হাজেরা সুলতানা হাসি
বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে সুবাইতা। খুবই চঞ্চল। ওর কথা বলার ভঙ্গি এতোই চমৎকার যে, কথা বলার সময় ওর অবয়ব পানে তাকিতে থাকতে ইচ্ছে করে। সুবাইতাকে এবার স্কুলে ভর্তি করাবেন, মা-বাবা ঠিক করলেন। শুনে তো ছোটমণিটার সে কী আনন্দ!! পাশের বাসার আন্টির মেয়ে- স্নিগ্ধা আপুর মতো ওরও থাকবে অনেক সহপাঠী, যাদের সাথে খুব মজা করবে। তো কোন খেলার সাথী নেই। ও ছোট বলে ওকে বাইরে বেরুতে দেওয়া হয় না। স্নিগ্ধা তো বিকেল হলেই টেনিস কোর্টে গিয়ে ওর সহপাঠীদের সাথে খেলে। ও তখন ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে, গাড়ীর ছোটাছুটি, মানুষের হৈ হুল্লোড়। এসবই দেখে ওকে বিকেলের মুহূর্তটা পার করতে হয়। এ ছাড়া যে ওর কোন উপায় নেই। ছোট বলে ও ফ্লাটের অদূরে টেনিস কোর্টে যেতে পারে না। মা-বাবার কথা হলো, আরেকটু বড় হও তারপর যাবে। সপ্তাহ খানেক পর সুবাইতার জন্মদিন।
পাঁচ থেকে ছয় বছরে পা দিবে। সুবাইতার মনে মহা খুশির ঢেউ, সেই দিনটির অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে, ওর সময় কাটে। কারণ জন্মদিন এলেই তো বড় হয়ে যাবে। তখন আর কেউ ওকে বাধা দিতে পারবে না। ছোট মনে ভাবনার মাঝে উঁকি দেয়, -ইশ, যদি দু’দিন পর পর জন্মদিন আসতো! তাহলে অল্প ক’দিনেই তো ও স্নিগ্ধা আপুর মতো বড় হয়ে যেতো। মামণি ডাকেন- সুবাইতা জ্বি আম্মু, -খেতে এসো তাড়াতাড়ি। মায়ের ডাকে সুবাইতা ছোট্ট পায়ে নাচতে নাচতে ছোটে যায়, মায়ের আহবানে সাড়া দিতে….। সুবাইতা এখন স্কুলে যায় নিয়মিত। বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, ক্লাসে গিয়ে সহপাঠীদের সাথে মজার মজার গল্প করা, সব মিলিয়ে খুব আনন্দে দিন পার করছে সুবাইতা। সুবাইতার প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শেষ হলো। ছুটিটা গ্রামের বাড়ীতে কাটালো। সারাদিন কাজিনদের সাথে খেলাধূলা, হাসি-আনন্দে মেতে উঠা, ইত্যাদিতে ছুটিটা বেশ উচ্ছ্বাসে পার করলো। বাসায় যাওয়ার দু’দিন পরই রেজাল্ট প্রকাশ হলো, প্লে-তে পঞ্চম স্থান অধিকার করলো। বাবার সাথে রেজাল্ট আনতে গেলো সুবাইতা। পঞ্চম স্থান শুনে সুবাইতার মনটা ভার হয়ে গেলো। ওর মলিন মুখ দেখে ওর বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে মামণি তোমার? মুখটা এমন ভার করে আছো কেন? সুবাইতা তখনই কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো, স্নিগ্ধা আপু কতো ভালো রেজাল্ট করে -বিশ, একুশ নাম্বার হয় অথচ আমি হলাম মাত্র পাঁচ! কথাগুলো বলে কাঁদতে শুরু করলো সুবাইতা।
সুবাইতার কথা শুনে তো বাবা ওমর ফারুক একদম আক্কেল গুড়ুম! বলে কি মেয়েটা। বলে কি মেয়েটা। মেয়েটাকে যতো বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, রেজাল্ট এর বেলায় যতো কম নাম্বার হওয়া যায়, ততোই ভালো। কিন্ত কে শোনে কার কথা!! সুবাইতা তো ভাবছে ওকে সান্ত্বনার জন্য বাবা এসব বলছেন। বাসায় পৌঁছার পর মা ও সব শুনে, বোকা বনে গেলেন। বুঝলেন, মেয়েটার স্নিগ্ধার রেজাল্ট এর কারণেই এ মনোভাব তৈরী হয়েছে। ওদের আশপাশে বাসার কোন ছেলে-মেয়ে নেই কেবল স্নিগ্ধা ছাড়া। আর দু’তিন জন আছেন মহিলা উনারা নিউ ম্যারিড বাচ্ছা নেই কারো। স্নিগ্ধা তো বরাবরই রেজাল্ট এমন করে পড়ায় তেমন একটা ভালো না। স্নিগ্ধা ক্লাস সিক্স এ পড়ে। ও ছোট বলে ওকে খেলায় স্নিগ্ধা নিতে চায় না, কিন্ত সুবাইতা ওকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। সারাক্ষণ একা থাকে তাই স্নিগ্ধাকে অল্প সময়ের জন্য কাছে পেলেও ও মহা খুশি। যাই হোক, বাসায় যাওয়ার পর থেকে কিছুই মুখে পুরছে না সুবাইতা। অনেক বুঝানোর পরও সুবাইতার একই কথা, পাঁচ হতে চায়নি স্নিগ্ধার মতো ওর বিশ পঁচিশ নাম্বার হওয়া চা-ই চাই। হঠাৎ মা পারভীনের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। তাই তিনি স্নিগ্ধার পাশে বসে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, সত্যিই