স্টাফ রিপোর্টার
টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটে চলমান দ্বিতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। ফের বাড়ছে নদনদীর পানি। পানিতে ডুবে গেছে বাসা-বাড়ি ও রাস্তা-ঘাট-ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান এবং ভেসে গেছে কৃষকের ক্ষেত, পুকুরের মাছ ও মাছের খামার। এছাড়া সিলেটের বেশীর ভাগ সড়কে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
এদিকে, দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি উপ-কেন্দ্রটি সিলেটে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ সিলেট-৩ এর অধীনস্থ। এই উপ-কেন্দ্রের মাধ্যমে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন, বরইকান্দি, কামালবাজার, মাসুকগঞ্জ, বিসিক, লালাবাজার, শিববাড়ী ও কদমতলীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালসহ সংলগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
বিউবো বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ সিলেট-৩ নির্বাহী প্রকৌশলী শ্যামল চন্দ্র সরকার বলেন, উপকেন্দ্রটি ঝুঁকিতে রয়েছে। পানি উঠার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এখনো উঠেনি। আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি রয়েছে। সেনাবাহিনীও সাহায্য করছে।
আকস্মিক এ বন্যায় সিলেট মহানগর ও জেলাজুড়ে প্রায় ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। শুধু জেলাতে নয়, পুরো সিলেট বিভাগে ছড়িয়ে পড়েছে এ বন্যা।
সুনামগঞ্জের ঝাওয়ার হাওরের পাশে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষের ঘরের চাল ছুঁইছুঁই পানি। তাদের চুলা ধরানো বা রান্না করার মতো অবস্থা নেই। সোনাই নদীর বাঁধ ভেঙে বন্যার পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার অনেক এলাকা।
সিলেটের নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। টানা বৃষ্টিপাত ও ভারতের পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় গত বুধবার সকাল পর্যন্ত জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সিলেট মহানগরীকে দুভাগে বিভক্ত করা সুরমা নদীর পানিতে তীরবর্তী ওয়ার্ডগুলোর বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বন্যার্তদের। সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারের পাশাপাশি বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে সদর, দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জ উপজেলায়। সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুরসহ কয়েকটি উপজেলার গ্রামীণ অনেক রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এছাড়া ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা কার্যালয়গুলো পানি প্রবেশ করেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। বন্যায় ঝুঁকিতে পড়েছে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি এলাকার বিদ্যুতের সাবস্টেশন। সুরমা নদী ছাপিয়ে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। এটি প্লাবিত হলে দক্ষিণ সুরমার প্রায় ৫০ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়বে। মঙ্গলবার বিকেল থেকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষায় কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী। তাদের সহায়তা করছে সিলেট সিটি করপোরেশন ও বিদ্যুৎ বিভাগ।
সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বুধবার বিকেল পর্যন্ত মহানগরীর ২৩টি ওয়ার্ড ও জেলার ১০৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে ৮ লাখ ২৫ হাজার ২৫৬ জন মানুষ বন্যাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে সিলেট মহানগরী অর্ধ লাখ মানুষ পানিবন্দি। জেলা ও মহানগরী মিলিয়ে ৬৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে মহানগরী ৮০টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৯ হাজার ৯৫৯ জন আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। বেশিরভাগ মানুষ নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে ইচ্ছুক নন। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন পাড়া-প্রতিবেশীদের উঁচু বাসাবাড়ি বা আত্মীয়স্বজনের ঘরে।
সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মেজয় দত্ত বলেন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বন্যার পানি উঠেছে। রোগী চিকিৎসক নার্স সবাইকেই ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেও আমরা স্বাস্থ্যসেবা অব্যাহত রেখেছি।
সিলেটের বন্যাকবলিত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করেছেন দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান। বুধবার বিকেলে মিরাবাজার কিশোরী মোহন বালক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণকালে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তিনি প্রতিনিয়ত খোঁজখবর রাখছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ১০ লাখ টাকার অর্থ সহায়তার ঘোষণা দেন।
সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর পয়েন্টে মঙ্গলবার সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। বুধবার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ভোর থেকে ফের টানা বৃষ্টিপাত হওয়ায় সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নতুন পাড়া, শান্তিরগা, ধোপাখালী, বাঁধনপাড়া, বলাকা, মোহাম্মদপুর, ষোলঘর, নবীনগর, বিলপাড়, ময়নার পয়েন্ট, কাজীর পয়েন্টসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি বেড়েছে।
একতালা বা কাঁচা ঘরে থাকা মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন। মঙ্গলবার রাত থেকেই অনেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন। সবার চোখেমুখে ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার আতঙ্ক। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। অনেকেরই চুলা ধরানো বা রান্না করার মতো অবস্থা নেই। ঝাওয়ার হাওরের পাশে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষের ঘরের চাল ছুঁইছুঁই পানি। এদিকে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। জেলা প্রশাসনের তথানুযায়ী, ৫১৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২০ হাজার বানভাসি এ পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছেন।
অন্যদিকে পাহাড়ি ঢল নেমে আগে থেকেই প্লাবিত ছিল সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক, দোয়ারাবাজার, শান্তিগঞ্জ, জগন্নাথপুর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, মধ্যনগর, দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ উপজেলা। বেশি প্রভাব পড়েছে ছাতক, দোয়ারাবাজার ও সদর উপজেলা। ছাতক শহরের বাগবাড়ী, মÐলীভোগ, হাসপাতাল রোড, তাঁতিকোন, বৌলা, চরেরবন্দ, মোগলপাড়া, ঢাকাইয়া বাড়ি, লেবারপাড়া, পাটনীপাড়া, কুমনা, শ্যামপাড়া, বাঁশখলাসহ আবাশিক এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। ভয়াবহ রূপ নিয়েছে সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদী। উপজেলার গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি ও গ্রামীণ কাঁচা সড়ক। পাহাড়ি ঢলের স্রোতের ধাক্কায় উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের সীমান্তবতী নীজগাঁও, রতনপুর, বাগানবাড়ি, নোয়াকোট, ধনীটিলা, ছনবাড়ী, দারোগাখালী সড়কসহ নবনির্মিত আট থেকে ১০টি কাঁচা সড়ক বিলীন হয়ে গেছে। উপজেলার ইছামতী-ছনবাড়ীবাজার, শিমুলতলা-মুক্তিরগাঁও সড়ক, বঙ্গবন্ধু সড়ক, ছাতক-জাউয়া, ছাতক-সুনামগঞ্জ, ছাতক-দোয়ারাবাজার সড়কের বিভিন্ন নিচু অংশ পানিতে তলিয়ে গেছে।
মৌলভীবাজার সদর, কুলাউড়া, রাজনগরসহ সাতটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ঈদুল আজহার দিনেও ভোগান্তিতে পড়েন মুসল্লিরা। পানিবন্দি অনেক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠছেন। জেলার সাতটি উপজেলার প্রায় ২০টি ইউনিয়নের ৫ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। টানা বৃষ্টিতে গত সোমবার রাতে প্লাবিত হয়ে যায়
