কৃষকরা ব্যস্ত ধান কাটতে মাঠে, আর কৃষাণীরা মাড়াইকল দিয়ে ধান মাড়াইয়ের পর শুকানোর জন্য খলায় কাজ করছেন। সব মিলিয়ে এবার সুনামগঞ্জের হাওর পাড়ের গ্রামে গ্রামে চলছে ধান কাটার আনন্দ উৎসব। অবহাওয়া অনুকুলে থাকলে আর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে পুরোদমে ধান কাটা শুরুর হবে। এ সময় সবার ঘরে-ঘরে থাকবে নতুন ধান আর ধান। হাজারো স্বপ্নে বিভোর কৃষকরা এখন রাত যাপন করছেন ধান কাটার অধীর আগ্রহে। কিন্তু এত স্বপ্নের মাঝেও তাদের মনে আতঙ্কের কোন কমতি নেই। ‘রোদ উঠলেই হাসি আনন্দের ঝলকে ভরে উঠে কৃষাণ-কৃষাণীর মন। আর মেঘলা আকাশ বা বৃষ্টি হলেই তাদের চেহারাটা হয় ফ্যাকাসে’। মেঘলা আকাশ আর আকাশ ফাটার শব্দে তাদের শুরু হয় ছটফটানি ও দৌড়ঝাঁপ। পাহাড়ি ঢল তাদের মনে ভাবনা জাগায় বার-বার। চৈত্রের প্রচন্ড অভাবে দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির কারনে চরম দুর্দিন কাটিয়েছেন কৃষকরা। কৃষকরা রাত পোহালে ধানী মাঠে গিয়ে সোনালী ধানের ঢেউয়ের দোলায় তাদের প্রাণ জুড়িয়ে ভুলে যান দুর্দিনের কথা। মনের অজান্তেই একটু হলেও মুচকি হাঁসি ফুটে উঠে তাদের মুখে। হৃদয়ের গভীর থেকে মহান আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা করেন ফসল কাটার ক’টা দিনের জন্য।
গত বছর সুনামগঞ্জের হাওরে এ সময় ছিল ফসলহারা কৃষকদের হাহাকার আর আর্তনাদ। একের পর এক হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে ফসল ডুবির কারনে দিশেহারা হয়ে পড়েন তাঁরা। এবার জেলার সবচেয়ে ভালো ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মান হয়েছে জামালগঞ্জের হাওরে। জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আল ইমরানের নিরলশ প্রচেষ্টায় জেলা পর্যায়ে বাঁধ নির্মানে জামালগঞ্জ সেরা হিসেবে বিষয়টি আলোচনায় আসে। নিঃস্ব কৃষকরা এবার কষ্টে ফলানো ধান গোলায় তোলার স্বপ্ন দেখছেন। পুরোদমে ধান কাটাতে প্রস্তুত তাঁরা। বৈশাখের প্রথম সপ্তাহেই হাওরে হাওরে বোরো ধান কাটার ধুম শুরু হবে। জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দিরাই-শাল্লা, জগন্নাথপুর সহ কয়েকটি উপজেলার হাওরে বিআর-২৮ ও দেশী জাতের ধান কাটা শুরু হয়েছে। সুনামগঞ্জের হাওরের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে ১০-১৫ বছর পূর্বে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ভাগে ধান কাটার জন্য আসতো বিশাল শ্রমিক বাহিনী। তারা কৃষকের বাড়িতে এক মাস থেকে ধান কেটে মোটা অংকের পারিশ্রমিক নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। যাওয়ার সময় তাদেরকে গরু-খাসী ও নতুন পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী উপহার দেয়া হতো। এখন আর আগের মতো শ্রমিক না আসায় ধান কাটার জন্য শ্রমিক সংকটে পড়তে হয় কৃষকদের। পাকনা হাওরের কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, এবার বহু কষ্টে দেনা করে ফসল করছি , আল্লার রহমতে ভালো ফলন হইছে ধান কাটা শুরু করছি। কৃষক তোফায়েল আলম চৌধুরী ছানা মিয়া বলেন, গত বছর ফসল ডুবির পর চোখে অন্ধকার দেখেছি, সারা বছর কষ্ট করে দেনা করে ফসল ফলাইছি। ফলনও ভালো হইছে কয়েক দিনের মধ্যেই াামার ধান কাটা শুরু হইব। কৃষক প্রবাল মিয়া বলেন, ধান কাটা শুরু হইছে, এবার হাওরের বাঁধ হইছে ঠিক মতই। নদীতেও পানি নাই, আল্লায় যদি কয়েকেটা দিন রোদ দেয় তাইলে হাওরের ফসল ঘরে যাইবো। জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রজব আলী জানান, লম্বাবাঁক গ্রামের কৃষক কবীর হোসেন ও আ: রহিম বিআর-২৮ জাতের ধান কেটেছেন ফলনও হয়েছে ভালো, আর সপ্তাহ খানেক পর হালির হাওরে পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৫৪ টি হাওরে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। গত বছরের এপ্রিল মাসের অতিবৃষ্টি ও পাহাঢ়ি ঢলে একের পর এক জেলার সব ক’টি হাওরের বোরো ধান তলিয়ে যায়। এতে জেলার ৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৯০ টি কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হন। চলতি বছর জেলার বিভিন্ন হাওরে ২ লাখ ২২ হাজার ৭১৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ২১ হাজার ৭৯২ মেট্রিক টন। কিছু কিছু হাওরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। পুরোদমে ধান কাটা শুরু হতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে।
সুনামগঞ্জের পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন, জেলায় এবার হাওরের ফসল রক্ষায় ১ হাজার ৪৯০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাঁধ হয়েছে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার। বাঁধের কাজ শেষ। এখন আনুষঙ্গিক কাজ ও রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে। সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল রক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণর কাজ করা হয়েছে। বৈরী আবহাওয়া না হলে, কৃষকেরা এবার হাসি মুখেই তাঁদের ধান গোলায় তুলতে পারবেন।