সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
এক সময় সিলেট বিভাগের রোগীদের জন্য ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালই ছিল একমাত্র ভরসা। কিন্তু হাসপাতালটির ভেতর বাইরের নানা অনিয়মে ক্রমেই চিকিৎসাসেবার মান ও দীর্ঘদিনের সুনাম নষ্ট হতে চলেছে। তবে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন, এখানে সিটের তুলনায় রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ। আছে ডাক্তার-নার্সসহ নানা সংকট।
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ ঘন্টার ব্যবধানে ১০ শিশু মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে দুটি তদন্ত দল মাঠে নামার পর বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। গত রবিবার দুটি তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও আরও দুদিন দেরি হবে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল সূত্র। হাসপাতালের এসব অনিয়ম নিয়ে আরও গভীরে পর্যালোচনা করতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়কে। তবে,তদন্ত প্রতিবেদনে হাসপাতালের নানা সংকটকেই দায়ি করে সুপারিশ করা হতে পারে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ডাক্তার-নার্স সংকট : ৯শ’ শয্যার ওসমানী হাসপাতালে রোগীর চাপ প্রতিনিয়তই ১২শ’ থেকে ২ হাজারের মধ্যে ওঠা নামা করে। এখানে ডাক্তার থাকার কথা ২৪১ জন, আছেন ১৮১ জন। নার্স থাকার কথা ৪৫১ জন, আছেন ৩০৬ জন। নার্সদের পদ সংখ্যা আরও বাড়ানোর জন্য তদন্ত কমিটির কাছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রস্তাবও করেছে। আর শিশু মৃত্যুর জন্য মূলত এসব সংকটকেই দায়ি করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
যত অনিয়ম : সিলেট ওসমানী হাসপাতালে নানা অনিয়ম ধরা পড়েছে এই শিশু মৃত্যুর ঘটনার পর। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওসমানী হাসপাতালে রয়েছে একটি ‘ওষুধ সংগ্রহ’ চক্র। ২য় তলার ১৭ নম্বর ওয়ার্ড, ৩য় তলার ৯ ও ১১ নম্বর ওয়ার্ড এবং ৪র্থ তলার ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডগুলোতেই এই ঔষধ চক্র বাইরে থেকে রোগীর স্বজনদের ঔষুধ কেনার জন্য স্লিপ দেন। তারা নার্সদের সাথে মিলে ডাক্তারকে দিয়ে স্লিপে ঔষধ লিখান। স্বজনরা বাইরের ফার্মেসী থেকে দামি দামি ঔষধ এনে দেন। বেক্সিটেড আইজি ইনজেকশন একটির দাম ৪০৮ টাকা, প্যাথেডিন ইনজেকশন একটির দাম ৭-৮ শ টাকা, সরবরাহ নেই, তারপরও নার্সরা স্লিপে লিখে দেন ৩/৪টা। এ রকম ঔষধ অতিরিক্ত কিনে আনার পর তা লুকিয়ে ক্লুফনাফ ইনজেকশন দিয়েই তখন চালিয়ে নেন নার্সরা। পরে এসব ঔষধ হাসপাতালের অনেক নার্সরা তাদের নিজস্ব লোকের ফার্মেসীতে ৫০ ভাগ ছাড়ে বিক্রি করে দেন। বাইরের অনেক ফার্মেসীই কয়েকজন নার্সদের স্বামীর। হক ফার্মেসী, আদনান ফার্মেসী, দৃষ্টি ফার্মেসী ও সাফরিন ফার্মেসীর মালিক হাসপাতালের নার্সদেরই স্বামীরা। ওসব ফার্মেসীতেই যাচ্ছে ওসমানীর ঔষধ।
ডাক্তারদের কমিশন : ডাক্তাররা স্লিপে বাড়তি ঔষধ লিখে দিয়ে শুধু নার্সদের কাছ থেকেই যে কমিশন নিচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। ডাক্তারদের আরও বড় কমিশন আছে বিভিন্ন নি¤œমানের ঔষধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্র থেকে। ২য় তলার ১৫ নং ওয়ার্ডের গাইনি বিভাগের রোগীদেরই বেশি পরীক্ষা লাগে। এই ওয়ার্ডের অনেক ডাক্তাররা অযথা এই টেস্ট, সেই টেস্ট দিয়ে স্লিপের পেছনে গোপন কমিশন চুক্তি করা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান। অথচ ওসমানীতেই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। বাহিরের কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে ওসমানীর অনেক ডাক্তারের ‘কমিশন সম্পর্ক’ রয়েছে। এছাড়াও নি¤œমানের ঔষধ প্রেসক্রাইব করার জন্য ডাক্তাররা অখ্যাত ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে পান উপহার।
খাবারে অনিয়ম : হাসপাতালের ৫ম তলায় খাবার ঘর। ওখানে কমদামি চাল, পচা সবজি, সস্তা লাউ, ফরমালিনযুক্ত কলা ইত্যাদি কিনে খাবারের বড় একটি টাকা যাচ্ছে খাবার সিন্ডিকেটের পকেটে। এছাড়াও হাসপাতালের অনেক খাবার স্টাফরা বাইরে নিয়ে যান বলে জানা গেছে।
ওয়ার্ড গেইটে টাকা আদায় : প্রতিটি ওয়ার্ড গেটেই ঢুকতে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ১০/২০ টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ কামরুল বলেন, ওয়ার্ড মাস্টাররা আমাদেরকে অভিযোগ না করলে এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিতে সমস্যা হয়। তারপরও বিষয়টি নিয়ে আলাপ করা হবে।
এ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড : হাসপাতালের ভেতরে কর্তৃপক্ষের এ্যাম্বুলেন্স ছাড়া কোনো এ্যাম্বুলেন্স থাকার নিয়ম নেই। কিন্তু এখানে গড়ে উঠেছে একটি অবৈধ এ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড। শুধু তাই-ই নয়, এসব এ্যাম্বেুলেন্স ৭১ সিরিয়ালের যথাযথ নিয়ম মেনেও করা হয়নি। মাইক্রেবাসকে এ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব এ্যাম্বুলেন্স চালকরাও রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো বাড়তি ভাড়া গুণছেন।
জানতে চাইলে সিলেট ওসমানী হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আব্দুস সালাম বলেন, হাসপাতালে নানা সংকট রয়েছে। দুটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। তারা হাসপাতালের সববিষয়েই তদন্ত করছেন। দুটি কমিটিই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দিবে। পরে সুপারিশ দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, গত সোম ও মঙ্গলবার ১০ ঘন্টার ব্যবধানে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ১০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। যা মারা যাওয়া রোগীর স্বজনরা বলছেন অস্বাভাবিক, আর কর্তৃপক্ষ বলছে , স্বাভাবিক। এ নিয়ে দুটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে।