বিশ্ব ইজতেমায় জুম্মার নামাজে লাখো মানুষের ভিড়

55

BC-09-01-15-N_21কাজিরবাজার ডেস্ক :
কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে তাবলিগ জামাতের ৫০তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। ফজরের নামাজের পর পাকিস্তানের মাওলানা মোঃ এহসানের আম বয়ানের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ জমায়েতের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। দুপুরে বিশ্বের ৫৫টি দেশের প্রায় ছয় হাজার মেহমানসহ দেশের লাখ লাখ তাবলিগ অনুসারী ও সাধারণ মুসল্লির অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় দেশের বৃহৎ জুম্মার নামাজের জামাত। কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মোহাম্মদ জোবায়ের এতে ইমামতি করেন। তিন দিনব্যাপী ইজতেমার এ পর্বের আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে রবিবার। চার দিন বিরতি দিয়ে ১৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা। এ পর্বের আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে ১৮ জানুয়ারি। ইজতেমা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বিক মঙ্গল কামনা করে শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছেন।
বিএনপি জোটের অবরোধ আর নানা দুর্ভোগ উপেক্ষা করে গতকাল শুক্রবার ফজরের আগেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ইজতেমা ময়দানে হাজির হন তাবলিগ অনুসারীরা। বৃহৎ জামাতে যোগ দিতে সকাল থেকে ঢাকা ও গাজীপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে দলে দলে টঙ্গীতে আসেন মুসল্লিরা। বেশ কয়েকজন মন্ত্রীসহ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা এতে যোগ দেন। জুমার নামাজের সময় তুরাগ তীরে ইজতেমার ১৬০ একর জায়গায় নির্মিত বিশাল প্যান্ডেল জনসমুদ্রে পরিপূর্ণ হয়। এ সময় মুসল্লিদের বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়ে পাশের তিনটি সড়কে। আগের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, উত্তরে টঙ্গী-কামারপাড়া লিংক রোড এবং দক্ষিণে উত্তরা-আশুলিয়া বাইপাস সড়কসহ পশ্চিমে আহ্ছানিয়া মিশন ক্যান্সার হসপিটালের প্রবেশমুখের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে জুমার নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। দুপুর ১টা ৩৪ মিনিটে খুতবা ও ১টা ৪৩ মিনিটে জামাত শুরু হয়। জামাত শেষে টঙ্গীর এক বাসিন্দার জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ইজতেমা মাঠে।
জামাতে ব্যাপক মুসল্লির উপস্থিতির কারণে ইজতেমা এলাকার পাশের সব সড়কে প্রায় ২ ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ওই এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। অবরোধের কারণে কিছুটা দুর্ভোগ হলেও ইজতেমায় মুসল্লির উপস্থিতিতে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে গতবারের চেয়ে এবার বিদেশি মুসল্লির সংখ্যা অনেক কম ছিল।
কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী : রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ায় তা নির্বিঘœ করতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। র‌্যাব ও পুলিশের পৃথক কন্ট্রোলরুম থেকে সিসি ক্যামেরায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। জুম্মার নামাজের আগে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশিদ বলেন, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, ফুটপাত, ইজতেমা মাঠ, নদী ও আকাশপথসহ চারপাশে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ও র‌্যাব পোশাকে ও সাদা পোশাকে কাজ করছেন তারা। এজন্য শুক্রবার পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৫০টি দেশের পাঁচ হাজারের মতো বিদেশি মুসল্লি ইজতেমায় এসেছেন। আখেরি মোনাজাতে অনেক ভিআইপি মেহমান আসবেন। এজন্য ওই দিন আরও বেশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। টঙ্গী মডেল থানা জানায়, শুক্রবার পর্যন্ত ইজতেমা মাঠের আশপাশে অভিযান চালিয়ে ৩০ ছিনতাইকারী ও পকেটমার আটক করা হয়েছে। ইজতেমা মাঠের উত্তর পাশে র‌্যাবের কন্ট্রোলরুমসহ বিনামূল্যে চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এখানে