গ্রেফতারকৃত জঙ্গি সাগর ও নিলয় এর চাঞ্চল্যকর তথ্য ॥ মন্ত্রী, এমপি সহ শতাধিক মানুষকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গিরা

86

কাজিরবাজার ডেস্ক :
গত বছরের ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবসে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কাছাকাছি গিয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মন্ত্রী, এমপিসহ শতাধিক মানুষ হত্যার পরিকল্পনা করেছিল নব্য জেএমবির জঙ্গীরা। রাজধানীর গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলার পরিকল্পনাকারী হাসিদুর রহমান সাগর ও রাজধানীর পান্থপথের হোটেল ওলিও-তে আত্মঘাতী জঙ্গি বিস্ফোরণ ঘটানোর অর্থ যোগানদাতা আকরাম হোসেন নিলয়কে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করেছে তারা। বগুড়ায় এই দুই জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের মাধ্যমে সাতদিনের হেফাজতে নিয়েছে গুলশান হামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। এর আগে নব্য জেএমবির এই দুই ভয়ঙ্কর দুর্র্ধষ জঙ্গী নেতা হাদিসুর রহমান সাগর ও আকরাম হোসেন নিলয়কে বুধবার পুলিশ বগুড়া থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) কাছে হস্তান্তর করে। এরপর বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে পাঠিয়ে সাতদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় অন্যতম পরিকল্পনাকারী সন্দেহভাজন পলাতক আসামি হাদিসুর রহমান সাগর। সে ওই হামলার ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহ করেছিল বলে পুলিশ তাদের অনুসন্ধানে জানতে পারে। সাগর পুরনো জেএমবির সদস্য। ২০১৪-১৫ সালে তামিম চৌধুরীর হাত ধরে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয় সে। নব্য জেএমবিতে সে বোমা তৈরির কারিগর হিসেবেও পরিচিত ছিল। মাসখানেক আগে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রেফতার হওয়া আকরাম হোসেন নিলয় নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ একজন অর্থদাতা। গুলশান হামলার পর থেকে নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছিল সে। সংগঠনে ‘স্পেড উইলসন’ এবং ‘জ্যাক স্পেরো’ নামেও পরিচিত ছিল সে। এর আগে গত বছরের নবেম্বর মাসে নিলয়ের বাবা আবু তোরাব এবং মা ও বোনকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন। নিলয় ও তার পরিবারকে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে বিস্ফোরণের অর্থের যোগানদাতা হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল। সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবসে ধানম-ির ৩২ নম্বর রোডের জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ ও মাল্যদান উপলক্ষে জমায়েত হওয়া মন্ত্রী, এমপিসহ শত শত জড়ো হওয়া মানুষজনের মধ্যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল গ্রেফতার হওয়া সাগর ও নিলয়ের নেতৃত্বে জঙ্গীরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫ আগষ্টের আগে রাজধানীর পান্থপথের হোটেল ওলিও-তে অবস্থান নেয় নব্য জেএমবির জঙ্গীরা।
নব্য জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য সাইফুলের পরিকল্পনায় ছিল যে কোন উপায়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কাছাকাছি গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো। এজন্য বেশ বড় আকারের একটি বোমা তৈরি করে সাইফুলের হাতে পৌঁছে দিয়েছিল তার সহযোগী জঙ্গিরা। এই ঘটনায় বোমা তৈরির কারিগর এবং অর্থ সরবরাহকারীসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম- সিটিটিসি ইউনিট। গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে আটজন ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। সর্বশেষ মোহাম্মদ তাজুল ওরফে ছোটন নামে এক জঙ্গিকে গত ১৬ মার্চ গ্রেফতারের পর তিনদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিটিটিসি। আর বুধবার বগুড়ায় গ্রেফতার করা হয়েছে সাগর ও নিলয়কে। তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সিটিটিসির সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবসে জঙ্গী হামলা করা হবে এমন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনায় নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঘটনার দিন ১৫ আগস্ট সকালে রাজধানীর পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে আত্মঘাতী এক জঙ্গী অবস্থান করছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে হোটেলটি ঘেরাও করে রাখে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সিটিটিসি। পরে সিটিটিসির সোয়াট টিমের সদস্যরা অভিযান চালাতে গেলে আত্মঘাতী জঙ্গী দলের সদস্য সাইফুল ইসলাম নিজের কাছে থাকা বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। সিটিটিসি তাদের এই অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন আগস্ট বাইট’। সিটিটিসির তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর পুলিশের জঙ্গী বিরোধী কার্যক্রম জোরদার করে সিটিটিসিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ধারাবাহিক অভিযানে কোণ্ঠাসা নব্য জেএমবি আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বড় হামলার প্রস্তুতি নেয়। এজন্য গত বছরের ১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবসকে বেছে নিয়েছিল নব্য জেএমবির জঙ্গীরা, যার নেতৃত্বে ছিল সাগর ও নিলয়। যাতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রী-এমপিসহ শতাধিক মানুষকে একসঙ্গে হত্যা করা যায়। তাদের টার্গেট ছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যে জানা গেছে, আত্মঘাতী জঙ্গী সদস্য সাইফুল হামলা চালিয়ে শহীদ হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল। পরিকল্পনা মতো তিনদিন আগে খুলনা থেকে ঢাকায় আসে সাইফুল। মিরপুরে এক বন্ধুর মেসে একরাত থাকে সে। পরদিন বোমাসহ হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে ওঠে। সেখান থেকে ১৫ আগস্ট সকালে ব্যাগ নিয়ে ধানম-ি ৩২ নম্বরে যাওয়ার কথা ছিল তার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন শ্রদ্ধা জানাতে ধানম-ি ৩২ নম্বরে যাবেন, সে সময় গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটনোর জন্য সাইফুলকে বলা হয়েছিল। কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই নেতাকর্মী ও নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের কাছাকাছি গিয়ে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ভিআইপি অর্থাৎ মন্ত্রী-এমপিসহ অনেক লোককে হত্যা করা যায়। জঙ্গীদের ধারণা ছিল নেতাকর্মীদের বেশি ভিড়ের কারণে বিস্ফোরণের পর হুড়োহুড়ি বা পায়ের তলায় পিষ্ট হয়েও কিছু লোক মারা যেত।
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, গত বছরের ১৫ আগস্ট শোক দিবসে ভয়াবহ এই হামলার পরিকল্পনাটা ছিল আকরাম হোসেন নিলয় নামে এক শীর্ষ জঙ্গী। নিলয় গত বছরের ১৫ অগাস্ট ঢাকার পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে বিস্ফোরণের ঘটনায় এবং অর্থের যোগানদাতা বলে পুলিশের দাবি। নিলয়ের বাড়ি কিশোরগঞ্জে, সাগরের বাড়ি জয়পুরহাটে বলে পুলিশ জানিয়েছে।