কাজিরবাজার ডেস্ক :
২০১৭ সালে সারাদেশে সাড়ে ছয় হাজার দুর্ঘটনায় উদ্ধার করা ১১ হাজার ৫০০ জনের মধ্যে আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ যানজট। যানজটের কারণে দ্রুত হাসপাতালে নিতে না পারার কারণেও অনেকে মারা যান। আর রাজধানীতে দুঃসহ যানজটের কারণে মানুষ ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। দীর্ঘ সময় সড়কে আটকে থাকায় মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ছে। সেই সঙ্গে মানসিক দিক থেকে চাপে পড়ছে নগরবাসী। যানজটে দিনে নষ্ট হচ্ছে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা। বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২২ হাজার কোটি টাকা। শনিবার ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট : আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব তথ্য ওঠে আসে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটে গোলটেবিলের আয়োজন করে বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এতে বিভিন্ন সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন এবং মতামত তুলে ধরেন।
সেমিনারে বারবারই নগরীর যানজট পরিস্থিতির ভয়াবহতার চিত্র ওঠে আসে বিশেষজ্ঞদের আলোচনায়। তারা বলেন, যানজটের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে মানুষ প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সময় পাচ্ছে না। স্বজন এবং অন্যের সঙ্গে ‘ন্যায্য’ আচরণের বদলে দুর্ব্যবহার করছেন ভুক্তভোগীরা। আবার দুর্ঘটনায় আহত বা শঙ্কটাপন্ন রোগীদেরকেও সময়মতো হাসপাতালে নেয়া যাচ্ছে না বলে পথেই মৃত্যু হচ্ছে অনেক মানুষের।
সেমিনারে জানানো হয়, পিক আওয়ারে রাজধানীতে গড়ে ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলছে। হেঁটে চললে এই গতিতে কোথাও পৌঁছানো যায়। ঢাকায় পরিবহন সেবা বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বলেও জানানো হয় আলোচনায়। এই আলোচনায় যানজটের আর্থিক ক্ষতি, মোকাবেলার নানা পরামর্শের পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির দিকটি নিয়েও আলোচনা করা হয়।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের (পঙ্গু হাসপাতাল) সাবেক পরিচালক সিরাজ উল ইসলাম বলেন, ‘যানজটের কারণে সব রোগই হয়। কারণ দেখা যায় একজন যানজটে এসি গাড়িতেও ঘামছেন। এটা তার টেনশন। তিনি চিন্তা করছেন, সময়মতো পৌঁছাতে পারবেন না। এর প্রভাব পড়ে তার শরীরে। তিনি বলেন, যানজট জীবনকে জটিল করে দিচ্ছে। থাইল্যান্ডে দেখেছি কেউ অসুস্থ হলে তাকে তিন মিনিটে সেবা দেয়। কিন্তু আমাদের এখানে ৩০০ মিনিটেও সেটা পারা যাবে কি না সন্দেহ আছে।
গত বছর সারাদেশে সাড়ে ছয় হাজার দুর্ঘটনায় উদ্ধার করা ১১ হাজার ৫০০ জনের মধ্যে আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যুর পেছনেও অন্যতম কারণ হিসেবে যানজট দায়ী বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (ঢাকা) দেবাশীষ বর্ধন। তিনি বলেন, অনেক সময় যানজটের কারণে দ্রুত হাসপাতালে না নিতে পারার কারণেও অনেকে মারা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফারাহ দীবা, বলেন, যানজটের কারণে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি-দুটোই হয়। মানসিক যে ক্ষতিটা হয় সেটা হচ্ছে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। আর এর প্রভাব পড়ে তার আচরণে। দেখা যায় বাসায় আসার পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রাগের সঙ্গে কথা বলে। প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সময় পাওয়া যায় না। যেহেতু যানজটে আটকে থাকতে হয় তাকে অনেক সময়।
পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে : ২০১৭ সালের জুলাইয়ে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়, গত ১০ বছরে ঢাকায় যান চলাচলের গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে মাত্র সাত কিলোমিটারে এসেছে। ওই হিসাবে প্রতিদিন ঢাকায় নষ্ট হতো ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা। সেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে এক বছরে।
মূল প্রবন্ধে এআরআইএর পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘রাজধানীতে যানজটের কারণে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এখন প্রতি ঘণ্টা কয় টাকা করে হিসেব করবেন সেটা আপনাদের ব্যাপার।
আলোচনায় যানজট মোকাবেলায় বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেন মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, যানজট নিরসনে সরকারের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। ফুটপাথগুলো দখলমুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে হকারদের পুনর্বাসন করতে হবে। পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, ঢাকায় এখন বাস আছে সাড়ে ছয় হাজার যাতে ৩০ লাখ যাত্রী যাতায়াত করে। কিন্তু বড় আকারের বাস (দোতলা) আড়াই হাজার দিলেই এই সংখ্যক যাত্রী পরিবহন সম্ভব। রাজধানীতে মাত্র তিনটি বড় সড়ক আছে। এর সংখ্যা বাড়াতে হবে।
রাজধানীর ওপর চাপ কমাতে নারায়ণগঞ্জ, সাভার, টঙ্গী, গাজীপুরের সঙ্গে ট্রেন যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ আসে আলোচনায়। অফিস সময়ের আগে ও পরে ১০ মিনিট পরপর এসব রুটে ট্রেন ছাড়লে মানুষ রাজধানীর বদলে লাগোয়া জনপদে বেশি থাকবে বলে মনে করেন মোয়াজ্জেম হোসেন।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, রাজধানীতে মোট জমির যে সাত থেকে আট শতাংশ রাস্তা আছে সেটারও যদি সঠিক ব্যবহার করা যায় তাহলে যানজটের কারণে ক্ষতি হওয়া ২২ হাজার কোটি টাকা রক্ষা করা যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এআই মাহবুব উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সরওয়ার জাহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ প্রমুখ।