অগ্নি ঝরা মার্চ

49

জেড.এম. শামসুল :
আজ ২৫ মার্চ। সেই ভয়াল কালোরাত্রি। ইতিহাসের কলঙ্কময় অধ্যায় নারকীয় রাত। ১৯৭১ সালের এই রাতে পাকিস্তানী হানাদার হার্মাদ সামরিক দস্যুরা নিরস্ত্র বাঙালির উপর আকস্মিকভাবে হামলা চালিয়ে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। মধ্যরাতে ওরা পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত বাঙালি নিধনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ছাত্রাবাস মেয়েদের হল এবং শিক্ষক কর্মচারীদের আবাসিক এলাকায় মেশিনগান, মর্টারশেল হামলা করে অগণিত মানুষ হত্যা করে। এ হায়েনার দল নিরস্ত্র ছাত্র, শিক্ষাবিদ, শিশু-কিশোর, মেয়েদেরকে রেহাই দেয়নি নির্বিচারে হত্যা করে। এদিন কালো রাতে হার্মাদ দস্যুরা পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প, রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ি এবং কুর্মিটোলা সেনানিবাসে বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপর ভয়াবহ হামলা চালায়। শুধু ঢাকা নয়, সমগ্র বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে এ কালো রাতে একই সাথে হামলা করে। এদিন গভীর রাতে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডিস্থ বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে তাদের নরকালয় পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। এ নারকীয় রাতের স্মৃতিকে ধারণ করে বাঙালি দীর্ঘ ৯ মাস বর্বরোচিত হানাদার হার্মাদ পশু বাহিনীর সাথে লড়াই করে। ৩০ লাখ শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বপ্নের বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। এদিনে পাকিস্তানী হানাদার হার্মাদ বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসের জঘন্যতম ঘৃণা কাপুরুষোচিত অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে বাঙালি জাতি তাদের পক্ষের শক্তিকে জয়যুক্ত করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানী বর্বর জঙ্গি শাসক গোষ্ঠী বিজয়ী বাঙালির হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দিতে চায়নি। তারা ক্ষমতা হস্তান্তরের অজুহাতে ২৫ মার্চ পর্যন্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের নামে কালক্ষেপণ শুরু করে। এই কালক্ষেপণের মধ্যেই তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা ও অস্ত্র এনে পূর্ব পাকিস্তান ভরে ফেলে এবং এভাবেই অপারেশন সার্চ লাইট নামে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে এই রাতে। এই জঘন্যতম হত্যাকান্ডের নায়ক ছিল বেলুচ কসাই নামে খ্যাত জেনারেল টিক্কা খান। তার অন্য দুই ইবলিস সহযোগী মেজর জেনারেল খাদিম এবং ব্রিগেডিয়ার আরবার এই ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। এই ২৫ মার্চের রাতে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজনৈতিক আলোচনা সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে চিন্তিত তখন সেই রাতে জেনারেল টিক্কা খানের ফোন পেয়ে আধুনিক সেনাবাহিনী নিয়ে বাঙালি নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই রাতেই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এদিন সকাল থেকে সাদা কাপড়ওয়ালা পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর লোকজন বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ঘিরে রাখলেও একের পর এক মিছিল চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধু সন্ধ্যার পূর্বেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, আব্দুস সামাদ আজাদ, ডঃ কামাল হোসেন, আব্দুল মন্নান, ব্যারিষ্টার আমীর উল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, কাজী আরেফ আহমদ, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাজাহান সিরাজ প্রমুখের সাথে যার যা দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করার চূড়ান্ত দিক নির্দেশনা দেন। এদিন সন্ধ্যার পর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৈঠক করেন। রাত সাড়ে ১১টায় হানাদার বাহিনী হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। এদিন সমস্ত দেশে অপারেশন সার্চ লাইট পরিচালনা করে হার্মাদ বাহিনীর ঘাতক সেনাপতি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও খাদিম হোসেন সহ জঙ্গি সেনারা। এদিন রাতে দেশের বড় বড় শহরগুলোতে কার্ফ্যু জারি করা হয়। কার্ফ্যু চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন বাসা বাড়ীতে হামলা করে লুটপাট হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বাংলার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করতে থাকে। এদিন রাতে সিলেটের রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ সকল প্রগতিশীলদের মধ্যে আতংক বিরাজ করে। এদিন রাতে সিলেটের বিশিষ্ট চা বাগান মালিক, সাংবাদিক আমিনুর রশিদ চৌধুরীর বাসা জ্যোতি মঞ্জিলে আওয়ামীলীগ ও ন্যাপ নেতৃবৃন্দের সভা বসে। সভায় হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়।