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলা পরিষদ এলাকা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। মঙ্গলবার সারাদিন বৃষ্টিপাত হওয়ায় পর পৌর শহরের মাগুরা, সাদেকপুর, বিহালা, সোনাপুর, কাদিপুর ইউনিয়নের ছকাপন, মৈন্তাম, ভাগমতপুর, গুপ্তগ্রাম, তিলকপুর, ভ‚কশিমইল ইউনিয়নের সাদিপুর, কুরবানপুর, মুক্তাজিপুর, জাবদা, কালেশার, কাইরচক, চিলারকান্দি, কানেহাত, জয়চন্ডী ইউনিয়নের ঘাঘটিয়া, মিরবক্সপুর, কামারকান্দি, কুঠাগাঁও, কুলাউড়া সদর ইউনিয়নের দেখিয়ারপুর, কুলাউড়া গ্রাম, বনগাঁও, গাজীপুর আংশিক, পুরন্দপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়নে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও প্লাবিত হয়। জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, বন্যাকবলিত উপজেলার ইউএনওদের সার্বক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং এবং কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় ওষুধসহ খাবার ও পানির ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভারিবর্ষণ ও নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের বিভিন্ন পয়েন্ট পানিবন্দি হয়েছে মানুষ। সোনাই নদীর বাঁধ ভেঙে হরিশ্যামার মরাচর পয়েন্টেসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাড়িতে পানি উঠেছে। ভেসে যাচ্ছে পুকুরের মাছ, নষ্ট হচ্ছে ক্ষেতের ফসলসহ ঘরবাড়ি। কাশিমনগরের রাবার ড্যাম্পের দুই পাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে গেছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক রাস্তাও। বুধবার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নদী ও খাল দখল করে ভবন এবং স্থাপনা নির্মাণ করায় পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে ভারিবর্ষণ হলেই অস্থায়ী বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সিলেট নগরীর তালতলা, কাজিরবাজার, তোপখানা, জামতলা, মাছুদিঘীরপাড়, শাহউপশহর, যতরপুর, সোবাহানীঘাট, মীরাবাজার, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, তোপখানা, দক্ষিণ সুরমা, গোটাটিকর, শিববাড়ি, কিষনপুর ও বেতেরবাজার এলাকার রাস্তাঘাটে হাঁটু সমান পানি রয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, পানি আগের থেকে কিছুটা কমেছে। তবে বৃষ্টি শুরু হলে আবার বেড়ে যাবে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য মতে, সিলেটের প্রধান দুটি নদী সুরমা ও কুশিয়ারার ছয়টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। আর গোয়াইনঘাটের সারি নদীর পানি সকাল থেকে বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। পানির উচ্চতা কিছুটা নিচে নেমেছে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কোথাও পানি কমেছে, আবার কোথাও বেড়েছে। তবে কুশিয়ারা নদীর একটি পয়েন্ট ছাড়া অন্য নদ-নদীগুলোর পানি আগের তুলনায় নেমেছে। বন্যার্ত এলাকায় প্রশাসনের ত্রাণ বিরতণ অব্যাহত রয়েছে। জেলা প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির ওপর সর্তক দৃষ্টি রাখছে।
সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকার বাসিন্দা ও সংবাদকর্মী শাহিদ হাতিমী বলেন, আমার উপজেলার কিছু মানুষের বাড়িঘর থেকে পানি নেমেছে। তবে বেশিরভাগ এলাকায় রাস্তাঘাট ও বাসাবাড়িতে এখনও বন্যার পানি রয়েছে। আমি সিলেট শহরে বাসা নিয়ে থাকি। ঈদের আগেরদিন এলাকায় এসেছিলাম। গিয়ে দেখি আমার বাসার আসবাবপত্রসহ নানা প্রয়োজনীয় জিনিস পানিতে তলিয়ে গেছে।
সিলেট নগরীর উপশহরের ডি বøকের বাসিন্দা আহমেদ চৌধুরী বলেন, ঈদের দিন বাসার নিচ তলায় পানি প্রবেশ করেছিল। পানির জন্য ঠিকমত ঈদের আনুষ্ঠিকতা করা হয়নি। বৃহস্পতিবারও বাসায় পানি রয়েছে। বন্দির মতো দিনকাল যাচ্ছে, তবে পানি একটু কমছে।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, মহানগরীর ২৩টি ওয়ার্ড ও জেলার ১০৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে ৮ লাখ ২৫ হাজার ২৫৬ জন মানুষ বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সিলেট জেলা-নগর মিলিয়ে ৬৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে মহানগরে ৮০টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৯ হাজার ৯৫৯ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছে। উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়নের ২২৩ টি গ্রামের ১ লাখ ২৩ হাজার ৮০০ জন মানুষ বন্যা কবলিত। তার মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে ১ হাজার ৪৪০ জন মানুষ। উপজেলার প্রধান প্রধান সড়ক ডুবে যাওয়ায় সিলেট জেলার সাথে গোয়াইনঘাট উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ১১৩টি গ্রামের ৯৫ হাজার ৫০০ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন ৭ হাজার ৩০৩ জন। উপজেলার বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক বাদে বাকি সকল সড়ক পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। যার কারণে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষজন নৌকা ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতে পারতেছে না।