নেপাল-ভুটানে ফ্লাইট পরিচালনায় নীতিমালা আসছে

20

কাজিরবাজার ডেস্ক :
নেপালে বাংলাদেশের ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্তের অভিজ্ঞতা থেকে এই দেশের এবং ভুটানে ফ্লাইট পরিচালনায় কিছু বিধি নিষেধ আরোপ হতে যাচ্ছে। কিছু শর্ত পূরণ হলেই এই দুই দেশে বিমান পরিচালনার অনুমতি দেয়া হবে।
নেপালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্তের পর কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন এবং ভুটানের পাবো বিমানবন্দরের ঝুঁকি বিবেচনায় এই নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ- বেবিচক।
এই দুটি বিমানবন্দরে অবতরণ ও উড্ডয়নের জন্য নতুন করে নিরাপত্তামূলক কিছু নির্দেশনা থাকছে এই নীতিমালায়।
তবে কী কী শর্ত দেয়া হবে বিমান সংস্থাগুলোকে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। নেপালে বেবিচকের একটি দল কাজ করছে। তারা প্রতিবেদন দিলেই এই নীতিমালা চূড়ান্ত হবে।
গত ১২ মার্চ ইউএস বাংলার বিমান ত্রিভুবনে অবতরণের ঘটনায় ২৬ জন বাংলাদেশিসহ মোট ৫১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১০ বাংলাদেশি।
এই বিমানবন্দরে এখন পর্যন্ত ৭০টি প্রাণঘাতি দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ইউএস বাংলার বিমানটি যে দুইজন বৈমানিক নিয়ে সেখানে গিয়েছিল, তাদের একজন পৃথুলা রশীদ একেবারেই নবীন। তিনি ২০১৬ সালে বৈমানিক হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন আর এর আগে তিনি তখনও নেপালে অবতরণ করেননি।
আবার ফ্লাইটটির ক্যাপ্টেন অভিজ্ঞ আবিদ সুলতান থাকলেও বিমানটি পৃথুলা অবতরণ করাচ্ছিলেন কি না, এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, বিমান অবতরণের সময় সচরাচন কনিষ্ঠ পাইলট এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল বা এটিসির সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু ত্রিভুবনে ইউএস বাংলার বিমানটি বিধ্বস্তের আগে এটিসির সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন আবিদ সুলতানা।
এই দুর্ঘটনার পর গত ১৫ মার্চ দেশে এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়েছে। তার দুই দিন আগে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভবিষ্যতে এই ধরনের ঝুঁকি এড়াতে উদ্যোগী হওয়ার নির্দেশ দেন।
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বার্তা এমন বার্তা আসার পর এই বার্তা পেয়েই বেবিচক ত্রিভূবন ও পারোর জন্য বিশেষ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়।
বর্তমানে কাঠমান্ডুতে দেশীয় এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা, রিজেন্ট এয়ার ও রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করে। তবে ভুটানে এখন পর্যন্ত কোনো এদেশীয় এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করে না।
তবে ঝুঁকিপূর্ণ এই দুটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনার বিষয়ে কোনো নীতিমালা ছিল না এতদিন। কোন সংস্থা এই দুই রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পাবে, পাইলট হিসেবে যারা বিমান যাবেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি নিষেধ ছিল না।
বেবিচকের এক কর্মকর্তা বলেন, নেপালের রাজধানী শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে কাঠমান্ডু উপত্যাকায় ত্রিভুবন বিমানবন্দরটি অবস্থিত। চারদিকে পাহাড়ঘেরা এই বিমানবন্দরটি নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণ।
