সাইফুল ইসলাম শ্রীমঙ্গল থেকে :
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলা শৈত্য প্রবাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে মৌলভীবাজার জেলার প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকার হাওর বাওর ও চা বাগান এলাকার চা শ্রমিকদের জনজীবন। বিশেষ করে শ্রীমঙ্গলে কনকনে ঠান্ডা আর হাড় কাপানো শীতে চা শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষরা কাবু হয়ে পড়েছে।
শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘বুধবার শ্রীমঙ্গলে তাপমাত্র ৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়েছে। ৯ জানুয়ারী মঙ্গলবার তাপমাত্রা ৬.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৮ জানুয়ারী সোমবার ছিল ৫.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
এর আগে গত ৪ জানুয়ারি ৮.৬ ডিগ্রি, ৫ জানুয়ারী ৯.৪ ডিগ্রি ৬ জানুয়ারী ৯.৪ ডিগ্রি, ৭ জানুয়ারী ৭.৬ ডিগ্রি ছিলো। তিনি আরও বলেন, চলমান শৈত্যপ্রবাহটি আরও দু-একদিন চলতে পারে।তবে দেশের বেশির ভাগ এলাকাতেই তাপমাত্রা ধারাবাহিকভাবে বাড়তে পারে। শুক্রবার থেকে দেশের বেশি এলাকায় তাপমাত্রা স্বাভাবিক ও সহনীয় মাত্রায় শীত থাকতে পারে তিনি বলেন।’
বুধবার সকাল বেলা জেলা শহরের অধিকাংশই দোকানপাট বন্ধ দেখা গেছে। ঘন কুয়াশার মধ্যে বাসগুলো হেডলাইট জ্বেলে চলাচল করলেও রিকশাগুলোকে দেখা গেছে অলস দাঁড়িয়ে থাকতে।
বিশেষ করে বোরো চাষীরা প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে কাজ করা নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। একই অবস্থা জেলার চা শ্রমিকদেরও। কনকনে শীতের মধ্যে সকাল থেকেই কাজে যেতে হচ্ছে তাদের। শীত অনুযায়ী তাদের প্রয়োজনীয় গরম কাপড় না থাকায় কৃষিজীবী, শ্রমজীবী ও চা শ্রমিকদের পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ। প্রচন্ড এই শীতের হাত থেকে রক্ষায় জেলার নি¤œ আয়ের মানুষের পাশে সরকারসহ প্রবাসীরা এগিয়ে আসবেন এমনটাই দাবী শীতার্তদের।
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে শীতের কারণে মানুষকে নানা রকম দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে। শীতবস্ত্রের অভাবে কেউ কেউ খড়কুটো জ্বেলে শীত ঠেকানোর চেষ্টা করছে। অনেকে অসুস্থ হয়ে ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে।
শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের পশ্চিম ভাড়াউড়া গ্রামের কৃষক তাহির আলী (৫০) ও একই ইউনিয়নের বালুচর গ্রামে ইকরাম আলী বলেন, ‘এমন ঠান্ডা কোনো দিন পাইনি। যেমন কুয়াশাও পড়িছে, তেমনি হিমেল বাতাসে গায়ে-পায়ে কোঁকড়া হইয়ে আইতেছে। আমরা প্রতিদিন সকালে হাওরে বোরো চাষের জন্য ক্ষেতে ধান রোপন করি। শীত লাগলেও কি হবে খাইতে হবে না।’
মৌলভীবাজার পৌর শহরের রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ৪০ বছর বয়সী রফিক আলী।
তিনি বলেন, প্রচন্ড ঠান্ডায় রাস্তাঘাটে মানুষ বের হচ্ছে না। যদিও কেউ বের হচ্ছে, তারা রিকশায় উঠছে না। ঠান্ডা উপেক্ষা করে সকাল থেকে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো যাত্রী পাননি। আর একই কথা জানালেন কমলগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা রিকসা চালক সুমন মল্লিক।
শ্রীমঙ্গল ভুরভুরিয়া চা বাগানে শ্রমিক সবিতা রাণী বলেন,‘শীতের মাঝে কাঁপিয়া কাঁপিয়া আইয়া আমরা কাজ করিয়া যাইগি। এই কথা কারে কইমু আমরা। সংসারে ছেলে-মেয়ে ৫জন। একজন রুজি করলে ৫ জনে খাইতে হয়। চা বাগানে একজনের সরকারী কাজ আছে। আর একজনের রোজি দিয়াতো চলে না। এজন্য আমরা শহরে ইট ভাংতে আইছি।প্রতিদিন আমরা ১২০ টাকা রুজি করি। বাগানে-তো সপ্তাহে টাকা দেয়,ডেইলিতো টাকা দেয় না। আর একই কথা জানালেন ভুরভুরিয়া চা বাগানের রীতা রাণী ও রিয়া বাউরীসহ অনেকে।’
শ্রীমঙ্গল পৌর শহরের নৈশপ্রহরীরা খড়কুটো জ্বেলে আগুন পোহাতে পোহাতে শফিক মিয়া বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। ঠান্ডায় ডিউটি করতে পারি না। পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে আছে।’
এদিকে, শীতে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তাদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা বেশি। গেল সোমবার সকালে সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের রোগী স্বজনরা বলেন,‘প্রচন্ড ঠান্ডায় আমার ছেলেটা সকাল থেকে বমি আর পাতলা পয়খানা করছে। তাই হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। ডাক্তার জানিয়েছে তার নিউমোনিয়া হয়েছে। তারা আরও বলেন, ‘হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে একেকটি বিছানায় ২/৩ শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’
মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার পলাশ রায় মুঠোফোনে বলেন, ‘ঠান্ডায় নিউমোনিয়া, হাঁপানি ও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এসব রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। রবিবার রাত থেকে বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত প্রচুর শিশুরোগী ভর্তি করা হয়েছে। তিনি বলেন, বেশি ভাগই এরা নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। এছাড়াও অন্যান্য ওয়ার্ডে শীতজনিত কারণে আক্রান্ত আরও শিশু ও বৃদ্ধকে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বুধবার দুপুরের দিকে আমরা বলতে পারবো কতজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন আর কতজন চিকিৎসা নিয়েছেন। তারমধ্য শিশু ও বৃদ্ধ সংখ্যা কত।’
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘প্রধান মন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৩৭ হাজার ৯৯৮ পিছ কম্বল বরাদ্দ এসেছে। এর মধ্যে বিতরণ চলছে। তিনি আরও বলেন, বেসরকারী ভাবে প্রবাসীদের দেয়া শীতবস্ত্র শীতার্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। অপরদিকে দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে আরো ১২ হাজার ৭৮৯ পিস কম্বল পুরো জেলার জন্য বরাদ্দ এসেছে।’