সংবর্ধনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ॥ এ সাফল্য জনগণের

39

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতিকে জনগণের প্রতি উৎসর্গ করেছেন। দেশের এই উন্নয়ন, সাফল্য ও অগ্রযাত্রা ধরে রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এই অগ্রযাত্রাকে আমাদের ধরে রাখতে হবে। এই অর্জন যেন কোনভাবেই হারিয়ে না যায়, এই যাত্রাপথ যেন থেমে না যায়, আমি শুধু এটুকুই আবেদন করব দেশবাসীর কাছে। আমরা গর্বিত জাতি হিসেবে বাঁচতে চাই। আমরা তো যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? অন্যের কাছে কেন হাত পেতে চলব? আমরা যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি সেটা তো আজ আমরা প্রমাণ করেছি।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণেই বলেছিলেন, বাংলার মানুষকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। এই অর্জন বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজ করেছেন তাদের সকলের এবং জনগণের। কাজেই আমি মনে করি বাংলাদেশের জনগণই হচ্ছে মূল শক্তি। তাদের আমি অভিনন্দন জানাই। আর জনগণই পারে সব রকম অর্জন করতে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই হবে শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মর্যাদা পাবে। সেটাই আমার কামনা।
বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রদত্ত সংবর্ধনা এবং এই উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর ঢোলের বাদ্যে সূচনা হয় উৎসবের। সাত দিনের এই উৎসবের উদযাপন চলছে ‘অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশ থেকে উত্তরণের সুপারিশপত্রের রেপ্লিকা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফজিতা ম্যানুয়েল কাতুয়া ইউতাউ কমন, ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আজম বক্তব্য রাখেন। ইউএনডিপি এ্যাডমিনিস্ট্রেটর আসীম স্টেইনারের একটি লিখিত বার্তাও অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং প্রধান বিচারপতিসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষের শুভেচ্ছায় সিক্ত হন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করেই সম্মেলন কেন্দ্রে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী। আলোচনা পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রী মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
দেশের এই উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের এই অর্জন করতে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এই অর্জনের কথাগুলো যত সহজে বলা হয়, তত সহজে কিন্তু আসেনি। অনেক চড়াই উতরাই যেমন পার হতে হয়েছে তেমনি গ্রেনেড হামলাসহ তাঁর ওপর বারবার হত্যা চেষ্টাও করা হয়েছে বলেও স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি রূপক অর্থে বলেন, অনেক পথের কাঁটা পায়ে বিঁধিয়েও এগিয়ে যেতে হয়েছে। বারবার আঘাত এসেছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি সেই গ্রেনেড হামলা থেকে শুরু করে বারবার মৃত্যুকে দেখেছি, কিন্তু ভয় পাইনি কখনও। যে দেশে তাঁর বাবা, মা-ভাইদের হত্যাকা-ের বিচারের পথকে রুদ্ধ করার জন্য খুনীদের ইনডেমনিটি দেয়া হয়, তারা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়, ভোট চুরি করে এমপি হয়, রাষ্ট্রপতি পদর্প্রার্থী হবারও সুযোগ পায়- সেখানে তিনি ভয় কেন পাবেন, পাল্টা প্রশ্ন রাখেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে গড়ে তুলে তাঁকে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে রেখে যান। আজ সেখান থেকে বাংলাদেশকে তাঁর সরকার উন্নয়শীল দেশে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও জাতির পিতা বেঁচে থাকলে স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ উন্নত দেশের পর্যায়ে চলে যেতে পারত। আগামী ২৬ তারিখ আমাদের স্বাধীনতার ৪৭ বছর পূর্ণ হবে, আমাদের তো অনেক দিন লেগে গেল।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন প্রধানমন্ত্রী। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি জানি না আমার বাবা আজ বাংলাদেশের মানুষের এই অর্জনগুলো তিনি পরপার থেকে দেখতে পাচ্ছেন কি না। নিশ্চয়ই বাংলাদেশের এই অর্জনে লাখো শহীদের আত্মার পাশাপাশি তাঁর বাবার আত্মাও শান্তি পাবে। দেশের এই উন্নয়ন কি বেহেশত থেকে বঙ্গবন্ধু দেখতে পারেন? মাঝে কিছু সময় চুপ করে তাকিয়ে থাকেন উপরের দিকে। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এখানে আসার আগে আমার ছোট বোন শেখ রেহানার সঙ্গে কথা বলছিলাম। আব্বা (বঙ্গবন্ধু) যে চেয়েছিলেন, বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটবে। বাংলাদেশের মানুষ উন্নত জীবন পাবে। বাংলাদেশের মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচবে, আজকে সেই সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে। আমরা একটা একটা দুয়ার পেরিয়ে এগিয়ে গেছি।
পিতা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে তাঁর শেখা রাজনীতির মূল শিক্ষাই জনকল্যাণ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, মানুষ নানা কারণে রাজনীতি করে। কেউ রাজনীতি করে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য, নিজের সমৃদ্ধ জীবনের জন্য। আমি রাজনীতি শিখেছি বাবার কাছ থেকে, জনগণের ভাগ্যেন্নয়ন করতে। নিজের ভাগ্যোন্নয়ন করতে নয়। আর আমার কাছে ক্ষমতা মানেই হচ্ছে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন করা। জনগণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা। নিজের জন্য নয়, নিজের ভোগ বিলাস নয়, জনগণ যাতে একটু ভাল থাকে, সুখে থাকে, সুন্দর জীবন পায়- সেটাই আমার মূল লক্ষ্য। যে লক্ষ্য বাস্তবায়নেই তাঁর নিরন্তর পথ চলা। কাজেই যতটুকু অর্জন এর সব কৃতিত্বই বাংলার জনগণের। তিনি বলেন, এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেই দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলবই।
দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের কাছ থেকে সাড়া না পেলে, তাঁদের সহযোগিতা না পেলে, তারা যদি ভোট দিয়ে নির্বাচিত না করত তাহলে তো ক্ষমতায়ও আসতে পারতাম না। এই উন্নয়নের ধারাটা যেন অব্যাহত থাকে সেটাই কামনা করে তিনি বলেন, ২০২১ সাল নাগাদ আমাদের লক্ষ্য মধ্যম আয়ের দেশ, দেশকে যেন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্য মুক্তভাবে গড়ে তুলতে পারি। আর ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালন করব। আর সেই সময়ে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় তা আমরা উদযাপন করতে পারব। আর ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার মহাসংগ্রামে তিনি ততদিন বেঁচে থাকবেন কি না সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও আজকের যারা নতুন প্রজন্ম, দেশকে তারাই এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়া সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, এসডিজি বিষয়ক সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ এবং তিন বাহিনীর প্রধানরা নিজ নিজ বাহিনীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। বাংলাদেশ পুলিশ, মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, পেশাজীবী, নারী সংগঠন, এনজিও প্রতিনিধি, শিশু প্রতিনিধি, প্রতিবন্ধী প্রতিনিধি, শ্রমজীবী প্রতিনিধি এবং মেধাবী তরুণ সমাজের পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দেয়া হয়। দেশের ক্রীড়াবিদদের পক্ষে ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা এবং সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেয়া হয়। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান ফুলের তোড়া প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যগণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সরকারের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, তিন বাহিনী প্রধানগণ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকবৃন্দ, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ, সিনিয়র সাংবাদিকবৃন্দ, শিক্ষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পীসহ আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনার ঘোষণার পর ঢোলের বাদ্যে সূচনা হয় উৎসবের। সাত দিনের এই উৎসবের উদযাপন চলছে ‘অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ স্লোগানে।