এখানে অবতরণের সময় যেমন সতর্ক থাকতে হয়, তেমনি উড্ডয়নকালে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে হয়। এ কারণেই এখানে অবতরণের আগে প্রত্যেকটি এয়ারলাইন্সের বৈমানিককে কিছু প্রশিক্ষণ ও নিয়ম-কানুন জানতে হয়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বেবিচক মনে করছে, এই ধরনের প্রশিক্ষণের বাইরেও আরও কিছু নতুন নিয়ম যুক্ত করতে হবে।’
‘বেবিচকের একজন কর্মকর্তা এই মুহূর্তে নেপালে রয়েছেন। তিনি সেখান থেকে ফিরে আসলে এ বিষয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন দেবেন। যা নিয়ে পরবর্তীতে আমরা কাজ করব।’
নিয়ন্ত্রক সংস্থা মনে করে, ভবিষ্যতে কেউ এসব রুটে ফ্লাইট পরিচালনার আগে পাইলট ও কো-পাইলটকে সুনির্দিষ্ট ঘণ্টা ফ্লাইট পরিচালনা, বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হবে। নতুবা এসব রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হবে না।
বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন সাহাবউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের ভৌগলিক অবস্থা, বিমানবন্দর সম্পর্কে বৈমানিকের সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা দেওয়া থাকে। উড়োজাহাজের অবতরণ ও উড্ডয়নে সেটি সঠিকভাবে অনুসরণ করাটাই নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’
‘তবে এসব রুটে ফ্লাইট পরিচালনায় বৈমানিককে যেমন দক্ষ চালক হতে হবে তেমনি পাহাড়ের চূড়ার পাশ কাটিয়ে অবতরণ করতে হয় বলে মানসিক শক্তিও জোরালো হতে হয়।’
ভুটানের পাবো বিমানবন্দরের চ্যালেঞ্জ কী- জানতে চাইলে এই বৈমানিক বলেন, ‘কখনও দুই চূড়ার ফাঁক গলে, কখনও উঁচুতে উঠে আবার কখনও নিচুতে নেমে পাহাড়ি আকাশ পাড়ি দিতে ভুটান যেতে হয়। বিশেষ প্রশিক্ষণ না থাকলে এই বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ অবতরণ ও উড্ডয়ন সম্ভব নয়।’
‘মনে হয় এই বুঝি উড়োজাহাজ পাহাড়ের আগে আছড়ে পড়বে। যে কারণে বিমানবন্দর নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার মতে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম বিমানবন্দরের একটি।’
২০১১ সাল পর্যন্ত পাবোতে উড্ডয়ন এবং অবতরণের কাজ করতে পারতেন মাত্র আট জন বৈমানিক। পরবর্তীতে সে সংখ্যা বাড়লেও, ওই দেশের রাষ্ট্রীয় বিমানসংস্থা দ্রুক এয়ার ছাড়া অন্য কোনো এয়ারলাইন্স এখানে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করে না।
এছাড়া দিনের আলো ছাড়া অন্যসময় যে কোনো ধরনের উড্ডয়ন অবতরণ নিষিদ্ধ এই বিমানবন্দরে।
এ বিমানবন্দরে বিমান অবতরণকালে পাইলট কর্তৃক বিশেষ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থেকে যায়। এজন্য সম্পর্কে পাইলট, কো-পাইলটসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আগেই বিস্তারিত জানানো হয়।
এ বিষয়ে কথা বলতে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আসিফ বলেন, ‘বেবিচক যে ধরনের নীতিমালাই তৈরি করুক না কেন তা মেনেই তারা অতীতে যেমন ফ্লাইট পরিচালনা করেছি, ভবিষ্যতেও তাই করব।’
বাংলাদেশ এয়ারলাইন পাইলট অ্যাসোসিশনের (বাপা) সাবেক সভাপতি ক্যাপ্টেন নাসিম বলেন, ‘ নিরাপত্তার জন্য বেবিচকের যেকোনো উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।’
‘যদিও ভুটানে আমাদের দেশীয় এয়ারলাইন্সের কোনো ফ্লাইট নেই, কিন্তু এ ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাপনা থাকলে তা পরবর্তীতে কাজে লাগবে।’