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ সাংবাদিকদের বলেন, সিলেটে বৃষ্টিপাত কম হওয়া ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতেও বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসায় নদ-নদীর পানি কিছুটা কমেছে। ভারতের মেঘালয়ে বৃষ্টির ওপর বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির বিষয়টি নির্ভর করছে। পাহাড়ি ঢল নামার ফলে নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১১০ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে বুধবার রাতে কোনো বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়নি। সিলেটে আগামী দুই দিন মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।
সুনামগঞ্জঃ
সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জে উজান থেকে নেমে আসা ঢল এবং অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ১৮ জুন মঙ্গলবার বিকেল থেকে বৃষ্টি কম হওয়ায় সুরমা নদীর পানি কমে বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নদীপাড়ের বাড়িগুলো থেকে পানি নামতে থাকলেও বাড়ছে হাওরের পানি। এ কারণে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে হাওর এলাকায়। দুর্ভোগ-দুর্দশায় ও হতাশায় দিন কাটছে সুনামগঞ্জবাসীর। গত তিন দিনে জেলার অন্তত ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সুনামগঞ্জ শহরের সুরমা নদীর পাড় থেকে পানি কিছু কমলেও এখন শহরের বড়পাড়া, তেঘরিয়া, হাজিপাড়া, নতুনপাড়া, বাঁধনপাড়া, হাছন নগর, মল্লিকপুর, নবীনগর ও কালীপুর এলাকায় কোথাও কোমর থেকে হাঁটুসমান পানি রয়েছে। সুনামগঞ্জ পৌরশহরের নতুনপাড়া এলাকার দোলন দাস (৪০) খবরের কাগজকে বলেন, গত তিন ধরে নতুনপাড়ায় শত শত মানুষ পানিবন্দি। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কাজ না করতে পারায় অনেকের ঘরে খাবারও নেই। কেউ এসে দেখেও না মানুষ কতটা অসহায় হয়ে পড়েছে। একই এলাকার মিঠুন জানান, কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমরসমান পানি। আতঙ্ক কাটছেই না। বৃষ্টি হচ্ছে। এতে পানি আরও বাড়বে। পানিতে থেকে মানুষ বিরক্ত হয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জ শহরতলি ইসলামপুর গ্রামের ইকবাল হোসেন জানান, ঈদের আগে থেকে এলাকায় পানি ঢুকেছে। চারদিন ধরে বন্যার পানির নিচে তলিয়ে আছি, কেউ দেখে না। ঘর থেকে বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না। ঘরে খাবার নাই, ওষুধ নাই। আমাদের অসহায়ত্ব দেখার কেউ নাই। আমাদের ত্রাণ লাগবে, খাবার লাগবে। যদি পারেন খাবার দেন। আমাদের সন্তানদের খাবার প্রয়োজন। এদিকে এখনো সুনামগঞ্জের সঙ্গে ছাতক, তাহিরপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী জানান, ইতোমধ্যে সরকারি-বেসরকারি ৫৪১ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন বানভাসি মানুষ। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে সরকারের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি রান্না করা খাবারও দেওয়া হচ্ছে। ইউনিয়নগুলোতে মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার জানান, ২৪ ঘণ্টায় পানি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।
মৌলভীবাজারঃ
বড়লেখা হাকালুকি হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। বড়লেখা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ২৫২ গ্রাম বন্যা কবলিত। ডুবে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও ফসলের মাঠ। এতে প্রায় ১ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
