কাজির বাজার ডেস্ক
বয়স হয়তো ২০, ৩০ কিংবা বড় জোর ৪০-এর কোঠায়। এমন মানুষের মধ্যে স্তন ক্যানসার, মলাশয় ও মলদ্বারের (কলোরেক্টাল) ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার ক্রমাগত বাড়ছে। আর এমন বয়সিদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়াকে আর্লি অনসেট ক্যানসার বা অকালে ক্যানসার হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। খবর :বিবিসি বাংলা। গত ১০ বছরে ২৪টি দেশে ২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মানুষের মধ্যে কলোরেক্টাল ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়তে দেখা দেখা গেছে। এসব দেশের মধ্যে আছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নরওয়ে ও আর্জেন্টিনা। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল ক্যানসার কন্ট্রোলের (ইউআইসিসি) এক সম্মেলনে আন্তর্জাতিক গবেষক দল এমন উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ করেছেন।
আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি (এসিএস) এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøউএইচও) ক্যানসার গবেষণাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষকেরা অকালে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বোঝার জন্য ৫০টি দেশের তথ্য পর্যালোচনা করেছিলেন। এতে দেখা গেছে, ১৪ দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শুধু তরুণদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এসব দেশে অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সি মানুষের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা স্থিতিশীল থাকতে দেখা গেছে।
স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রবণতাটি সুস্পষ্ট। এসিএসের নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দশকে নারীদের স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার প্রায় ১০ শতাংশ কমলেও নারীদের আক্রান্ত হওয়ার হার বছরে ১ শতাংশ করে বেড়েছে। ৫০ বছরের কম বয়সি নারীদের ক্ষেত্রে এ প্রবণতা ১ দশমিক ৪ শতাংশ করে বাড়তে দেখা গেছে।
রোগের বিস্তারসংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণার তথ্য পর্যালোচনা করে ধারণা হয়েছে, ১৯৯০-এর দশকে প্রথম এ ধরনের প্রবণতা অর্থাৎ অকালে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ৫০ বছরের কম বয়সিদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার ৭৯ শতাংশ বেড়েছে। তরুণদের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার বেড়েছে ২৯ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক প্রজন্ম ধরে কীভাবে ধীরে ধীরে ১৭ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়েছে, তা ল্যানসেট পাবলিক হেলথ সাময়িকীতে প্রকাশিত আলাদা এক প্রতিবেদনে বর্ণনা করা হয়েছে। বিশেষ করে এক্স প্রজন্ম এবং মিলেনিয়াল প্রজন্মের মধ্যে এ প্রবণতা বাড়তে দেখা গেছে।
কেন এমনটা হচ্ছে : ৫০ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে মূলত স্থূলতা এবং মেটাবলিক সিনড্রোম নামক শারীরিক অবস্থাকে দায়ী করা হয়। এগুলো মানুষের শরীরে প্রদাহ বাড়িয়ে দেয় এবং মূল হরমোনের পথগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না। আর এতে ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ বছর থেকে ৪০ বছর বয়সি মানুষের শরীরের অতিরিক্ত ওজনের কারণে ১৮ ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। ল্যানসেটের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে তরুণদের মধ্যে যে ১৭ ধরনের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে, তার ১০টিই স্থূলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যে আছে কিডনি, ডিম্বাশয়, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয় ও পিত্তথলির ক্যানসার। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগতত্তে¡ অধ্যাপক শুজি ওজিনো ৫০ বছরের কম বয়সি মানুষের মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ জানতে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, ‘সব মিলে যে তথ্যগুলো পাওয়া গেছে, তাতে তা জীবনযাত্রার পরিবর্তনকেই ইঙ্গিত করে।’
ওজিনো আরও বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই হাজারো জিনগত ধরনের উপস্থিতি আছে। এগুলোর কিছু কিছু খুব সামান্য পরিমাণে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভ‚মিকা রাখে। কিছু পরিবেশগত পরিবর্তনের সংস্পর্শে সে ঝুঁকি বেড়ে যায়। আমরা জানি যে খুব বেশি চিনি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার খেলে, রক্তে একনাগাড়ে উচ্চ মাত্রায় শর্করার উপস্থিতি থাকলে এবং শরীর ইনস্যুলিন প্রতিরোধী হয়ে পড়লে তা শুধু আপনার ডায়াবেটিসের ঝুঁকিই বাড়াবে না, ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়াবে।’
শুধু স্থূলতা দিয়েই পুরো বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ আইলিন ও’রিলি বলেছেন, তিনি অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত এমন অনেক কম বয়সি রোগীকে পেয়েছেন, যাদের দেখে শারীরিকভাবে কর্মক্ষম এবং সুস্থ বলে মনে হচ্ছিল। তারা কেন অসুস্থ হলো তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাও নেই। আর রোগীদের নিয়ে এমন অভিজ্ঞতার আলোকে ও’রিলি মনে করেন, ক্যানসার নিয়ে যে ধারণাগুলো প্রচলিত আছে, তার বেশির ভাগই এসব রোগীর বেলায় খাটেনি।
