হবিগঞ্জে ৪ শিশু হত্যা মামলার রায় ॥ ৩ জনের ফাঁসি, ২ জনের ৭ বছরের কারাদন্ড মূল পরিকল্পনাকারী বাঘালসহ ৩ জন খালাস

35

সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় আলোচিত ৪ শিশু হত্যা মামলায় ৩ জনের ফাঁসি (মৃত্যুদন্ড), ২ জনের ৭ বছর DSC_1773 copyকরে কারাদন্ড এবং মূল পরিকল্পনাকারী বাঘালসহ ৩ জনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মকবুল আহসান প্রায় দেড় বছর আগের চাঞ্চল্যকর এ রায় ঘোষণা করেন।
ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হচ্ছে- হবিগঞ্জের বাহুবল থানার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের আব্দুল আলী বাঘালের পুত্র রুবেল মিয়া (২০), একই এলাকার মো: ফজলুর রহমানের পুত্র সেকেন্ড ইন কমান্ড হাবিবুর রহমান আরজু (৪০) ও মৃত আব্দুল বারিকের পুত্র বর্তমানে পলাতক উস্তার মিয়া। ৭ বছরের দন্ডপ্রাপ্তরা হচ্ছে- হবিগঞ্জের বাহুবল থানার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের আব্দুল আলী বাঘালের পুত্র মো: জুয়েল মিয়া (২৫) ও একই এলাকার আব্দুল জলিলের পুত্র সেকেন্ড ইন কমান্ড সাহেদ উরফে ছায়েদ (৩০)। এবং খালাসপ্রাপ্তরা হচ্ছেন- একই এলাকার পঞ্চায়েত প্রধান আব্দুল আলী বাঘাল, বর্তমানে পলাতক বিল্লাল মিয়া ও বর্তমানে পলাতক বাবুল মিয়া। গতকাল বুধবার রায় ঘোষণার সময় পলাতক আসামীরা বাদে সকল আসামীরা আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলো।
আদালতের আদেশ থেকে জানা গেছে, আসামী রুবেল মিয়া, হাবিবুর রহমান আরজু ও উস্তার মিয়ার (পলাতক) বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় গঠিত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় প্রত্যেককে দোষী সাব্যস্ত করে তাদেরকে ফাঁসির দন্ডে (মৃত্যুদন্ড) দন্ডিত করা হয়। পাশাপাশি তাদেরকে ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত করা হলো। এই দন্ডাদেশ হাইকোর্ট বিভাগ থেকে অনুমোদিত হয়ে আসার পর উক্ত আসামীদের গলায় রশি লাগিয়ে তাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া গেল। অপর আসামী মো: জুয়েল মিয়া ও সাহেদ উরফে ছায়েদ এর বিরুদ্ধে ২০১ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত এবং তাদেরকে ৫ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো ৬ মাসের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হল। এছাড়া আসামী আব্দুল আলী বাঘাল, পলাতক বিল্লাল মিয়া ও পলাতক বাবুল মিয়া এর বিরুদ্ধে গঠিত চার্জেও অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাদেরকে চার্জেও দায় থেকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন আদালত।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত বছরে ১২ ফেব্র“য়ারি বিকেলে বাড়ির পাশের মাঠে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় সন্দ্রাটিকি গ্রামের আবদাল মিয়া তালুকদারের পুত্র মনির মিয়া (৭), ওয়াহিদ মিয়ার পুত্র জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), আব্দুল আজিজের পুত্র তাজেল মিয়া (১০) ও আব্দুল কাদিরের পুত্র ইসমাইল হোসেন (১০)। মনির সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে, তার দুই চাচাত ভাই শুভ ও তাজেল একই স্কুলে দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ত। আর তাদের প্রতিবেশী ইসমাইল ছিল সুন্দ্রাটিকি মাদ্রাসার ছাত্র। নিখোঁজের পাঁচ দিন পর ইছাবিল থেকে তাদের বালিচাপা লাশ উদ্ধার হলে দেশজুড়ে আলোচনা সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় বাহুবল থানায় ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন মনির মিয়ার পিতা আবদাল মিয়া। যার নং- ১৪ (১৬-০২-১৬)। ২০১৬ সালের ২৯ এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির তৎকালীন ওসি মোক্তাদির হোসেন ৯ জনের বিরুদ্ধেই আদালতে অভিযোগপত্র দেন। সুন্দ্রাটিকি গ্রামের ২ পঞ্চায়েত আবদাল মিয়া তালুকদার ও আব্দুল আলী বাঘালের মধ্যে পারিবারিক বিরোধের জেরে এই হত্যাকান্ড ঘটানো হয় বলে মামলার তদন্ত ও আসামিদের দেওয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পুলিশ জানিয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে আসামিদের মধ্যে বাচ্চু মিয়া নামের একজন র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। গ্রেফতারকৃত আসামিদের মধ্যে ৪ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। হবিগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এ বছরের ৭ সেপ্টেম্বর মামলার বিচারকার্য শুরু হয়। হবিগঞ্জ আদালতে মামলার ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। গত ১৫ মার্চ মামলাটি সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হলে আরও ৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
মামলাটি পরিচালনা করেন রাষ্ট্রপক্ষে এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি এডভোকেট কিশোর কুমার কর, আসামী পক্ষের এডভোকেট চৌধুরী আশরাফুল বারী নোমান ও এডভোকেট মো: শফিউল আলম।
আসামীপক্ষের আইনজীবী শফিউল আলম বলেন, এই রায় আইনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণভাবে পরিপন্থি। সাক্ষীদের সাক্ষ্য অনুযায়ী দন্ড দিলে সব আসামীকে দিতে হবে আর খালাস দিলেও সবাইকে দিতে হবে। তিনি বলেন, তিন আসামী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিলেও তা স্বপ্রণোদিত ছিলো না। এছাড়া ৫২ সাক্ষীর কেউই নিরপেক্ষ সাক্ষী নন। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ কিছুতেই প্রমাণ করতে পারেনি। এই রায়ে আমরা খুবই মর্মাহত, সংক্ষুব্ধ, হতাশ। আমরা মনে করি, উচ্চ আদালতে গেলে আসামীরা অবশ্যই খালাস পাবে। আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী স্পেশাল পিপি কিশোর কুমার কর বলেন, আমরা সকল আসামীদের অপরাধ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি। ফলে এই রায়ে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আশা করেছিলাম সকল আসামীর মৃত্যুদন্ড হবে। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পেলে পর্যালোচনা করে আমরা পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।