মা তুই ঠিকই বলেছিস, পাঁচ তো মাত্র। আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন একশত বা দুইশত হতাম। তুমিও চাইলে এমন রেজাল্ট করতে পারবে। পদ্ধতি কিন্ত আমার জানা আছে, শোনবে তুমি? মায়ের কথা শুনে তো সুবাইতা মহা খুশি, একশত নাম্বার হলে ও স্নিগ্ধা আপুর চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকবে। তখন আর স্নিগ্ধা আপু ওকে খেলায় নিতে অনাগ্রহী হবে না। ওকে নিয়েই টেনিস কোর্টে যাবে। স্নিগ্ধা যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে মায়ের মুখ পানে তাকালো, মিষ্টি করে বললো, হ্যাঁ মা, বলে দাও আমায় পদ্ধতি। মা সোহানা খানম মিষ্টি হেসে বললেন, তুমি মন দিয়ে পড়তে হবে। আগের চাইতে দ্বিগুণ পড়তে হবে। তাহলেই তুমি পারবে একশত নাম্বার হতে। মায়ের কথা শুনে সুবাইতার খুশি আর ধরে না। মায়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো, দেখে নিও আমি একশত নাম্বার হবোই। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শেষে রেজাল্ট আনতে, বাবার সাথে স্কুলে ছুটলো মায়াবী চেহারার অধিকারী, মিষ্টি মেয়ে সুবাইতা। রাস্তার হেঁটে যেতে যেতে বাবাকে ইত্যাদি প্রশ্ন করে বাবার একদম বেহাল অবস্থা করে দিল। ধৈর্য্যের সাথে মেয়ের সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন, কারণ অভিমানী মেয়েটিকে অল্প ধমক দিলেই, সারাদিন ওর পিছে পিছে ছুটে অভিমান ভাঙাতে এই ভুলের মাশুল দিতে হয়। রেজাল্ট কার্ড দেখে তো বাবা ওমর ফারুক চমকে গেলেন! নিজের চোখকে যেনো বিশ্বাস করাতে পারছেন না। এ কি! স্বপ্ন!! নাকী নাকি মতিভ্রম!! নাকি বাস্তব?! তার একমাত্র আদুরী মেয়ে সুবাইতা, সব বিষয়ে আটানব্বই, নব্বইয়ের ঊর্ধ্বে পেয়ে এক নাম্বার হয়েছে। শুধু তাই নয় স্কুলের মধ্যে সেরা হয়েছে সবাইকে পিছু ফেলে। সুবাইতার টিচার ম্যামরা সুবাইতাকে কনগ্রাচুলেশন জানাচ্ছে। সুবাইতা যখন জানতে পারলো ও এক নাম্বারে ফাষ্ট হয়েছে। মনটা কালো মেঘে ঢেকে গেলেও এখন টিচারদের এমন কান্ডকারখানা দেখে অবাক হলো, এক হওয়াতেই এতো খুশি! তাহলে আগের বার পঞ্চম হওয়াতে খুশি হলেন না কেন?? একশো নাম্বার! হলে কি আরো বেশি খুশি হতেন??? দ্বিধার ঘোর কাটানোর জন্য কানে কানে বাবাকে বললো মনের কথা, বাবা! আমি এক নাম্বার হওয়াতে টিচাররা এতো খুশি তাহলে কি একশত নাম্বার হলে আরো বেশি খুশি হতেন? মেয়ের কথা শুনে ওমর ফারুক হেসে ওঠলেন, টিচাররা পাশে বসা ছিলেন সমস্বরে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে? কি বললো পাকনী বুড়িটা? ওমর ফারুক কিছু বলার আগেই সুবাইতার ইংলিশ টিচার পারভীন বললেন, নিশ্চয় মেয়েটা বলছে বাসায় যাওয়ার আগে মিষ্টির অনেকগুলো প্যাকেট নিয়ে যেতে হবে…? হেসে ওঠলেন সবাই ম্যমের কথা শুনে। না না তা না আসল ব্যাপার হচ্ছে… বললেন প্রথম থেকে পুরো কাহিনী এবং মেয়ের মায়ের বুদ্ধির প্রশংসা করলেন। লজ্জা আর অপমানে সুবাইতার মুখ লাল হয়ে গেলো। বাংলা টিচার সুবাইতার পাশে এসে বললেন, পড়া-লেখার ক্ষেত্রে একশ, দুইশ এসবের কোন মূল্য নেই, মূল্য হলো যারা এক, দুই ও তিন এ রকম রেজাল্ট করে তাদের। তাইতো দেখ, আজ তোমার এ রেজাল্ট এ আমরা এতো আনন্দিত। সুবাইতা নিজের ভেতর রাখা প্রশ্নকে আর চেপে রাখতে পারলো না। বাবার দিকে তাকিয়ে বললো- তাহলে মাম্মি যে বললো। মাম্মি একশ এ রকম নাম্বার হতেন আর মাম্মিকে সবাই খুব আদর করতো…? সুবাইতার কথা শুনে আবারো হাসির রোল পড়লো স্কুল অফিস কক্ষে। বাবা বললেন, তোমার মা তো তোমার ভালোর জন্যই বলেছেন, কারণ তখন তো তুমি একশ দুইশকেই মনে করতে অনেক বেশি, তাই বুদ্ধি করে এমনটা বলেছেন। বুঝলে এবার আমার পাকনী মামণি? আর এজন্য তোমার মা-কে তোমার উচিত ধন্যবাদ দেওয়া। পাশ থেকে বলে ওঠলেন অংক টিচার রাহুল। হুম তাইতো, চলো বাবা মাম্মিকে ধন্যবাদ জানাবো। হুম্ম চলো, বলে এক ঝাঁক খুশির ছ’টা নিয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন সুবাইতার বাবা ওরফে ওমর ফারুক।