বাঙালি জাতিস্বত্ত্বা বিকাশে ভাষা আন্দোলনই যুগান্তকারী মাইলফলক

83

পিযুষ চক্রবর্তী

হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষা-ভাষী বাঙালি জাতির অভ্যন্তরে যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লালিত হয়ে আসছিল, কার্যত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই তার বহি:প্রকাশ ঘটেছে। মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে বায়ান্ন’র মহান ২১ ফেব্র“য়ারী মুখের ভাষা বাংলা রক্ষায় ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঢাকায় রাজপথে মিছিলে যোগ দেয়। পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে আত্মোৎসর্গ করেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এমনকি নাম না জানা আরো অনেকেই তাঁদের মহান আত্মদানের কথা আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের স্বীকৃতির ফলে কার্যত ভাষা শহীদরা ও বিশ্বব্যাপী বিরল সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন। ইতিহাসের শরণাপন্ন হলে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, ব্রিটিশ আমলেই ব্রিটিশমুক্ত ভারতে লিংগুয়াফ্রাঙ্কা হিসেবে হিন্দি-উর্দুর পাশাপাশি বাংলাভাষার প্রস্তাব করেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারী ভাষা আন্দোলনের অনিবার্য সুফল হিসেবে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরণের বৈষম্য মতানৈক্য চলতে থাকে বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষা মর্যাদাসনে রাখার ক্ষেত্রে।
১৯৪৭ সালে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক বিভিন্ন সভা-সমাবেশের মাধ্যমে বাংলা ভাষার দাবি তুলে ধরার চেষ্টা করে। তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাসেমের সম্পাদনায় তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে একটি পুস্তিকা বের হয় যার শিরোনাম ছিল “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু।” ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মজলিসের উদ্যোগে ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট এবং প্রদেশ ব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ একটি মাইলফলক। এ ধর্মঘটের কারণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এগিয়ে আসেন এবং রাষ্ট্রভাষা-সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ৭ দফা চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তিতে উর্দুর সঙ্গে বাংলাভাষাকে ও সমান মর্যাদা প্রদান এবং পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে চালু করার প্রতিশ্র“তি দেওয়া হয়। ফলে এ দেশের মানুষ ধরে নিয়েছিল তারা তাদের মুখের ভাষার মর্যাদা ফিরে পাবে। কিন্তু সরকার অচিরেই এদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খা পদদলিত করল। পাল্টে গেল দৃশ্যপট। ২১ মার্চ পাকিস্তানের জনক ও তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলা সফরে এলেন। তখন কার্জন হলে আয়োজিত বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অপর কোন ভাষা নয়।’ কায়েদে আযমের এ ঘোষাণা ছিল এ দেশের মানুষের স্বপ্ন আশা-আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে প্রচন্ড আঘাত। তাই এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠল দেশ, ফের শুরু হল ভাষা আন্দোলন। প্রতিবাদ প্রতিরোধে কেঁপে উঠল সারাদেশ, ভাষার দাবিতে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ ও শ্লোগানে বাংলার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠল। মানুষ আশা করেছিল সরকার এ দেশের জনগণের দাবিকে মর্যাদা দেবে এবং বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে নিবে। ঘটনা ঘটল উল্টো। এরই মধ্যে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত হল নিখিল পাকিস্তান মুসলিমলীগের ঢাকা অধিবেশন। এখানে বক্তৃতা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’
দেশের মানুষ আরেকবার হতাশ হল। তারা আর স্থির থাকতে পারল না। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রতিবাদে আবার জেগে উঠল দেশ। ৩০ জানুয়ারী ঢাকায় পালিত হল প্রতিবাদ দিবস। এখানেই থেমে থাকেনি দেশের মানুষ, তাদের ক্ষোভ ও বিদ্রোহ তীব্র হতে থাকল। ফলে ভাষার আন্দোলন আরও সংগঠিত হল। ৩১ জানুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ জাতীয় পর্যায়ে গিয়ে গঠিত হল সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ নামে। শুরু হল নতুন উদ্যমে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। ১৯৪৮ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী ছাত্র-কর্মীরা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় ভাষার দাবি বেগবান হয়েছিল। লক্ষ্য অর্জনে সচিবালয় ঘেরাও হলে তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও অলি আহাদ সহ অনেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলন পরিচালনায় যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল, সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী। বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার দাবির চেতনার মূলে বিশেষভাবে কাজ করেছে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। সামগ্রিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটা বলা যায়, এই আন্দোলনের স্বাপ্নিকরা এবং লালন ও চর্চাকারী সবাই সচেতন মানুষ ছিলেন। সে কারণে ভাষার অধিকারের পথ ধরেই গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অধিকারের দাবি উচ্চকিত হয়েছিল। শুরু হয়েছিল স্বায়ত্ত্বশাসন ও স্বাধিকারের সংগ্রাম। এরপর সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে রাজনৈতিক ও গবেষকদের বিশ্লেষণের সূত্র ধরেই বলা যায়। ভাষা আন্দোলন কেবল নিছক একটি আন্দোলন অথবা ভাষারই আন্দোলন ছিল না, বরং চেতনাসঞ্চারী এই আন্দোলন, ভেতরগত অবিনাশী চেতনার স্মারক হয়ে রয়েছে। এই চেতনা স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বটে। ভাষা আন্দোলন প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রযন্ত্রের সব প্রতারণার বিরুদ্ধে বিজয়ের নির্দেশক।
