কাজির বাজার ডেস্ক
বেসরকারি চাকরিজীবী সাইদুল ইসলাম মাঝারি সাইজের ব্যাগে কয়েক পদের সবজি কিনে মিনিট বিশেক ধরে বাজারে ঘুরছেন। উদ্দেশ্য, তরিতরকারির সঙ্গে মিলিয়ে ছোট-বড় যে কোনো ধরনের মাছ কেনা। তবে সাধ্যের বাজেটে কোনোভাবেই তা মেলাতে পারছেন না তিনি। অথচ একই বাজার থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাবদা, চেলা ও চিংড়িসহ বেশ কয়েক ধরনের মাছ কিনে ব্যাগ ভরেছেন তারই এক প্রতিবেশী। বিক্রেতার সঙ্গে দরকষাকষি করতেও তেমন সময় ব্যয় করেননি ওই মোটরপার্টস ব্যবসায়ী। শুধু কাঁচাবাজারেই নয়, সব ধরনের ভোগ্যপণ্য কেনাকাটাতেও এই একই চিত্র। স্বাদের সঙ্গে সাধ্যের সমন্বয় করতে গিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষ দীর্ঘক্ষণ বাজারে ঘুরে গায়ের ঘাম ঝরাচ্ছেন। আর পর্যাপ্ত অর্থ হাতে থাকা এক শ্রেণির মানুষ কোনো ধরনের দরদাম করা ছাড়াই নানা ধরনের পণ্য কিনে ঘরে ফিরছেন। বিক্রেতারা যে কোনো মালামাল নির্বিঘেœ তাদের কাছে বিক্রি করতে পারায় ইচ্ছেমত দাম হাঁকাচ্ছেন। যা দেশের সব ধরনের পণ্যের বাজারকে ক্রমেই অস্থিতিশীল করে তুলছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় দ্রæত এগোলেও নানারকম অদক্ষতা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও সম্পদের সুষম বণ্টনের অভাবে বেড়েছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। গত এক দশকে এ বৈষম্য প্রকট থেকে আরও প্রকটতর হয়েছে। ধনীরাই দিন দিন ধনী হচ্ছে। আর গরিবরা হচ্ছে অতি গরিব। যা দেশের সমাজ ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে তৈরি করেছে এক ধরনের অস্বস্তি আর অসমতা। আর তা মূল্যস্ফীতি আরও উসকে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে শেষ অর্থবছরে (২০২২-২৩) মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬০ টাকা, যা আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) ছিল ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৭ টাকা। তবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জিত হলেও বৈষম্য নিরসন করা সম্ভব হয়নি। ব্যাংক খাতের আমানতের অর্ধেকেরই মালিক দেশের কোটিপতিরা। অর্থাৎ ধনীরাই ধনী হচ্ছে। বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল পাঁচজন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতিদের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এভাবে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট দাঁড়ায় ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬টিতে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি। দেশের ব্যাংকগুলোতে মোট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি ৫০ লাখ। এসব অ্যাকাউন্টে যে পরিমাণ অর্থ জমা আছে, তার অর্ধেকের মালিক ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০৮ জন অ্যাকাউন্টধারী। সে হিসাবে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের প্রায় অর্ধেকের মালিকই কোটিপতিরা।
বৈষম্যের নির্দেশক গিনি সহগ সূচক এখন দশমিক ৪৯৯ পয়েন্ট। দশমিক ৫০০ পয়েন্ট পেরোলেই উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ উচ্চ বৈষম্যের দেশ থেকে অতি সামান্য দূরত্বে আছে বাংলাদেশ। দেশে একজন গরিবের তুলনায় ধনীর আয় অন্তত ১১৯ গুণ বেশি। অর্থাৎ একজন গরিব ১ টাকা আয় করলে একজন ধনী আয় করে ১১৯ টাকা। এদিকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতেই এখন দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর আয়ের এই অস্বাভাবিক বৈষম্য ভোগের ক্ষেত্রেও বড় প্রভাব ফেলেছে। নিম্ন আয়ের মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হলেও বিত্তবান পরিবারে নানা ধরনের ভোগ্যপণ্যের অপচয় হচ্ছে। তাদের একটি বড় অংশ প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি জিনিস কিনছে। ফলে মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে যে বড় প্রভাব পড়ার কথা, তার অনেকটাই সমন্বয় হয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র এ কারণেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হোতারা যে কোনো পণ্যের দাম ইচ্ছেমত বাড়িয়ে অস্থিতিশীল বাজার সামাল দিতে পারছে।
আয় বৈষম্যের কারণে ভোগ বৈষম্য বেড়ে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার বিষয়টি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারাও নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। তাদের দাবি, বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিষয়াদি পর্যবেক্ষণে তাদের কাছে এ চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, তারা রাজধানী গুলশানের ভাসাবি নামের একটি ফ্যাসন হাউজে ৮৫ হাজার টাকা মূল্যমানের লেহেঙ্গা পেয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন নামিদামি শোরুমে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দামে শার্ট এবং এক থেকে দেড় লাখ টাকার স্যুট দেদার বিক্রি হচ্ছে। ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেল সারিনা এনেছিল সোনায় মোড়ানো আইসক্রিম। ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকায় বিক্রি হওয়া ওই আইসক্রিম ৭ দিনের মধ্যেই ‘ওভারবুকড’ হয়ে যায়। রমজান মাসে ২০ হাজার টাকায় এক কেজি দরে সোনায় মোড়ানো জিলাপি খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। পুরো রমজান মাসজুড়েই এই জিলাপি বিক্রির প্রস্তুতি থাকলেও তা ৭ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। অথচ একই সময় দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ শুধুমাত্র পানি কিংবা ছোলা-মুড়ি ছাড়া অন্যকিছু ইফতারির প্লেটে জোগাড় করতে পারেনি। গত রমজানে খেজুরের দাম আকাশচুম্বি হওয়ায় কোটি কোটি রোজাদারের পক্ষে সুন্নতি এ খাবার দিয়ে রোজা ভাঙা সম্ভব হয়নি।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশে একটা গোষ্ঠীর হাতে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ চলে গেছে এবং সে কারণেই ২০ হাজার টাকা কেজির জিলাপিও শেষ হয়ে যায় হুহু করে। এক লাখ টাকা দামের আইসক্রিমও শেষ হতে তেমন সময় লাগে না। বাজারে মাছ-মাংস, তরিতরকারি, ডিম-দুধসহ যে কোনো খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ালেও বিক্রিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে না।
এদিকে স্বল্প আয়ের মানুষের খাদ্যসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের কেনাকাটা কমার বিষয়টি বিক্রেতারাও স্বীকার করেছেন। তারা জানান, গত ঈদুল ফিতরে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য যেসব মার্কেট রয়েছে, সেগুলোতে কাক্সিক্ষত বেচাকেনা হয়নি। এসব মার্কেটে ঈদ কেনাকাটা ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমেছে। তবে উচ্চবিত্তদের মার্কেটগুলোতে বরাবরের মতো ভিড় লেগেই ছিল। সেখানকার বেশিরভাগ দোকানে টার্গেটের চেয়ে বেশি পোশাক-পরিচ্ছেদ ও প্রসাধনীসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রি হয়েছে।
রামপুরা কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা আবুল সালেহ জানান, নিম্নবিত্তরা আগের চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম তরিতরকারি কিনছেন। এছাড়া তাদের ক্রয় তালিকায় বেশিরভাগ কম দামের সবজি থাকছে। তবে দোকানিদের বেচাকেনায় এর তেমন প্রভাব পড়েনি। কারণ এক শ্রেণির ক্রেতার কাছে তারা নির্বিঘেœ চড়া দরের সবজি বিক্রি করতে পারছেন। ফলে সবমিলিয়ে তাদের ব্যবসা আগের মতো রয়েছে। সিন্ডিকেটের বিশেষ কারসাজিতে মৌসুমি সবজির দাম অকারণে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন ওই দোকানি।
এদিকে আয় বৈষম্যের কারণে বাজার অস্থিতিশীলতার বিষয়টি একটি মাত্র ইস্যু হিসেবে মেনে নিলেও এর নেপথ্যে আরও একাধিক কারণ রয়েছে বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, দেশের জন্য জরুরি নিত্যপণ্যের আমদানি এখন প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে হাতেগোনা কয়েকটি গোষ্ঠী। তবে বাজারের নিয়ম অনুযায়ী পণ্য আমদানি ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার বদলে তারা একে অন্যের সহযোগী হিসেবে আবিভর্‚ত হয়ে পণ্য আমদানির প্রতিটি পর্যায়ে তাদের কর্তৃত্ব তৈরি করেছে। এর ফলে বাজারের ওপর একক ‘কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা’ হয়েছে তাদের, যার জের ধরে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন ভোক্তারা। যা নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে দুর্নীতি বা অন্য যে কোনোভাবে বিত্তশালী মানুষের তা গায়ে লাগছে না।
গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই আমদানির ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এমন পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং কয়েকটি জরুরি পণ্যের মার্কেট শেয়ার এখন কয়েকটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। আমদানি থেকে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত নিজেদের বলয় তৈরি করে নিজেদের শর্তে বাজারে পণ্য দিচ্ছে তারা। তাদের কথা মতো না হলে অন্যরা ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে একটি চক্র জরুরি নিত্যপণ্য আমদানি করা থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে তার একটি ‘ভয়াবহ চিত্র’ পাওয়া গেছে। তারা জানান, বড় ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে ব্যবসা ভাগাভাগি করছে বলেই ছোট ব্যবসায়ীরা রেস থেকে ছিটকে পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের একজন পাইকারি ব্যবসায়ী জানান, বড় ভলিউমে পণ্য আমদানি করা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একজোট হয়েছে। এখন মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা ওই বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে নিজের ইচ্ছে মতো পণ্য কিনতে পারেন না। বরং বড় ব্যবসায়ীদের কাছে গেলে তারাই ঠিক করে দেন যে, কোন পণ্য কত দামে কার কাছ থেকে কিনতে হবে। তা না হলে তাকে কৌশলে ব্যবসায়িকভাবে কঠিন বিপদের মধ্যে পড়তে হবে।