১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি বানভাসী মানুষের চরম ভোগান্তি

10

স্টাফ রিপোর্টার
সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হলেও বানবাসী মানুষরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। গত ১৯ জুন বুধবার বিকেল থেকে বৃষ্টিপাত কমতে শুরু করে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক কম হওয়ায় এবং গত ৪৮ ঘণ্টায় ভারতের চেরাপুঞ্জিতে কোনো বৃষ্টিপাত না হওয়ায় জেলার নদনদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ছয় পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শুক্রবার সকাল থেকে সিলেটের আকাশ ছিল রোদ ঝলমলে।
এদিকে বৃষ্টি না হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে বন্যাক্রান্ত মানুষের মধ্যে। নগরীসহ উপজেলাগুলোতে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া বাসাবাড়ির পানিও কমতে শুরু করেছে। পানি কমলেও ভোগান্তি বেড়েছে বানবাসী মানুষের।
সিলেটে দ্বিতীয় দফার বন্যায় মহানগরী ও জেলাজুড়ে ৯ লাখ ৮৯ হাজার ৮৬৫ জন মানুষ বন্যাক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মহানগরীতে বন্যাক্রান্ত হয়েছেন ৬০ হাজার মানুষ।
জানা গেছে, প্রথম দফায় জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জের মানুষ বেশি আক্রান্ত হলেও দ্বিতীয় দফায় সিলেটের সব উপজেলার মানুষ বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন। নদ-নদীর পানি কমলেও এসব উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও প্লাবিত রয়েছে। এতে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ কমছেই না।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, সিলেটে গত ২৪ ঘণ্টায় (বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত) বৃষ্টিপাত হয়েছে ২০ মিলিমিটার। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়নি।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় (বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত) ভারতের চেরাপুঞ্জিতে কোনো বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়নি। এর আগে গত বুধবার সকাল ৯টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ভারতের চেরাপুঞ্জিতে কোনো বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়নি। ফলে সিলেটের সব কটি নদনদীর পানি কমতে শুরু করেছে।
গত ১৩ জুন বৃহস্পতিবার ভোররাত থেকে শুরু হওয়া বজ্রসহ বৃষ্টি ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত চলমান থাকার কারণে সিলেটের নদনদীর পানি বাড়তে শুরু করে। শুক্রবার দিনে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা কমলেও সন্ধ্যার পর থেকে আবারও শুরু হয় বৃষ্টি। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার বেলা ১২টা পর্যন্ত টানা বৃষ্টি ছিল। এরপর আবার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা কমলেও রবিবার রাত থেকে আবারও টানা বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় জেলার নদনদীর পানি দ্রæত বাড়তে থাকে।
এর আগে গত ২৭ মে সিলেটে আগাম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে জেলার সব উপজেলার সাড়ে ৭ লাখ মানুষ বন্যাক্রান্ত হন। সেই বন্যায় সড়ক, মহাসড়ক, ঘরবাড়ির অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই আবার বন্যা আক্রান্ত হন সিলেটের মানুষ।
এদিকে, বন্যা পরিস্থিতিতে মহানগর ও জেলাজুড়ে বন্যায় পানিবন্দির সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে সিলেটে দ্বিতীয় দফা বন্যায় মহানগর ও জেলাজুড়ে ১০ লাখ ৪৩ হাজার ১৬১ জন মানুষ বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এরমধ্যে সিলেট মহানগরীতে বন্যায় প্লাবিত হয়েছে ৬০ হাজার মানুষ।
২১ জুন শুক্রবার সকালে সিলেট জেলা প্রশাসন জানায়, এ সময় পর্যন্ত সিলেট মহানগরীর ২৯টি ওয়ার্ডসহ জেলার ১৩৬টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ১ হাজার ৫৫২টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। ১০ লাখ ৪৩ হাজার ১৬১ জন বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে সিলেট মহানগরীতে বন্যা আক্রান্ত হয়েছে ৬০ হাজার মানুষ। জেলা ও মহানগর মিলিয়ে ৭১৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট মহানগরীতে ৮০টি। এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে ৩৮৭টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ২৫ হাজার ২৭৫ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট কার্যালয়ের তথ্য মতে, সিলেটের সব নদনদীর পানিই কমতে শুরু করেছে। তবে এখনও সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ছয় পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বন্যাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সকলকে অনুরোধ করেছেন। এবং বন্যার পানি পান না করতে। বন্যাজনিত যেকোনো রোগে মেডিকেল টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ও বন্যা পরবর্তী বাড়িঘর ও পয়ঃনিস্কাশনসহ বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, শুক্রবার নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢল না হলে পরিস্থিতির দ্রæত উন্নতি হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, শুক্রবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে বৃহস্পতিবার এ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার উপরে ছিল। সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে শুক্রবার সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ১৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে বৃহস্পতিবার এই পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার উপরে ছিল। কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে শুক্রবার সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে বৃহস্পতিবার এই পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৮১ সেন্টিমিটার উপরে ছিল। একইভাবে কুশিয়ারা নদীর পানি শেওলা পয়েন্টে সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে এ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার উপরে ছিল।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মোহাম্মদ সজীব হোসাইন জানান, গত ২৪ ঘন্টায় বৃষ্টির পরিমাণ ছিলো ২০ মিলিমিটার। শুক্রবার সকাল থেকে কোন বৃষ্টিপাত হয়নি। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বৃষ্টি হয়নি।
মৌলভীবাজারঃ বৃষ্টিপাত না হওয়ার মৌলভীবাজারে কমছে নদ-নদীর পানি। ধলাই নদীর পানি কমে বিপৎসীমার ২৬০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে ও মনু নদীর পানি শহরের চাঁদনীঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে কুশিয়ারা নদীর পানি শেরপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও বড়লেখা উপজেলা। অকাল বন্যায় নিম্নাঞ্চলের সাড়ে ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২০৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে আজ শুক্রবার পর্যন্ত ৯ হাজার ৯৭৭ জন আশ্রয় নিয়েছেন। তারা সঙ্গে করে ২০০ গবাদিপশু নিয়ে এসেছেন। জেলার সাতটি উপজেলার ২০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে আছেন ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৪০২ জন। বন্যা কবলিতদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ৪২২ মেট্রিক টন জি.আর চাল এবং ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা। তবে ধীরগতিতে কমতে শুরু করেছে নদ নদীর পানি। বন্যার পানিতে ভোগান্তিতে রয়েছেন মৌলভীবাজারের আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দারা।