এদিকে, রাজনগরে প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার দুদিকে বহমান মনু ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বন্যার আশংকা দেখা দিয়েছে। দুটি নদীর বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে। অব্যাহত বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ন এলাকা। উপজেলার নদী তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক দিন যাবৎ প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার দুদিকে বহমান মনু ও কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অব্যাহত বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ইতোমধ্যে উপজেলার ফতেহপুর, টেংরা, উত্তরভাগ, কামারচাক ও রাজনগর সদর ইউনিয়নের বিস্তীর্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মনু ও কুশিয়ারা নদীর বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। অব্যাহত বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার প্লাবিত এলাকা গুলো হচ্ছে- ফতেহপুর ইউনিয়নের জাহিদপুর, চরকারপাড়, আব্দুল্লাহপুর, রশিদপুর, কাশিমপুর, সোনালুয়া, শাহপুর, বেড়কুড়ি, লামা বিলবাড়ি, সাদাপুর, তুলাপুর, উত্তরভাগ ইউনিয়নের ছিক্কাগ্রাম, কামালপুর, নয়াটিলা, আমনপুর, সুরিখাল, জুগিকোনা, কেশরপাড়া, সোনামপুর, উমরপুর, কান্দিগাঁও, রুস্তমপুর, রাজনগর সদর ইউনিয়নের নন্দীউড়া, ভ‚জবল, কামারচাক ইউনিয়নের পঞ্চানন্দপুর, হাটি করাইয়া, তেঘরি, টেংরা ইউনিয়নের রাউবাড়ি। প্লাবিত এসব এলাকায় খাবার পানি, গোখাদ্য সহ নানান সমস্যা দেখা দিয়েছে। অব্যাহত বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বাড়িঘর প্লাবিত হওয়ায় দুর্গত এলাকার লোকজন কষ্টকরে নিজ বাড়িতে অবস্থান করলেও মনু ও কুশিয়ারা নদীর পানি অব্যাহত বৃদ্ধির কারণে বন্যার আশংকায় রয়েছেন অসহায় লোকজন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে উভয় নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হলে মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ তা প্রতিরোধে যথা সময়ে ব্যবস্থা নেয়না। ফলে নদী তীরবর্তী মানুষজন বর্ষা মৌসুমে চরম আশংকায় দিনাতিপাত করেন এবং সঠিক সময়ে ভাঙ্গন রোদ না কয়ায় অনেকের বাড়িঘর নদী ভাঙ্গনের স্বীকার হয়্।
আব্দুল্লাহপুর গ্রামের ইউপি সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিমল দাশ(৭০) জানান, এলাকার লোকজন নিয়ে নদীভাঙ্গন প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছি। ইতোপূর্বে নিজে উদ্যোগ নিয়ে দুটি ভাঙ্গন মেরামত করেছি। এরপরও শুধু ফতেহপুর ইউনিয়নে প্রায় ১১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এব্যাপারে মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল জানান, মনু ও কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধ মূলক কাজ চলমান রয়েছে। আপাতত বৃষ্টির জন্য কাজ বন্ধ রয়েছে। ইতোমধ্যে উভয় নদীর বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙ্গন মেরামত করা হয়েছে এবং নদী তীরবর্তী এলাকার ইউপি সদস্যদের নিকট ভাঙ্গন প্রতিরোধক জিও ও সিনথেটিক বেগ হস্তান্তর করা হয়েছে। ভাঙ্গন প্রতিরোধে সব ধরণের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।
অপরদিকে, গত ক’দিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কমলগঞ্জের খরস্রোতা ধলাই নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বুধবার সকালে নদীর পানি বিপদ সীমার ৩৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টায় এ রিপোর্ট লিখার সময় ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার ২০ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে বুধবার সকালে ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চৈতন্যগঞ্জ, রহিমপুর ইউনিয়নের বড়চেগ ও মুন্সীবাজার ইউনিয়নের খুশালপুরে প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙন দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এতে বড়চেগ, নারায়ণপুর, চৈতন্যগঞ্জ, বাদে উবাহাটা, খুশালপুর, ছয়কুট সহ প্রায় ৪০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। বানের পানি ও পাহাড়ি ঢলে কমলগঞ্জ-মৌলভীবাজার সড়কের ছয়কুট এলাকা এবং আদমপুর ইউনিয়নের কাঁঠালকান্দি-আধকানী সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের প্রায় ১০টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এলাকাবাসী। এদিকে ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ধলাই নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ড্রেন দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে পৌর এলাকার ২টি ওয়ার্ডের পানিশালা, কমলগঞ্জ, ৩ নং ওয়ার্ডের নসরতপুর, খুশালপুর আংশিক ও ৫নং ওয়ার্ডের চÐীপুর গ্রামের ২৫ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ড্রেন দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায় কমলগঞ্জ ডাক