ইতালী রোমে আইসা আমার আশা পুরাইছে

79

আইরিন আসাদ
২০১৪ সালে যখন প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে ইতালির রাজধানী রোমে অবতরন করি আমার হ্নদয়ে ও বেজে উঠেছিল সেই ৮০ দশকের বাংলা ছায়া ছবির সেই কাল জয়ী গান। ছোট বেলা বাংলাদেশ টলিভিশনে দেখেছিলাম রাজ্জাক ও অঞ্জনা অভিনিত পুর্ন্যদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়া ছবির পর্দায় গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে এসে গান টা গেয়েছিল ।
ইতালী আশার সময় যতই ঘনিয়ে আসলো মন খারাপ হতে লাগলো কিভাবে দেশের মানুষ, আত্মীয়- স্বজন রাস্তাঘাট, চিরচেনা শহর, মা, মাটি, দেশ ছেড়ে ভিন্ন ভাষা, অচেনা এ শহরে কত আশা।
কিন্তু ইতালীর মানুষ আমার দেশ ছেড়ে আশার কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে তাদের ব্যবহারে ও আন্তরিকতা দিয়ে।
আমি নতুন সবে মাত্র দোকানে বসতে শুরু করেছি এখানকার মানুষের ভাষা কিছুই বুঝিনা আর ভাষা বলতে না পারা না বুঝায় নিজেকে বাকরুদ্ধ মানুষের মতো মনে হতো।
কিন্তু এখানকার মানুষ গুলোর সুমধুর ব্যবহার এতটা আমাকে মুগ্ধতা দিয়েছে যার দরুন আমার ভাষা না জেনেও দোকান চালাতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি।
দোকানের সাজানো রকমারি মাল পএের নাম-মূল্য জানি না কিন্তু রোম শহরে বসবাস করা মানুষ গুলো আমায় বুঝতেও দেয়নি আমি যে নাম আর দামে অজ্ঞ। আমার দোকানে মালামাল কিনতে আসা ক্রেতাসাধারণ আসা- যাওয়ার সময় কত হাজার, লাক্ষ, ধন্যবাদ, আরো কত কি। মনে হয় আমি ওদের কাছে জিনিস পত্র বিক্রি করেছি বলে তারা ধন্য।
আমাদের দেশে মেয়ে হয়ে জন্মানোটা কতটা দুর্ভোগের? আমি তা দেখেছি প্রতিটা পড়তে পড়তে। একা একা কোথায় যাওয়া নিষিদ্ধ, সন্ধ্যার পর বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ। নুতুন জামা- কাপড় বা একটু গাড়ো লিবিস্টিক লাগালে বখাটের দল বাকা চোখে দেখে। রাস্তায় বেড় হলে নিরাপদে বাসায় ফিরে আসা যাবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই, নিরাপত্তাহীনতা ভুগতে হয় প্রতিনিয়ত আশঙ্কা যেকোনও মুহূর্তে দুষ্কৃতিরা হামলা চালাতে পারে।
আমার দেশে নারী/ মেয়েদের জীবনের সিংহভাগ সময় একই ছাদের নিচে থেকে নিয়মের জাতা কলে কাটাতে হয়,ঠিক তখনি বন্দী জীবনে একটুখানি জীবন বৈচিত্র্যের ছোঁয়া ।
ইতালী না আসলে আমি হয়তো জানই হতোনা জীবন কতটা মধুময়। ইতালি এসে ইসলাম ও বাঙ্গালী ঘরের মেয়ে হিসেবে সকল রীতিনীতি ১০০ ভাগ মানার পরেও আমার নারীজন্ম স্বার্থকতা পেয়েছে, ঐশ্বর্যময় বলে মনে হয় নিজেকে।
আমরা একটা বিধর্মীয় দেশে অবস্থান করার পরেও শালীনতার মধ্য থেকে সর্বোচ্চ আনন্দ উপভোগ করতে পারছি রাত- দিন স্বাধীন ভাবে পথ চলতে পাচ্ছি, দিব্বি কাজ করে যাচ্ছি। এর চেয়ে বেশি আর কিছু পাওয়ার থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আল্লাহ তায়ালার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। বাংলার মধ্যযুগের এক কবি বড়ু চণ্ডীদাস উচ্চারণ করেছিলেন মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী।
বাঙ্গালী এই বানী উচ্চারন করলেও এর সত্যতা পেয়েছি প্রবাস জীবনে ইউরোপের দেশ ইতালিতে, শুনেছি ইউরোপের দেশ গুলি এমনি। এখানে নারী কি পূরুষ প্রার্থক্য নেই। সকলি সমান আমি নারী বলে কোন বাধা নেই বরং আমি নারী বলে আমার স্থান সব জায়গাই প্রথমে কি অফিস, আদালত, পুলিশ,কিংবা জনতার মাঝে।