মহান ভাষা আন্দোলন এবং এরই পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জন বিশ্ব দরবারে আমাদের গৌরবকে অনেক উচ্চে তুলে ধরেছে। আরও বেশি গর্বিত হয়েছি, যখন আমাদের ভাষা দেশের গন্ডি পেরিয়ে গোটা বিশ্বের কাছে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলা এখন আন্তর্জাতিক ভাষার স্বীকৃতি পেয়ে গৌরবের আরেক ধাপে উত্তীর্ণ হয়েছে। এ মহান কাজে যারা অবদান রেখেছেন তারাও বাংলাদেশি। তারাও এ জাতির কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
গোটা বিশ্বে বাংলা ভাষা-ভাষী জনগণের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে পাকিস্তান, বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অষ্ট্রেলিয়ায় বিপুল সংখ্যক বাঙালির বসবাস। মধ্যপ্রাচ্যের সবক’টি দেশ মালয়েশিয়া, কোরিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের জন্য বিপুল সংখ্যক শান্তি বাহিনীতে বাংলাদেশের বাংলা ভাষী সৈনিকদের কর্মকান্ডের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আফ্রিকান দেশ সিয়েরা লিয়ন বাংলা ভাষাকে সেদেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর আগে থেকে পাকিস্তান ও ভারতে বাংলাভাষা অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এদিক থেকেও বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে মর্যাদার দাবিদার।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রদেশব্যাপী ‘রাষ্ট্র ভাষা দিবস’ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করল। অথচ সরকার জনগণের এ দাবিকে নস্যাত করার জন্য একই দিন ঢাকা শহরে সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা সহ জারি করল ১৪৪ ধারা। কিন্তু তাতেও মানুষের ক্ষোভ থেমে থাকেনি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বাধা আসে পুলিশের। বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতাকে দমন করতে পুলিশ মিছিলের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্র জনতার মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতেও ছাত্রসহ ৪ ব্যক্তি নিহত ১৭জন আহত এবং গ্রেফতার হয় ৬২ জন।
পুলিশের গুলিতে যারা শহীদ হন তারা হলেন রফিক উদ্দিন আহমদ (মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র), আব্দুল জব্বার (গ্রামীন কর্মচারী), আবুল বরকত (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এম.এ ক্লাসের ছাত্র) মোহাম্মদ সালাউদ্দিন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এম. এ ক্লাসের ছাত্র) এবং আব্দুস সালাম (শুল্ক বিভাগের পিয়ন, আহত অবস্থায় ৭ এপ্রিল মারা যান)। ২২ তারিখ নিহতদের গায়েবানা জানাযা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। জানাযার পর লক্ষাধিক মানুষের এক বিশাল শোভাযাত্রা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। এ ঘটনার পর সরকারের ক্ষমতার ভিত নড়ে ওঠে। এ দেশের মানুষ বুঝতে পারে পাকিস্তানী শাসকদের হাতে তাদের ভাষা-স্বাধীনতা এবং মান-মর্যাদা নিরাপদ নয়। তাই ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। এরই ফলশ্র“তিতে ১৯৭১ সালে বাঙালি মুক্তি সংগ্রামের চেতনায় উজ্জীবিত হয়। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রায় ১ কোটি লোক শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। ৩০ লক্ষ লোক শহীদ এবং অগণিত লোক আহত হন। ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ও প্রতিবেশী দেশ ভারতের সহযোগিতায় বাংলার মানুষ অর্জন করে মহান স্বাধীনতা। মূলত ভাষা আন্দোলনের চেতনা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য এবং সমৃদ্ধির। জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জনের বিবেচনায় বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে স্বীয় ভাষার উৎকর্ষের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ভাষার দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। জাতীয় প্রতিষ্ঠার অন্তর্গত চেতনা ধারণ করে আছে যে ভাষা আন্দোলন তার প্রতিষ্ঠায় জাতিকে জ্ঞানে, গুণে, মেধায়, মননে, সুখ্যাতি সুনামে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শীর্ষে উদ্ভাসিত করা প্রয়োজন। জাতিকে একুশের ঐক্যবদ্ধতার মত জাতীয় উন্নয়নের পথকে ত্বরান্বিত করতে হবে। ভাষা আন্দোলনই সূদুর প্রসারী স্বাধীনতা ও জাতি স্বত্ত্বার বিকাশায়নে এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত। ভাষা সৈনিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামীরা আমাদের সবার কাছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় চির ভাস্বর, চির অম্লান।