বাংলো, কমলগঞ্জ মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও কমলগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। উজানের এ পানি নিম্নাঞ্চলে গিয়ে শমসেরনগর, পতনউষার ও মুন্সীবাজার ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা নিমজ্জিত হয়েছে। বানের পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলী মাঠ, ভেসে গেছে পুকুর ও ফিসারির লাখ লাখ টাকার মাছ। মৌলভীবাজারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা জানান, ধলাই নদীর পানি বুধবার বিকালে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধলাই নদীটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রয়েছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙনের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বন্যার্তদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণের ত্রাণ মজুত রয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করছি।
এছাড়া ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বুধবার কুশিয়ারা নদী (ফেঞ্চুগঞ্জ) এর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ১০.৪৫ মিটারে অবস্থান করছিলো। যা বিপদসীমা থেকে ১মিটার (৩ফিট) বেশি। এর কারনে পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার নতুন নতুন এলাকায় আক্রমণ করছে। বন্যার আক্রমণের শিকার এই উপজেলার ৫টি ইউনিয়নই। এর মধ্যে উপজেলার নিম্নাঞ্চল, নদীপার এলাকা ও হাকালুকি হাওর ঘেষা এলাকার অবস্থা বেশি অবনতি। ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের মধ্য বাজার ও পুর্ববাজার ডুবে আছে দুদিন ধরে। হাসপাতাল রোড ও আশপাশের কয়েকটি সরকারি দপ্তর, ফার্মেসি, সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, জনস্বাস্থ্য উপ প্রকৌশলী অফিস ইত্যাদিও তলিয়ে গেছে। ফেঞ্চুগঞ্জ থানারোড থেকে পুর্ব বাজার হয়ে ১নং ইউনিয়নের অনেকগুলো গ্রাম বন্যা আক্রান্ত। একই ভাবে আক্রান্ত মাইজগাও, উত্তর ফেঞ্চুগঞ্জ ও উত্তর কুশিয়ারা ইউনিয়নের অনেক এলাকা। কারো বাড়িঘরে কারো রাস্তায় পানি। মানুষ ছাড়াও বিপাকে পড়েছে গবাদি পশুরা। অন্যদিকে উত্তর ফেঞ্চুগঞ্জ ইউনিয়নের মল্লিকপুর হাজী করম উল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশের সড়ক টপকে কুশিয়ারা নদীর পানি হুহু করে ঢুকছে মল্লিকপুর হাওরে। যে কারনে এই পানির কারনে মল্লিকপুর থেকে ইলাশপুর ভায়া সড়কটি তলিয়ে যাবার আশংকা বেড়েছে। এই সড়কটি তলিয়ে গেলে সিলেটের সাথে বিস্তৃত অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারজানা প্রিয়াঙ্কা বলেন, আমরা ২৯টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলেছিলাম এখন লোকজন অন্য আরেকটায় উঠায় মোট আশ্রয় কেন্দ্র হয়েছে ৩৯টি। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যগন, বাজার বনিক সমিতির নেতৃবৃন্দ সহ সম্মিলিত ভাবে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে খাবার সহ অন্যান্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। তা ছাড়া ৫টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের কাছে জিআর এর চাল পাঠানো হয়েছে। তারা প্রয়োজন দেখে বাড়িতে বাড়িতে বিতরণ করবেন।
হবিগঞ্জঃ
সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েক দিনের ভারি বৃষ্টির ফলে হবিগঞ্জে বন্যার পরিস্থিতি চরম অবনতির দিকে যাচ্ছে। অব্যাহতভাবে বাড়ছে কুশিয়ারা নদীর পানি। এরই মধ্যে নবীগঞ্জ উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কিছু স্থানে বন্ধ হয়ে গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। পানি বৃদ্ধি পেলে কুশিয়ারা নদীঘেঁষা বিবিয়ানা বিদ্যুৎ পাওয়ার প্ল্যান্ট ও বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে পানি প্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে।
