ওসমানী হাসপাতালে ২৪ ঘন্টায় ১০ শিশুসহ ৩২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় ॥ চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ ॥ ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন

54

222স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৪ ঘন্টায় ১০ শিশুসহ  ৩২ জন মারা যাওয়ার ঘটনায় সিলেট জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। শিশুদের স্বজনদের অভিযোগ, চিকিৎসক-নার্সদের ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার কারণে শিশুদের মৃত্যু হয়েছে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ মানতে নারাজ। এরপরও স্বজনদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ মেডিসিন বিভাগের প্রধান ইসমাইল হোসেন পাটওয়ারীকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। শিশু ছাড়া বাকী যে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে তা স্বাভাবিক বলে  দাবি করে  হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, তারা বিভিন্ন রোগে ভোগে মারা গেছেন। মারা যাওয়া শিশুরা হচ্ছে- সিলেটের গোয়াইনঘাটের সায়মা (দেড় বছর), জকিগঞ্জের দশগ্রামের আকাশ (৭ দিন), নগরীর শেখঘাটের ফাতেমা ইয়াসমিন নিলুফার  নবজাতক মেয়ে, শাহপরান এলাকার আসমা ও সন্ধ্যা রাণীর নবজাতক মেয়ে, সুনামগঞ্জ সদরের তাজরিয়া (সাড়ে তিন বছর), মেহেদী (আড়াই মাস), ছাতকের শাফরাজ (৩ বছর), বিশ্বম্ভরপুরের নাদিনা (৬ মাস) ও হবিগঞ্জের ইয়াসমিন (৩ দিন)। তবে, সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, গত মাসে ওসমানী হাসপাতালে গড়ে ১৪ জন রোগী মারা যান। সর্বোচ্চ ২৭ জন রোগী মারা গেছেন গতমাসে একদিন।
হাসপাতাল ঘুরে জানা গেছে, প্রতিটি ওয়ার্ডে সিট সংখ্যার বিপরীতে অতিরিক্ত রোগী রয়েছেন। বিশেষ করে, ৫ম তলার তিনটি শিশুওয়ার্ডসহ বেশ কটি ওয়ার্ডে দিগুণেরও বেশি রোগী রয়েছেন। অতিরিক্ত রোগী থাকায় চিকিৎসা দিতে সংশ্লিষ্টদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে, রোগী বেশি হওয়ার কারণেই যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে তা কিন্তু নয়, নেপথ্যে রয়েছে আরও নানা কারণ। অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, চিকিৎসায় অবহেলা। গতকাল রোগীর স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করে এমনটাই জানা গেছে। প্রতিদিন ১৪ জন রোগী মারা গেলেও টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের। কী কারণে এত রোগী মারা যান, সেটা উদঘাটনে কোনো তৎপরতা ছিল না। চিকিৎসায় গাফিলতি না অন্য কোনো কারণ রয়েছে তা বের করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। গতকাল ২৪ ঘন্টায় ১০ শিশুসহ ৩৩ জনের মৃত্যুর ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হলে সিলেটসহ গোটা দেশে চলে তোলপাড়। CHik
সরেজমিনে হাসপাতালের গিয়ে দেখা যায়, ওসমানী হাসপাতালের রোগী ও তাদের স্বজনদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ছাড়পত্র না নিয়েই অনেক অভিভাবক তার শিশুকে নিয়ে হাসপাতাল ছাড়ছেন। ৫ম তলায় শিশু ওয়ার্ড আছে তিনটি। ২১, ২২ ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে নার্সদের সংখ্যা এখন বাড়ানো হয়েছে। তবে, রাতে দায়িত্বে অবহেলার অভিযুক্ত কাউকেই পাওয়া যায়নি। শিশু ওয়ার্ডে সকালেও নারী-শিশুদের গাদাগাদি ছিল। মেঝেতেও থাকার জায়গা পাচ্ছিল না অনেকে। সময় যত যাচ্ছে, এসব ওয়ার্ড থেকে রোগীরা একে একে বের হচ্ছেন। বিশেষভাবে চিকিৎসাসেবা ও আন্তরিকতা বাড়িয়ে রোগীদের রাখা যাচ্ছে না।
হাসপাতালের অনেক রোগীর অভিভাবক অভিযোগ করেন, রাতের বেলা যখন রোগীর সমস্যা হয়, তখন তারা ডাক্তার-নার্সদের ডাকাডাকি করেও পান না। একটি ওয়ার্ডে অন্তত ৪ জন নার্স থাকা উচিত, সেখানে থাকেন একজন। তাও রাতে তাকে হয় ঘুমে, না হয় মুঠোফোনে আলাপে পাওয়া যায়। ঘুম থেকে জাগালে বিরক্ত হন। ডিউটি রুমে ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও তার দরজা বন্ধ থাকে। দায়িত্বে অবহেলার কারণেই একসাথে এত শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে তারা মনে করছেন।
