পিন্টু দেবনাথ, কমলগঞ্জ থেকে :
মন ভালো নেই হাকালুকি হাওর তীরের মানুষের। বাড়তে বাড়তে ঘরের ভেতরে দখল করেছে পানি। মেঝেতে ২ ফুট পানি। কোনমতে খাটের উপর স্ত্রীসহ দিনযাপন করছিলেন। কিন্তু হাওরের বিশাল ঢেউ ঘরের বেড়া আর ভিটার মাটি ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটতে হবে। ঘরে থাকা যাবে না। জোঁক, সাপের ভয়। হাকালুকি হাওর তীরের জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের বেলাগাঁও গ্রামের মাজু মিয়া (৫০) এভাবেই জানলেন পানির সাথে লড়াই করে টিকে থাকার গল্প। হাকালুকি হাওর তীরে রাবার ড্যামের নিকট মাজু মিয়ার বাড়ি। তিলে তিলে বাড়িটি গড়েছিলেন। বন্যার ভয়াবহতা চিন্তা করেই সমতল থেকে ১০-১২ ফুট উচ্চতায় বাড়ির ভিটে বাধেন। তার আরও উপরে তৈরি করেন বসতঘর। কোন ছেলে সন্তান নেই তার। চার মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। স্ত্রীকে নিয়ে বর্তমান বাড়িতে বসবাস। বন্যার সাথে সুবিশাল ঢেউ মাজু মিয়ার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় নির্মিত বসবভিটা থেকে উচ্ছেদ করার উপক্রম। অসহায় মাজু মিয়া ঘরবাড়ি ছেড়ে কোথায়ও যেতে চাননি। দু’টি খাট রশি দিয়ে ঘরের তীরের সাথে বেধে শূন্যের উপর রেখেছেন। একটি খাটের উপর কিছু মালামাল রাখা। অন্যটির উপর নিজেরা বসে শুয়ে কোন মতে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন। পানির প্রচন্ড ঢেউ আর হাওরের বাতাস প্রতিনিয়ত তাদের তাড়া করছে। দীর্ঘদিন থেকে পানিবন্দি থাকলেও ত্রাণ বা কোন সহযোগিতা বুধবার পর্যন্ত পাননি মাজু মিয়া। বেলাগাঁও গ্রামের মহি উদ্দিন, শুকুর মিয়া, তৈমুছ আলী, ফিরোজ মিয়া জানান, তাদেরও একই অবস্থা। বন্যা যতটা না দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে হাকালুকি হাওরের এই উত্তাল ঢেউ। একটা আতংক হলো এই ঢেউ। ঢেউয়ের কবল থেকে বাড়িঘর রক্ষায় এখন তাদেও সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
বিশেষ করে হাকালুকি হাওরের দক্ষিণ তীরের কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের এই উত্তাল ঢেউ মানুষের বাড়িঘর তছনছ করে দিচ্ছে। ইউনিয়নের বড়দল গ্রামের সাইফুর রহমান, ভুকশিমইল গ্রামের জাবদ আহমদ, সেজু মিয়া, জেুবুল আহমদ, শেখ ইমন, কামাল আহমদ, কাড়েরা গ্রামের জামাল মিয়া জানান, বন্যায় ফসল গেলো। রাস্তাঘাট গেলো। এবার ঢেউয়ের কবল থেকে বাড়িঘর মনে হয় আর রক্ষা করা সম্ভব হবে না। ঢেউয়ের কবল থেকে রক্ষার জন্য মানুষ কচুরিপনা দিয়ে বাড়িঘর রক্ষার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভুকশিমইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির জানান, ইতিপূর্বে হাকালুকি হাওরের ঢেউ এই ইউনিয়নের রাস্তাঘাট ভেঙে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করলে রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়। এখন মানুষের বাড়িঘর ভাঙছে। রক্ষার কোন উপায় নেই প্রকৃতির দয়া ছাড়া।
হাওর তীরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ষান্মাসিক পরীক্ষা স্থগিত : হাকালুকি হাওর পাড়ের কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা এবং রাজনগর উপজেলার ৪৮ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ষান্মাসিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস জানায়, চলতি বন্যায় হাওর পাড়ের কুলাউড়া, জুড়ি ও বড়লেখা এবং রাজনগর উপজেলার ৪০ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা বন্যা কবলিত হয়েছে। যার ফলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও আরও ৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র। ফলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ষান্মাসিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল ওয়াদুদ জানান, বন্যা কবলিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ষান্মাসিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। পানি কমলেই এসব প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা নেয়া হবে।