জানা যায়, উপজেলার ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের সুনামগঞ্জ, জগন্নাথপুর, আউশকান্দি আঞ্চলিক মহাসড়ক ডুবে দ্রæতগতিতে পানি প্রবেশ করছে কসবা গ্রাম, কসবা বাজারসহ কয়েকটি গ্রামে। দীঘলবাক ইউনিয়নের রাধাপুর, ফাদুল্লাহ, দুর্গাপুর, মথুরাপুর, হোসেনপুর, মাধবপুর, পশ্চিম মাধবপুর, গালিমপুর, আউশকান্দি ইউনিয়নের পাহাড়পুর, পারকুল, উমরপুর, দীঘর ব্রাহ্মণগ্রাম, বড় ভাকৈর (পশ্চিম) ইউনিয়নের সোনাপুর, চরগাঁওসহ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া বড় ভাকৈর (পূর্ব), ইনাতগঞ্জের উমরপুর, মোস্তফাপুর, দক্ষিণগ্রাম, পাঠানহাটি, মনসুরপুর, দরবেশপুর, দিঘীরপাড়, নোয়াগাঁও, চন্ডিপুর, প্রজা, লামলীপাড়, আউশকান্দির বনগাঁও, পারকুল গ্রাম পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি দ্রæত বৃদ্ধি পাওয়ায় ভয়াবহ আকার ধারণ করছে বন্যা। মানবেতর জীবনযাপন করছেন সাধারণ মানুষ। দিশেহারা অসহায় মানুষজন ছুটছেন নিরাপদ আশ্রয়স্থলে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়- ইনাতগঞ্জের মোস্তফাপুর পাঠানহাটি গ্রামের পাকা সড়ক, দীঘলবাক গ্রামের পাকা সড়কসহ ১৫-২০টি পাকা সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ইনাতগঞ্জ অবস্থিত এশিয়া মহাদেশের অন্যতম গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা ও পারকুলে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী ঘেঁষা বিবিয়ানা ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র হতে ২-৩ হাত নিচে বর্তমানে পানি রয়েছে। তবে দ্রæত পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্যাসক্ষেত্রে পানি প্রবেশের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনুপম দাশ অনুপ বলেন, বন্যা আক্রান্ত হয়ে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আসছেন। ইতোমধ্যে ১৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, আমরা সবসময় মানুষের পাশে আছি।
এদিকে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ভারী বর্ষণের ফলে খোয়াই ও সুতাং নদীর পানি বেড়ে চুনারুঘাট উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। মঙ্গলবার ১৯জুন সহ গত দুইদিনের বর্ষণের কারণে উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার নির্মাঞ্চল প্লাবিত হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আকস্মিক বন্যায় বেশকিছু ধানের জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। গাজীপুর, আহম্মদাবাদ, মিরাশি, রানীগাঁও, সাটিয়াজুরী ও শানখলা ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশত গ্রামে পানি ঢুকেছে। এ অবস্থায় গ্রামগুলোর মানুষ মারাত্মক কষ্ট দুর্ভোগ পড়ছেন। বুধবার দুপুরে খোয়াই নদীর চুনারুঘাট ব্রীজ পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়া করাঙ্গী ও সুতাং নদীর পানিও হু হু করে বাড়ছে। এসব নদীর বাঁধ উপচে নদী এলাকায় জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। চুনারুঘাটে প্রায় ১০হাজার হেক্টর ধান্য জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, “ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ভারী বর্ষণ হওয়ার কারণে চুনারুঘাট এলাকায় খোয়াই নদীতে পানি বাড়ছে। পানি বৃদ্ধির পরিমাণ আশঙ্কাজনক। বিষয়টি সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে।
এদিকে, মঙ্গলবার দুপুরে নালুয়া চা বাগান, সাটিয়াজুরী ও রানীগাঁও ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি গ্রামে পানি ঢুকেছে। ফসলি জমিসহ পুকুর তলিয়ে গেছে। করাঙ্গী নদীর দু’পাড় বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কুনাউড়া, কৃষ্ণপুর, চিলামি, দৌলতপুর ও দারাগাঁওসহ ৭/৮ গ্রামের মানুষের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ছাত্রছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ।
শানখলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম জানান, তাঁর ইউনিয়নে পাহাড়ি ঢলে ও সুতাং নদীর পানি উপচে ৭/৮ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সাটিয়াজুরী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দালুর রহমান জানান, করাঙ্গী নদীর দুপাড়ে ১০/১২ টি গ্রাম সম্পুর্ণ প্লাবিত হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না। আহম্মদাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন পলাশ জানান, তার ইউনিয়নের ৫/৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এ বিষয়ে চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আয়েশা আক্তার জানান, বন্যার আশঙ্কা নেই, তিনি বেশ কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। ভাঙ্গন এলাকা সার্বক্ষনিক খবর রাখতে ও ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অফিসকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।