কাজির বাজার ডেস্ক
মানব স্টেম সেল থেকে তৈরি একটি প্যাচ বা পট্টি দিয়ে বানরের রেটিনার গর্ত সারিয়ে ফেলেছেন জাপানের বিজ্ঞানীরা। এর ফলে বানরটি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে। স্টেম সেল রির্পোটস জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে এই বৈপ্লবিক ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। এটি রেটিনা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
চোখের পেছনে অবস্থিত আলো শনাক্তকারী কোষের স্তর হল রেটিনা। এই টিস্যুর ক্ষতি হলে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যেতে পারে। এই ধরনের অবস্থা চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা কঠিন হতে পারে। কখনো কখনো রোগীর নিজের রেটিনার কিছু অংশ বাইরের প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে স্থানান্তর করেন চিকিৎসকেরা। তবে এর ফলে দৃষ্টিসীমার কিছু জায়গায় ‘বøাইন্ড স্পট’ বা অন্ধ স্থান তৈরি হয়। অর্থাৎ রোগী পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি ফিরে পান না।
নতুন গবেষণাটি ‘ম্যাকুলার হোল’ সারিয়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এটি একটি বিরল রোগ। এর ফলে রেটিনার ঠিক কেন্দ্রস্থলে ‘ফোভিয়া’ নামক অংশে একটি গর্ত তৈরি হয়। ফোভিয়ার কেন্দ্রীয় দৃষ্টি এবং তীক্ষè ফোকাসের জন্য প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ বই পড়া বা গাড়ি চালানোর মতো দৈনন্দিন কাজের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। চোখের ভেতরের জেলি মতো পদার্থ রেটিনা থেকে আলাদা হয়ে গেলে সাধারণ ম্যাকুলার হোল তৈরি হয়।
অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এই অবস্থা প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে সারানো সম্ভব। তবে বাকি ১০ ক্ষেত্রে রোগীদের দৃষ্টি ঝাপসা বা অন্ধ স্থান তৈরি হয়। বছরের পর বছর ধরে স্টেম সেল থেকে তৈরি ছোট আকারের রেটিনার সংস্করণ বিকাশের ওপর কাজ করছেন জাপানের কোবে আই হাসপাতালের গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মিচিকো মন্ডাই। এই রেটিনা ‘অঙ্গানু’ হলো আলো শনাক্তকারী কোষের স্তর, যা স্টেম সেল থেকে উৎপন্ন হয় এবং শরীরের যেকোনো টিস্যুতে পরিণত হতে সক্ষম।
২০১৯ সালে এই কোষের শিটগুলো ম্যাকুলার হোলের এর ওপর প্রতিস্থাপনের সুযোগ পান ড. মিচিকো মন্ডাই।
সেসময় আরেকটি গবেষণাগারে জাপানি ম্যাকাকাস বানরের ওপর গবেষণা করা হচ্ছিল। চোখ ও মস্তিষ্ক কীভাবে চিত্র প্রক্রিয়াধীন করে তা জানতে গবেষণাটি পরিচালনা করেন তারা। তবে দৃষ্টিশক্তি ওপর নির্ভরশীল কাজগুলো ঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারছিল না বানরটি। পরে জানা যায়, ওই বানরের একটি ম্যাকুলার হোল ছিল। এরপর প্রাণীটিকে সার্জারির জন্য মন্ডাইয়ের গবেষণাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। মন্ডাই এবং তার দল মানব স্টেম সেল থেকে একটি রেটিনা শিট বা প্যাচ তৈরি করে এবং সেটি বানরের রেটিনায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লাগিয়ে দেয়। ফলে ওই জায়গাটি পূর্ণ হয়ে যায়। বিষয়টি কাপড়ে তালি দেওয়ার মতো। এই ট্রান্সপ্লান্টটি নিরাপদ এবং কার্যকরী ছিল।
অস্ত্রোপচারের পর দৃষ্টিসংক্রান্ত কাজগুলো আরও ভালোভাবে করতে পারছিল বানরটি।
তবে প্যাচটি শরীরে কিছুটা প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছিল। অর্থাৎ বানরের শরীরের ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধী সিস্টেম) প্যাচটিকে বিদেশি বা অজানা টিস্যু মনে করে আক্রমণ করেছিল। অজানা কিছু প্রবেশ করলে শরীর এমন প্রতিক্রিয়া দেখানো একটি সাধারণ বিষয়। তবে এই সমস্যা খুব গুরুতর ছিল না। মন্ডাইয়ের দলটি স্টেরয়েড ইনজেকশন ব্যবহার করে সেই ইমিউন প্রতিক্রিয়া দমন করে দিয়েছিল। স্টেরয়েড ইনজেকশন শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে দমিয়ে দেয়, যাতে বাইরের প্রতিস্থাপিত টিস্যুকে আক্রমণ না করে।
মন্ডাই বলেছেন, ‘সম্ভবত ভিন্ন প্রজাতির কোষ প্রতিস্থাপন করায় বানরের দেহে এই প্রতিরোধ বেশি দেখা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘মানব টিস্যু যদি মানুষের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা হতো, তবে ইমিউন সিস্টেমের প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি কম হতো।’
সার্জারির ছয় মাস পর গবেষকেরা বানরের চোখ থেকে প্যাচটি সরিয়ে নিয়ে পরীক্ষা করেন। তারা দেখতে পান নতুন দৃষ্টি কোষ ‘রডস’ ও ‘কোনস’ এতে বিকশিত হয়েছে। রডস মূলত রাতের দৃষ্টিশক্তির জন্য দায়ী এবং কোনস রং দেখতে সাহায্য করে। তবে প্রতিস্থাপিত কোষগুলো এবং বানরের আসল কোষগুলোর মধ্যে সংযোগ তৈরি হয়েছে কিনা তা গবেষক দলটি নিশ্চিত করতে পারেনি।
মন্ডাইয়ের দল তাদের রেটিনার অঙ্গানু ব্যবহার করে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা দিচ্ছে। গত বছর ‘রেটিনাইটিস পিগমেনটোসা’ নামে একটি জিনগত রোগে আক্রান্ত মানব রোগীদের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করেন তারা। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে। দুই বছর পর দেখা যায়, প্রতিস্থাপিত রেটিনা টিস্যু রোগীদের রেটিনায় নিরাপদে একত্রিত হয়েছে। যারা চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের দৃষ্টি হারানোর প্রক্রিয়া চিকিৎসা না নেওয়া রোগীদের তুলনায় ধীর ছিল।