সরকারি-বেসরকারি প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠান মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালেও বিশেষ ব্যবস্থায় চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন ১১টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ইজতেমা এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটিরও অধিক লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে। পাশাপাশি পাঁচটি অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প ও ১১টি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যাতায়াত সেবায় র‌্যাব : অবরোধের মধ্যে ইজতেমার উদ্দেশে আসা মুসল্লিদের বাস দিচ্ছে র‌্যাব। রাজধানীর মহাখালী থেকে বিনামূল্যে যাত্রীদের ইজতেমা মাঠে নিয়ে যাচ্ছে তাদের বাস। র‌্যাবের মিডিয়া অ্যান্ড লিগ্যাল উইংয়ের উপপরিচালক রুম্মান মাহমুদ জানান, মুসল্লিদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে র‌্যাব শুক্রবার সকাল থেকে এ সেবা দিচ্ছে। যতক্ষণ প্রয়োজন হবে এ সেবা চালু থাকবে বলেও জানান তিনি।
তাবলিগ জামায়াতের শীর্ষ মুরব্বি মাওলানা গিয়াস উদ্দিন জানান, শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত বিশ্বের ৫৫টি দেশের প্রায় ছয় হাজার বিদেশি মুসল্লি ইজতেমা মাঠে এসে শরিক হয়েছেন। বিমানবন্দর থেকে তাবলিগ জামাতের নিজস্ব বাস-মাইক্রোবাসে করে ইজতেমা মাঠে আনা হচ্ছে তাদের। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মুসল্লি এসেছেন ভারত ও পাকিস্তান থেকে। এছাড়া যেসব দেশের মুসল্লি এসেছেন তার মধ্যে মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, চীন, জাপান, কুয়েত, কাতার, দুবাই, সৌদি আরব, ওমান, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, কোরিয়া, ইরান, ইরাক, ব্রুনাই, ইতালি উল্লেখযোগ্য।
মুসল্লিদের যত দুর্ভোগ : তাবলিগ জামাত ও প্রশাসনের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও আগত মুসল্লিদের নানা দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। বিশেষ করে বিএনপি জোটের অবরোধ আতঙ্কে ঝুঁকি নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন যানবাহনে টঙ্গীতে পৌঁছান তারা। ঢাকা, গাজীপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে অনেকে যানবাহন সঙ্কটে হেঁটে ইজতেমায় যোগ দেন। এদিকে জুমার নামাজ শেষে ফেরার সময় সাধারণ মুসল্লিদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, আশুলিয়া-মিরপুর সড়ক, টঙ্গী-সিলেট সড়কসহ বিভিন্ন সড়কে সন্ধ্যা পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটে আটকা থাকতে দেখা যায় অনেককে। হেঁটেও অনেকে গন্তব্যে ফিরে যান। সুযোগ বুঝে একশ্রেণীর পরিবহন ব্যবসায়ী কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করেন মুসল্লিদের কাছ থেকে।
ইজতেমার কর্মসূচি : জুম্মার নামাজের পর আম বয়ান করেন মাওলানা শওকত হোসাইন। বাদ মাগরিব বয়ান করেন মাওলানা মোহাম্মদ জোবায়ের আহমেদ। এশার নামাজের পর বয়ান করেন মাওলানা মোহাম্মদ সা’দ। আজ বাদ ফজর থেকে আবার বয়ান শুরু করা হবে। ফাঁকে ফাঁকে জিকির ও নতুন জামাত গঠন হবে। আজকের অন্যতম আকর্ষণ যৌতুকবিহীন বিয়ে। এজন্য শুক্রবার পর্যন্ত ৪০ বর ও কনের নাম অন্তর্ভুক্ত করে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। বাদ আসর এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। রোববার শেষ দিন বাদ ফজর হেদায়েতি বয়ান এবং জোহরের আগে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে প্রথম পর্বের ইজতেমা শেষ হবে। বার্ধক্যজনিত কারণে বিশ্ব তাবলিগ জামাতের সাবেক আমির জোবায়েরুল ইসলাম মারা যাওয়ায় দেড় যুগ পর এবারের ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনাকারী পরিবর্তন হচ্ছে। ভারতের মাওলানা সা’দ অথবা মোহাম্মদ ইব্রাহীম এবারের ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করতে পারেন। এ বিয়য়ে আজ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। উল্লেখ্য বাংলা, আরবি, উর্দু, হিন্দি, মালয়, ফার্সিসহ একাধিক ভাষায় ইজতেমায় বয়ান করা হয়। তবে তা বাংলা ভাষায় সঙ্গে সঙ্গে তরজমা করা হয়।