রোগতত্ত¡বিদেরাও দীর্ঘদিন ধরে ধূমপান ও ক্যানসারের মধ্যে সংযোগের কথা বলে আসছিলেন। কিন্তু গত কয়েক দশকে ধূমপানের প্রবণতা কমতে দেখা গেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বিশ্বজুড়ে এখন মাত্র প্রতি পাঁচজনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি তামাকজাতীয় পণ্য নিয়ে থাকেন। ২০০০ সালে এ হার ছিল প্রতি তিনজনে একজন।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগতত্তে¡র অধ্যাপক শুজি ওজিনো অবশ্য ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্য একটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মতে, গত ৫০ থেকে ১০০ বছরে বিশ্বজুড়ে মানুষের ঘুমের ধরনে যে পরিবর্তন এসেছে, সে ব্যাপারে খুব একটা নজর দেওয়া হচ্ছে না।
২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কম ঘুমানো এবং ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি হওয়ার মধ্যে যোগসূত্র আছে। ‘ইংলিশ লংজিটুডিনাল স্টাডি অব এজিং ডেটাবেজ’-এ থাকা ১০ হাজারের বেশি মানুষের তথ্য ব্যবহার করে গবেষণাটি করা হয়েছে। এসব মানুষের প্রত্যেকের বয়স ৫০ বছরের বেশি।
বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে কৃত্রিম আলো ব্যবহারের আধিক্যের যোগসূত্র থাকার কথা বলছেন। তাদের মতে, মানুষ দীর্ঘ সময় কৃত্রিম আলোর সংস্পর্শে আসছে। সেটা সড়কবাতির মাধ্যমে হতে পারে, মোবাইল কিংবা ট্যাবলেট ব্যবহারের মধ্য দিয়ে হতে পারে। কৃত্রিম আলোর সংস্পর্শে আসার কারণে মানুষের শরীরের জৈবিক চক্র ব্যাহত হচ্ছে। আর তা স্তন, কোলন, ডিম্বাশয় এবং প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ভ‚মিকা রাখছে।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাতের পালায় যারা কাজ করেন, তাদের কৃত্রিম আলোতে থাকতে হয়। আর এতে মেলাটোনিন হরমোনের মাত্রা কমে ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
রোগতত্ত¡বিদ ওজিনো বলেন, ‘রাতের বেলায় আমাদের অনেক বেশি কৃত্রিম আলোর সংস্পর্শে থাকতে হয়। এমনকি আমাদের শৈশব থেকেই এমনটা ঘটে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জাপানে জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিরাতেই মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকে। ২৪ ঘণ্টা চালু থাকা বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে পালাভিত্তিক কাজ অনেকটাই সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে।’
তবে ওজিনো মনে করেন, ৫০ বছরের কম বয়সি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ক্যানসারের প্রবণতার ক্ষেত্রে একক কোনো বিষয়কে ঝুঁকি হিসেবে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। বরং বিভিন্ন বিষয় একসঙ্গে মিলে রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, জীবনযাপনের পরিবর্তনসংক্রান্ত প্রভাবের পাশাপাশি মানুষের অন্ত্রে বিভিন্ন বিষাক্ত জিনিসের প্রবেশের কারণেও ঝুঁকি বাড়ে।
২০২৩ সালের জুনে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ হাসপাতালের কলোরেক্টাল সার্জন ফ্র্যাংক ফ্রিজেল বিশ্বের মলাশয় ও মলদ্বারের ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের প্রতি একটি আহবান জানিয়েছিলেন। শরীরে অতিরিক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢোকার সঙ্গে অকালে অন্ত্রের ক্যানসার হওয়ার সম্পর্ক আছে কি না, জানতে বড় পরিসরে গবেষণা করার আহবান জানিয়েছিলেন তিনি।
শুধু ফ্রিজেলই নন, অন্ত্রে বিষাক্ত জিনিসের প্রবেশের সঙ্গে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ার যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে করেন অন্য গবেষকেরাও। তাদের মতে, অত্যন্ত প্রক্রিয়াজাত খাবারের মধ্যে যে নির্দিষ্ট উপাদানগুলো থাকে, তা প্রদাহ তৈরিতে ভ‚মিকা রাখে এবং অন্ত্রের ডিএনএকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এসব উপাদানের মধ্যে আছে মাইক্রোপ্লাস্টিক কিংবা খাবারে ব্যবহৃত রং। যদিও গবেষকেরা এখন পর্যন্ত তাদের ধারণার পক্ষে তুলনামূলক সীমিত প্রমাণ হাজির করতে পেরেছেন।
ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন গবেষকেরা। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিশ্বজুড়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসা, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের হার বেড়েছে। বিশেষ করে শিশুদের অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের হার বেড়েছে। ২০১৮ সালে দেখা গেছে, পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ১৪ দশমিক ৩ জন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে। ২০০০ সালে এ সংখ্যা ছিল প্রতি হাজারে ৯ দশমিক ৮। অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
শুধু শিশুরাই নয়, সর্বোপরি বিশ্বে ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সব বয়সি মানুষের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। আর গবেষক ও’রিলি মনে করেন, এটি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতোই একটি উল্লেখযোগ্য কারণ।
ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা অনেক কারণের কথা ধারণা করলেও ঠিক কী কারণে অনেকে অকালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তা জানতে বিজ্ঞানীদের আরও পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে ও’রিলি মনে করেন, সামনের বছরগুলোতে বৈশ্বিকভাবে স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় এড়াতে বিজ্ঞানীদের উচিত বিস্তারিত গবেষণা করা।