একটা কথা না বললেই নয়, জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পারাপার হওয়ার সময় নিজেকে রাস্তার মালিক বা রানী মনে হয়, কারন আমাকে রাস্তা পারাপারের সময় গাড়ীগুলি থেমে আমাদের রাস্তা পারাপারে সহযোগিতা করে সাথে উপহার স্বরুপ একগাল হাসি।
তখন মেয়ে হয়ে জন্মানোর দু:খটা আর থাকেনা।
জিলেপির প্যাচের মতো পুড়ানো ঢাকা শহরে নির্মিত শহরের ভেতরের অলি-গলি, রাস্তার বিভিন্ন মোড়। লালবাগে বেড়ে উঠা আমি,আমার কাছে লালবাগকেই মনে হতো বাঙ্গালীর শত বছরেরর পুরনো ঐতিহ্য যাহা আপন মহিমা নিয়ে দাড়িয়ে আছে । লালবাগকেল্লা কে অনেক পুরনো ঐতিহ্য ভেবে গর্ব করতাম কিন্তু ইতালী এসে সেই ধারণা টা পালটে গেল নিমিষে। ইতালীতে আছে আরও বহু পুরনো ঐর্তিহ্য রোমান সভ্য ও প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যোদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন । প্রতিটা রাস্তা ঘাটে ঐতিহ্যের ছোয়া তার পরেও নিজেকে মানিয়ে নিতে একটুও কষ্ট হয়নি।
এই অল্প সময়ে আমি রোমে বা রোমে বাইরের শহর গুলিতে বেড়াতে গিয়েছি খুব কম, তবুও নিজের পরিবারকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি মনের মাধরী মিশিয়ে পাহাড়-পর্বত নদী, ঝর্না, সাগর, গভীর অরণ্যে প্রাচীন নগরীতে।
ব্যস্ত নগরীর কর্মময় ব্যস্ততার মাঝে যখন একাকীত্বে থাকি তখন মনে মনে ভাবি ইতালীতে না আসলে হয়তো আমার মেয়ে হয়ে জন্মানোটা দরুন আজীবন ভর নিজেকে সমাজ পরিবার রাষ্ট্রের বোঝা ও কারাগারে শিকলে বন্ধী মনে হতো। এক নিষিদ্ধ নগরীতে বসবাস যে নগরীতে মেয়েদের বলা নিষেধ, শুনা নিষেধ, নিজের ইচ্ছা মতো চলা নিষেধ।
এক কথায় ইতালীতে না আসলে আমার নিজেকে মনে হতো কেবল খাঁচায় আটকানো ডানা- ভাঙ্গা এক পাখি।
যাকে ডানাদিয়ে আল্লাহতায়লা পাঠিছিলেন ঠিকি কিন্তু আমাদের দেশের সেই সমাজ ভেঙ্গে দিয়েছেন স্বপ্নহীন ডানা ভাঙ্গা পাখি। ব্যথার যন্ত্রণায় বেঁচে থাকবার ইচ্ছাটাও আজ ভুলুন্ঠিত হতে পারতো নীলাকাশে উড়বার স্বপ্নটা হয়ে যেতো ফিকে।
আমাদের দেশের সমাজিকক ব্যবস্থার বিধি নিষেধের জন্য এতো সুন্দর একটি দেশের মানুষ হয়েও আমার চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি অপরূপ সৌন্দর্যের আমাদের বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই রয়েছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। প্রাচীন স্থাপনা, পাহাড়ে-আহারে, নদীতে নৌকা ভ্রমণ, সবুজের মাঝে জ্যোৎস্নার খেলা, এমনকি মেঘের রাজ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলার মতো চোখ জুড়ানো পর্যটন স্থান রয়েছে। বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্রসৈকত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা পর্বত আকাশ-পাহাড়ের মিতালি, ইট কাঠের বাশের তৈরি কারুকাজ,ইমারত, মসজিদ,মন্দীর, গিরজা মত স্থাপনা।
মাছ, গাছ, পাখ-পাখালির কলতান, রাখালীয়ার বাশের বাশী, গায়ের মিঠো পথ নানান সম্পদের ভাণ্ডা,উষ্ণ বালির বুকে সূর্য যেথায় ওঠেন হেসে।
তবে ইতালিতে দেখেছি যেন দুধের সাধ গোলে মিটানো।
হঠাৎ রবী ঠাকুরের একটা কবিতা মনে পরছে-
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া , ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিসের উপরে , একটি শিশির বিন্দু। বহুদিন ধরে’ বহু ক্রোশ দূরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে…..।