কাজিরবাজার ডেস্ক :
পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তৃণমূলে শুরু হয়েছে নির্বাচনী ভাবনা। এদিকে তৃণমূলকে চাঙ্গা করতে আন্দোলনের চেয়ে নির্বাচনকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে দল গোছানোর পাশাপাশি স্থানীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে দলটি। চলতি সপ্তাহেই দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে নেতাকর্মীদের দিক-নির্দেশনা দেবেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ অনেক আগেই দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। এটাকে জাতীয় নির্বাচনের ‘ওয়ার্ম-আপ’ হিসেবে নিয়েছে দলটি।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) গত মঙ্গলবার পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। আর ইসি আগামী মার্চে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্ততি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগ : গতকাল পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে গেছে। এ নিয়ে দলটির হাইকমান্ড শুরু করেছে নানা প্রস্তুতি। শিগগিরই কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক ডেকে পৌর নির্বাচনের বিষয়ে দলের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য
মেয়র প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক নৌকা পেতে তৎপরতা শুরু করেছেন। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে লবিং শুরু করেছে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। তারা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করাকে বেশি মর্যাদার বলে মনে করছেন।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের মতোই প্রার্থী মনোনীত করবে। তার আগে জেলা ও পৌর পর্যায়ের কমিটিগুলোকে সুপারিশ পাঠাতে বলা হবে। স্থানীয় পর্যায়ের এ সুপারিশের পাশাপাশি পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট মিলিয়ে দেখা হবে। সেক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে মনোনীত প্রার্থী পরিবর্তনও করা হতে পারে।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, দলীয়ভাবে নির্বাচনের যে পদ্ধতি আছে, আওয়ামী লীগ আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে সে পদ্ধতিই অনুসরণ করবে। নির্বাচনী রূপরেখা চূড়ান্ত করার জন্য দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক চলতি সপ্তাহে হতে পারে। তিনি আরো বলেন, জেলা, উপজেলা ও পৌর কমিটিগুলোর মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হবে। মেয়রপ্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্র তৃণমূলের সুপারিশকে প্রাধান্য দেয়া হবে।
এ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, এ নির্বাচন জাতীয় সংসদের মতোই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলে মনে করি। স্বপন জানান, এ নির্বাচনে কীভাবে দলীয় প্রার্থী মনোনীত করা হবে, তা এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। রুটিন কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে। পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন স্থানীয় পর্যায়ে ছেড়ে দেয়া হতে পারে।
এদিকে পৌর তফসিল ঘোষণার পরই আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে নতুন ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রার্থীরা নির্বাচনী তৎপরতা ও মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন।
বিএনপি : একতরফা নির্বাচনের অভিযোগ এনে গেল বছরের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। এরপর শুরু করে টানা তিন মাসের আন্দোলন। ওই সময় সহিংসতায় নিহত হয় অসংখ্য নিরীহ মানুষ। পরে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি সরকারের বর্ষপূর্তিতে আবারো শুরু করে আন্দোলন। সরকারবিরোধী বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা ওই অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল ব্যাপক মাত্রায়। যে সহিংসতায় একশর বেশি মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। ওই আন্দোলনের ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে আপাতত বড় কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি। দলকে নির্বাচনমুখী করতে কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
খবর অনুযায়ী, চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া শিগগিরই দল গোছানোর বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাইবেন দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে। তিনি নিজের মামলার হাজিরা দেয়ার পাশাপাশি নেতাকর্মীদের মামলা নিয়েও কাজ করবেন, যাতে ডিসেম্বরের আগে তাদের মুক্ত করে কাউন্সিল এবং স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো যায়। এদিকে পৌর নির্বাচনের প্রাক-প্রস্তুতি হিসাবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। দলীয়ভাবে পৌরসভা নির্বাচন হওয়ায় দলের জেলা কমিটি এবং স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা করে পৌর নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রার্থী চূড়ান্ত করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন বিএনপি নেতারা। কারণ অধিকাংশ পৌরসভায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা এলাকাছাড়া। পাশাপাশি কিছুদিন ধরে বিরোধী নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতারে অনেক সম্ভাব্য প্রার্থী আটক হয়েছেন। যেসব প্রার্থী প্রকাশ্যে থাকতে পরে এমন নেতাদের প্রার্থী করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, বিরোধী নেতাকর্মীদের ধরপাকড় করে সরকার ‘একদলীয়ভাবে’ স্থানীয় নির্বাচন করার পাঁয়তারা করছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জে. (অব.) আ স ম হান্নান শাহ বলেন, বিএনপি দেশের সর্ববৃহৎ দল। সব সময়ই যেকোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি থাকে। ইতোমধ্যেই স্থানীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। খুব শিগগির স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে চেয়ারপার্সন ঘোষণা দেবেন। পৌরসভা নির্বাচনের রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। কারণ, বিরোধী জোটের কোনো প্রার্থী না থাকলে সরকার দলের প্রার্থীরা সহজেই জয়ী হতে পারবে।
এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান বলেন, ইতোপূর্বে স্থানীয় নির্বাচনে বিএনপি বরাবরই অংশ নিয়েছে এবং তাতে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলও পেয়েছে। তবে চেয়ারপার্সন যা ঘোষণা দেবেন তা-ই করা হবে। তিনি বলেন, বিরোধী দলের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া, বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা চালানো দুরূহ হয়ে উঠবে। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের মুক্তি দেয়ার দাবি জানান তিনি।
এদিকে, স্থানীয় নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি বিএনপি। দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন একথা জানিয়েছেন।
টানা আড়াই ঘণ্টা বৈঠক শেষে গতকাল বুধবার (২৫ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১১টার দিকে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এ কথা বলেন তিনি।
রিপন বলেন, বিএনপি স্থানীয় নির্বাচনে যাবে কি যাবে এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব হয়নি। তবে, তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থী মনোনয়নের আগেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, জাতীয় কাউন্সিল, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ম্যাডামের দুই মাস লন্ডনে অবস্থানসহ সব বিষয়ে আজকের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
এর আগে, বুধবার (২৫ নভেম্বর) রাত ৯টার দিকে স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ ঢাকায় অবস্থানরত শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
এতে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, ড. আবদুল মইন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, আবদুল্লাহ আল নোমান, সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদে, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, সাবিহউদ্দিন আহমেদ, বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, দফতর সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, যুব বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রমুখ।
দু’মাসেরও বেশি সময় লন্ডন সফর শেষে দেশে ফেরার পর খালেদা জিয়া দলীয় নেতাদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক বৈঠক এটি। ব্যক্তিগত সফরে গত ১৫ সেপ্টেম্বর লন্ডন যান তিনি। লন্ডনে অবস্থানকালে দুই চোখ ও পায়ের চিকিৎসা করান বিএনপি প্রধান। শনিবার (২১ নভেম্বর) রাতে দেশে ফেরেন খালেদা জিয়া।
দু’দিন বাসায় বিশ্রাম নিয়ে মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) রাতে গুলশান দুই নম্বর সেক্টরের ৮৬ নম্বর রোডে তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অফিস করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। দীর্ঘদিন পর অফিসে আসার পর তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতারা।