আফতাব চৌধুরী
মাদকের বিষে ছেয়ে গেছে সিলেট নগরী। সর্বনাশা মাদকের ছোবলে যুবক, বয়স্কদের পাশাপাশি আসক্ত হয়ে পড়ছে নগরীর শত শত পথশিশু। এসব পথশিশু মাদক নির্ভর হয়ে চলে যাচ্ছে অন্ধকার জীবনে। এদের বেশিরভাগের বয়স ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। নগরীর বিভিন্ন স্থানে নেশার আসরে বয়স্কদের পাশাপাশি পথ শিশুরাও চলে আসছে এ লাইনে। গত কয়েকদিনে নগরীর বিভিন্ন বস্তি এবং রেললাইনসহ কয়েকটি এলাকায় সরজমিন এ চিত্র দেখা গেছে। বিশেষ করে নগরীর রেলওয়ে ষ্টেশন এলাকায় দিবা রাত্রির বেশির ভাগ সময় অসংখ্য পথশিশু নেশার আসরে ডুবে থাকে।
এদের থাকার কোনো জায়গা নাই। সারা দিন ষ্টেশনে থাকে। কাগজ কুড়িয়ে বা কোনখানে শ্রমবিক্রি করে পারিশ্রমিক হিসেবে যা পায় তা দিয়েই চলে এদের মাদক সেবন। আর এ সুযোগে এসব শিশুদের ব্যবহার করে গাঁজা, ফেনসিডিল, চোরাই মদসহ বিভিন্ন প্রকারের মাদক ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে মাদকের বিষ এসব শিশুদের জীবন কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। অন্ধকার জগতে ঘুরপাক খাচ্ছে ভয়াবহ মাদকের ছোবলে আক্রান্ত ওইসব পথশিশুরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পথশিশুদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রচলন রয়েছে মরণঘাতী নেশা ড্যান্ডি।
নগরীর বাসস্ট্যান্ড, রেলষ্টেশন ও বস্তিগুলোতে শিশুদের মাদক হিসেবে এটি নতুন সংযোজন। নগরীর ষ্টেশন রোডের পুরাতন রেলওয়ে ষ্টেশনের ফ্ল্যাটফর্ম ডিঙিয়ে ওয়াগনের পাশে নির্জন ঝোপের ধারে ড্যান্ডি আসক্ত একদল শিশুর সন্ধান পাওয়া যায়। জানা গেলো এখানে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সী পথশিশুরা নেশা করে আসছে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠে পথশিশুদের ড্যান্টি টানার আসর। দেখা গেলো একদল শিশু বসে ঝিমোচ্ছে আর কেউ কেউ পলিথিনের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে শ্বাস নিচ্ছে। নাম জিজ্ঞেস করতেই একে একে বলে উঠে-কাউসার, বিল্লাল, রাজু, আজমল, মনির, সেলিম, কবির।
তোমরা এখানে কি করছো ? প্রশ্ন শেষ না হতেই একজন চোখ বুজে জড়ানো গলায় বলে উঠে ড্যান্ডি বানাইয়া খাই, বুঝছেন? আর একজন বলে, বুঝে নাই মনে হয়। তাহলে আপনারে কই-এই বলে দলের একজন দেখাতে শুরু করলো ড্যান্ডি তৈরির কায়দা-কানুন।
ওদের কাছ থেকে জানা গেলো ড্যান্ডি খুব সহজলভ্য নেশা। জুতা জোড়া লাগানোর কাজে ব্যবহৃত বিশেষভাবে তৈরি আইকা গাম ড্যান্ডির প্রধান উপকরণ। কৌটা থেকে সামান্য আইকা গাম নিয়ে ছোট পলিথিন ব্যাগের ভেতরে লেপ্টে দেয়ার পর পলিথিনে ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে এর ভেতরে নাক মুখ ঢুকিয়ে জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিলে মাথায় ঝিমুনি ধরে, নেশা হয়। পথশিশু সেলিম জানায়, এ নেশার খরচ কম, ড্যান্ডি খেলে ক্ষুধা লাগে না, মনে কোনো দুঃখ থাকে না। ছোট বেলা থেইক্যা বাপরে দেহি নাই, কয়দিন হয় মা আরেক জনের লগে বিয়া বইছে। নতুন বাপের লগে আমার বনে না।
এহন ষ্টেশনে থাকি। আরো কয়েকজন পথশিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ষ্টেশনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বস্তি ও নির্জন স্থানগুলোতে মদ, ফেনসিডিল গাঁজা, হেরোইন, এসব পাচার করে যে অর্থ পায় তা দিয়ে খাবার খায় আর বিভিন্ন মাদক কিনে নেশায় বুদ হয়ে থাকে এসব পথশিশু। একদিন খাবার না খেলে তাদের চলে, কিন্তু নেশা না করলে তাদের চলে না। ঘুম হয় না, বুক জ্বলে।
পরিণত বয়সের আসক্তদের মতো আধশোয়া অবস্থায় ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কথাগুলো বলছিল আনুমানিক ১২-১৩ বছর বয়সী পথশিশু আলম। এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, মাদকের ভয়াবহ ছোবলে পথশিশুদের আসক্ত হওয়ার খবর অনেক আগে থেকেই শুনে আসছি। তবে এতে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও জেনেছি। এ ব্যাপারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নে অধিকারভিত্তিক সেবা প্রদানকারী বেসরকারি সংস্থা অপরাজয়ের বাংলাদেশের হিসাবে সিলেট বিভাগে বর্তমানে পথশিশুর সংখ্যা ২৫ হাজার। এর মধ্যে সিলেট রেলওয়ে ষ্টেশনে, কোতোয়ালি এলাকা ছাড়াও নগরীরর বিভিন্ন স্থানে পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার।
এদের অধিকাংশই সামান্য অর্থের বিনিময়ে মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। নিজেরাও হয়ে পড়ছে মাদকাসক্ত। এ প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক কর্মকর্তা জানান, পথশিশুদের নেশার কবল থেকে রক্ষা করতে আমাদের চাইল্ড টু চাইল্ড কন্ট্রাক্ট কার্যক্রম আরো জোরদার করেছি। নগরীতে পথশিশুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মাদক সেবনকারীর সংখ্যাও।
মাদক ব্যবসায়ীরা যাতে পথশিশুদের ব্যবহার করতে না পারে সে লক্ষ্যে আমরা পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করেছি।
এসব কোমলমতি পথশিশুদের থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই, যেখানেই রাত সেখানেই কাত। বিভিন্ন ফুটপাত, রাস্তা, কাঁচাবাজার ও শহরের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবনের নিচে তারা রাত কাটায়।
দরিদ্র ও সামাজিক অবক্ষয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবহেলা, এমনকি নগরীতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা মাদকের আস্তানা দিন দিন পথশিশুদের নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে। একমাত্র অভাব আর বেকারত্বের সুযোগে মাদক ব্যবসায়ীরা মাদকদ্রব্য বেচা-কেনা ও পাচারের কাজে পথশিশুদের ব্যবহার করে।
এর ফলেই আসক্ত হয়ে পড়েছে কোমলমতি পথ শিশুরা। সমাজ ও রাষ্ট্র যদি পথশিশুদের আশ্রয়, খাদ্য, শিক্ষাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে তারাও দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ব্যাপারে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশেষ ভূমিকা থাকা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সাংবাদিক-কলামিস্ট।