ন্যাপের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ ॥ মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপের অবদান ও ধর্ম র্কমসহ সামজতন্ত্রের প্রণেতা অধ্যাপক মোজাফফর

147

জেড এম শামসুল

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে এদেশের সৎ ও দক্ষ প্রগতিশীল জনমানুষের প্রত্যাশা শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে বৃটিশ তাড়ানোসহ তথাকথিত পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সংগ্রামের লক্ষ্যে ১৯৫৭ সালের ২৭ জুলাই বাংলাদেশের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে এদেশের গরিব মেহনতি মানুষের রাজনীতি কায়েম করার প্রয়াস চালিয়ে আসছে। পাকিস্তান আমলে ন্যাপের নেতাকর্মীরা হুলিয়া নির্যাতনেন শিকার কম হয়নি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রোষানল থেকের বাঁচতে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। তৎকালীন সময় প্রতি মুহূর্তে ন্যাপ কর্মীদের ওপর নেমে আসতো জেল জুলুম ও চরম নির্যাতন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ন্যাপের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়সহ গেরিলা বাহিনী গঠন করে মরণপণ্য যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছিল দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। দেশকে হানাদারমুক্ত করতে ন্যাপের অঙ্গ সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ও সাথী সংঠন সিপিবি যৌথ গেরিলা বাহিনী গঠন করে। এ বাহিনী দেশকে হানাদারমুক্ত করতে মাঠে ময়দানে ছড়িয়ে পড়ে, এদের নিহত আহতের সংখ্যা কম নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর ভূমিকা কম ছিল না। এরা এপ্রিল থেকেই করিমগঞ্জ-কাছাড়, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় প্রভৃতি অঞ্চলে সীমান্ত এলাকা জুড়ে অসংখ রিক্রুটিং ক্যাম্প গড়ে তুলেছিলেন ভারতে সরকারের সহতায়। ন্যাপ সভাপতি পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে বিশ্বব্যাপী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনূকূলে জনমত গঠন করেন এবং তার সার্বাপেক্ষা বড় কৃতিত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার নেতৃতা¡ধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে আনা। এটা না হলে মার্কিন সপ্তম নৌবহর তো বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি পৌঁছে বাংলাদেশ অক্রমণ করেই যে ভয়াবহ ধ্বংসলীলা চালাতো, তাতে যে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হত আজ তা কল্পনা করা দুরূহ। অপরদিকে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি কমরেড মানি সিংহ ছিলেন মুজিবনগরের সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ও পঙ্কজ ভট্টচার্য ছিলেন এই গেরিলা বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার। ন্যাপের অবদানের কথা যর্থাথভাবে মূল্যয়নের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগিতাকারী ন্যাপ নেতাকর্মীদেরকে সহায়তায় সরকার এগিয়ে আসবেন। ন্যাপ মানেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা মন্ডলীর অন্যতম সদস্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের অবদান লিখতেই হয়। তাই তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করলাম।
ধর্ম র্কমসহ সামজতন্ত্রের প্রণেতা অধ্যাপক মোজাফফর ৯৬ বছর বেচেঁ থাকা একমাত্র প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা মোজাফফর : ন্যশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সভাপতি এবং উপমহাদেশের বাম রাজনীতির পুরোধা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ৯৬ তম জন্মদিন পালিত হয়েছে। ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার এলাহাবাদ গ্রামে তার নিজবাড়িতে আত্মীয়স্বজন  ও ভক্তরা এবং রাজধানীর বারিধারার  বাসায় তার স্ত্রী-কন্যাসহ ঘনিষ্ঠজনেরা কেক কেটে জন্মদিন পালন করেছেন। এ ছাড়াও ন্যাপ নেতা-কর্মীরা ঢাকায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রিয় নেতার জন্মদিন পালন করেছেন। প্রবীণ এই রাজনীতিক রাজধানীর বারিধারায় একমাত্র কন্যা এবং স্ত্রী আমিনা আহমেদ এমপিকে নিয়ে বাস করছেন। তার পিতা আলহাজ কেয়াম উদ্দিন ভূঞা ছিলেন স্কুল শিক্ষক, মাতার নাম আছারুন্নেছা। তার স্ত্রী আমিনা আহমদ এমপি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের হাতে গড়া রাজনৈতিক দলের হাল ধরেছেন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ  দেবিদ্বার রেজাউদ্দিন পাইলট উচ্চবিদ্যালয় ও ভিক্টোরিয়া কলেজে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ এমএ ডিগ্রি নিয়ে ইউনেস্কর ডিপ্লোমা অর্জন করেন। বিভিন্ন সরকারি কলেজসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন তিনি । ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। চাকরি ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে আসেন ১৯৫৪ সালে। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে দেবিদ্বার আসনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী মোজাফফর আহমদ মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রীকে হারিয়ে প্রাদেষিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে তিনি অঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৮ সালে  আইয়ুবের সামরিক শাসন আমলে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয় এবং ধরিয়ে দেওয়ার জন্য  পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। তিনি আত্মগোপন অবস্থায় আইয়ুবী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। তিনি আট বছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৬৬ সালে আবার প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন । তিনি ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। ১৯৬৯-এ আইয়ুব বিরোদ্ধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। তিনি আইয়ুব খান আহূত রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিলে বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের  প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে মূল নেতৃত্বের একজন ছিলেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ- সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের নিজস্ব ১৯ হাজার গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণেল ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তিনি ১৯৭১ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে ন্যাপ- এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রাক্কালে কারাবদ্ধ হন। তিনি যুক্তরাষ্ট, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, অষ্ট্রিয়া, ভারত, দক্ষিন ইয়েমের, লিবিয়া আফগানিস্তান, মধ্যপ্রচ্যসহ পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের বহু দেশ সফর করেন। অধ্যাপক মোজাফফর সমাজতন্ত্র কী এবং কেন প্রকৃত গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জানার কথা মার্ক্সবাদী সমাজতন্ত্র ও কিছু বই ও পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন । ঘটনাবহুল বিশ্বব্যবস্থায় তার রাজনৈতিক দর্শন ও দুরদর্শিতা বাস্তবমুখী ও সময়োপযোগী বলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে তার গবেষণার বিষয় নতুন শতাদ্বীতে নতুন সভ্যতা জন্ম নিচ্ছে। তিনি দেশপ্রেমিক কর্মী সৃষ্টির জন্য মদনপুরে উপমহাদেশে একমাত্র শিক্ষায়তন সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ প্রতিষ্ঠ করেন । বিশ্বখ্যাত এই নেতার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।