কয়েকজন মৃত শিশুর স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, গত সোমবার রাত ১০টার পর শিশু ওয়ার্ডে কোন চিকিৎসককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। শিশুদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তারা নার্সদেরও ডেকে আনতে পারেননি। ফলে একের পর এক শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। স্বজনদের অভিযোগ, রাত তিনটার পর থেকে ভোররাত পর্যন্ত নয়জন শিশু মারা যায়। ওই সময় কর্তব্যরত কোনো চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন না। আর নার্সদের শরণাপন্ন হলে নার্সরা তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে সকাল সাতটার সময় আসতে বলেন। শিশু আকাশের নানি মারজান বেগম বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত আমার নাতিকে সোমবার বিকেলে হাসপাতালে ভর্তি করি। রাত তিনটার দিকে সে মারা যায়। মারা যাওয়ার আগে অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় নার্সদের কাছে গেলে তারা দুর্ব্যবহার করে ফিরিয়ে দেন। এরপর দ্ইু ঘণ্টায় ৯ জন শিশুর মৃত্যু হয়।
হাসপাতালে মারা যাওয়া এক শিশুর খালা রেখা রাণী সাংবাদিকদের জানান, রাত ১০টার পর তার বোনের মেয়ে ছটফট শুরু করলে তারা ওয়ার্ডে ডাক্তার খুঁজে পাননি। শিশুটিকে দেখে যাওয়ার জন্য নার্সদের পায়ে ধরেন। কিন্তু তাৎক্ষনিক নার্সরা আসেননি। রাতে চিকিৎসক ও নার্স কোন চিকিৎসা সেবা বা ঔষধ না দেয়ায় ভোরে শিশুটি মারা যায়।
মারা যাওয়া এক শিশুর পিতা আল আমিন জানান, গত রবিবার বিকেল ৫ টার দিকে তার অন্ত:স্বত্ত্বা স্ত্রী ফাতেমাকে ওসমানী হাসাপাতালে ভর্তি করেন। শিশু বিভাগের ২২ নম্বর ওয়ার্ডে সন্তান প্রসবের পর স্ত্রীকে ২য় তলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সোমবার বিকেল থেকে বাচ্চা অসুস্থ ছিল। মুখে দুধও খাচ্ছিল না। তিনবার তিনি ডাক্তারের কাছে গেছেন। ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়েছেন। বলেছেন, বাচ্চা স্বাভাবিক আছে। মঙ্গলবার ফজরের নামাজের পরে ডাক্তার তার বাচ্চাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ছাতকের শিমুল তলার রোকেয়া বেগম বলেন, ‘আমার নাতনি অইসে। ই ওয়ার্ডে বাচ্চা হখল মারা যাওয়ার খবর হুইন্না বাড়ি যাইতাম ছাইরাম, কিন্তু নার্সরা যাইতে দেয় না।’
হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের ইন্টার্নী টিকিৎসক জাকির জানান, এই হাসাসপাতালে শিশুদের জন্য রয়েছে মোট চারটি ইউনিট। অসুস্থ শিশুরাই বেশিরভাগ সময় ভর্তি হয়। প্রতিদিন একেক ইউনিটে দু’একজন রোগী মারা যায়। এটা স্বাভাবিক চিত্র। কিন্তু সব মিলিয়ে যখন ১০ জন মারা যায় তখন একটু অস্বাভাবিক লাগলেও মাঝে মাঝে এমন ঘটনা ঘটে। প্রতিদিনই যে জন্ম মৃত্যৃর হিসেব একই ধরনের থাকে তা নয়। পুরো হাসপাতালে মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন উঠা নামা করে বলে তিনি জানান। আরো একজন চিকিৎসক জানান, ‘স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তা জানা যাবে তদন্ত কমিটির রিপোটের্র পর’। এখন এ ব্যাপারে আমরা কিছুই বলতে পারবো না।
ওসমানী হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডাঃ মোঃ আব্দুছ ছালাম ১০ নবজাতকের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, শ্বাস-প্রশ্বাস ও জন্মগত ত্র“টির কারণে এসব শিশুর মৃত্যু হয়েছে । তিনি জানান, প্রতিদিন গড়ে ওসমানী হাসপাতালে ১০ জন রোগী মারা যান। এর মধ্যে দু’একজন শিশু থাকে। তবে, একই সাথে ১০ শিশু মৃত্যুর বিষয়টি অস্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সংশি¬ষ্ট চিকিৎসক ও নার্সের কোন গাফিলতি আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে প্রফেসর ডাঃ ইসমাইল পাটোয়ারীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। রিপোর্টে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানান ডাঃ মোঃ আব্দুছ ছালাম। তিনি সংশি¬ষ্টদের আতংকিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, সিলেট বিভাগের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এখানে বিদ্যমান সিটের দ্বিগুণ-তিনগুণ রোগী ভর্তি থাকেন। গত মাসের হিসাব দেখিয়ে তিনি বলেন, গত মাসেও এখানে গড়ে প্রতিদিন ১৪ জন রোগী মারা যাওয়ার পরিসংখ্যান রয়েছে।
ওসমানী হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার আব্দুস ছবুর মিঞা সাংবাদিকদের জানান, সোমবার রাতে ৭৫ জন রোগী এসে শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি হয় । মারা যাওয়া শিশুদের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় এনে ভর্তি করা হয়েছিল। তারা বিভিন্ন রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তিনি বলেন, এরপরও চিকিৎসার অবহেলায় মৃত্যু হয়েছে কিনা বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।