নির্বাচনী প্রচারে দেশের বিভিন্ন স্থানে নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকের মধ্যে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। গতকালও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, মারধর, ভাঙচুরের খবর এসেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৩৮ জন। এর মধ্যে ল²ীপুর-৪ আসনে নৌকা মার্কা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলায় অন্তত ১৯ জন আহত হয়েছেন। ভাঙচুর করা হয়েছে বেশ কয়েকটি গাড়ি। সংঘর্ষের সময় তিন রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কক্সবাজারে পাহারাদারকে বেঁধে রেখে কল্যাণ পার্টির একটি নির্বাচনী কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। নির্বাচনী প্রচারকালে অপহরণের চেষ্টা হয়েছে সিরাজগঞ্জ-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী বর্তমান এমপি ডা. আবদুল আজিজকে। এ ঘটনায় কৃষক লীগ নেতা পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তিকে আটক করেছে পুলিশ।
ল²ীপুর-৪ আসনে ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ছেন জাসদ নেতা মোশারফ হোসেন। স্থানীয়রা জানান, সোমবার গভীর রাতে কমলনগর উপজেলার নোয়াহাট বাজারে নৌকা প্রতীকের একটি ক্যাম্পে ঢুকে এক কর্মীকে মারধর করে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল্লাহ আল মামুনের ঈগল প্রতীকের সমর্থকরা। এ নিয়ে এক পর্যায়ে নৌকার সমর্থকরা পাল্টা হামলা চালায় ঈগল সমর্থকদের ওপর। উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ১৯ জন আহত হন। সংঘর্ষের সময় তিন রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা যায়। খবর পেয়ে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ইউএনও এবং কমলনগর থানার ওসি পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। আহতদের মধ্যে ঈগল প্রতীকের নির্বাচনী সমন্বয়ক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের আহŸায়ক মেজবাহ উদ্দিন বাপ্পি রয়েছেন।
ঈগল প্রতীকের প্রার্থী আবদুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, নৌকার মিছিলে না যাওয়ায় জেলা পরিষদের সদস্য গিয়াস উদ্দিন মোল্লার নেতৃত্বে মোশারফ হোসেনের সমর্থকরা তাঁর কয়েকজন সমর্থককে পিটিয়ে আহত করেছে। এ ব্যাপারে তিনি লিখিত অভিযোগ দেবেন। তবে নৌকা প্রতীকের প্রধান সমন্বয়ক ও রামগতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ বলেন, নির্বাচনী কার্যালয়ে ঢুকে ঈগলের সমর্থকরা আমাদের কর্মীদের মারধর করেছে। এ সময় তারা ফাঁকা গুলিও করে। যুবলীগের নাম ব্যবহার করে কিছু লোক নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
কমলনগর থানার ওসি তহিদুল ইসলাম জানান, এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া ঘটনার সময় গুলিবর্ষণের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে তিনি দাবি করেন।
কক্সবাজার-১ আসনে একই রাতে কল্যাণ পার্টির প্রার্থী সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের হাতঘড়ি প্রতীকের একটি নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় ক্যাম্পের পাহারাদার আবু সালেককে পিটিয়ে আহত করে বেঁধে পাশের একটি ক্ষেতে ফেলে রাখা হয়। আবু সালেককে উদ্ধার করে চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আসনের বর্তমান এমপি জাফর আলমের লোকজন এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ ইবরাহিমের। বিষয়টি সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন তিনি। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে এমপি জাফর আলম বলেছেন, এমন ঘৃণার কাজ কখনও আমরা করি না। এটি আমার সমর্থকদের ফাঁসানোর চেষ্টা হতে পারে।
সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের নৌকার প্রার্থী অধ্যাপক ডা. আবদুল আজিজ এমপিকে গতকাল অপহরণের চেষ্টা করা হয়। স্থানীয় সূত্র জানায়, গতকাল দুপুরে উপজেলা ভ‚ঁইয়াগাতী বাজারের পাশে গণসংযোগ করছিলেন এমপি আবদুল আজিজ। এ সময় মাইক্রোবাসে আসা ওয়াকিটকি হাতে এক যুবক এমপি আজিজকে আচমকা টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে। বিষয়টি দেখে এমপির সমর্থকরা ওই ব্যক্তিকে বাধা দেন এবং তাঁকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এ সময় নুরুল ইসলাম প্রামাণিক নামে ওই যুবকের পকেটে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী নূরুল ইসলাম উজ্জ্বলের লিফলেট পাওয়া যায়। নুরুলকে আটকের পরপরই তাঁকে বহনকারী মাইক্রোবাসটি ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়ে। আটক নুরুল নিজেকে তাড়াশ উপজেলা কৃষক লীগের সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির সাবেক আহŸায়ক হিসেবে পরিচয় দেন। পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মÐল জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
এ বিষয়ে এমপি আজিজ বলেন, ‘কেন লোকটি আমাকে ওইভাবে টানাহ্যাঁচড়া করল, তা আমি পরিষ্কার নই। এ বিষয়ে পরে খোঁজখবর নিয়ে জানাব।’ স্বতন্ত্র প্রার্থী নূরুল ইসলাম উজ্জ্বল বলেন, ‘নুরুল নামে লোকটিকে আমি যতদূর চিনি, তিনি একজন মানসিক ভারসাম্যহীন বলে মনে হয়েছে।
কেউ যদি ভালোবেসে আমার পোস্টার বা লিফলেট তাঁর কাছে রাখে, এর জন্য তো আমি দায়ী না।’
সোমবার রাতে জয়পুরহাট-২ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের দুটি নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দেয় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা। এর জন্য নৌকা সমর্থকরা কাঁচি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক গোলাম মাহফুজ চৌধুরীর লোকজনকে দায়ী করেছেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহফুজ চৌধুরী বলেন, আমার কোনো লোকজন এ কাজ করেনি। ঘটনার সঠিক তদন্ত চাই। নাটোর-১ আসনে একই রাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এমপি শহিদুল ইসলাম বকুল ও ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল কালাম আজাদের দুটি ক্যাম্পে আগুন দেয় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা।
বরিশাল-৩ আসনে সোমবার রাতে নৌকা ও ট্রাক প্রতীকের সমর্থক দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়াকে কেন্দ্র করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক কর্মীকে মারধর এবং রহমতপুর ইউপির ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য জাহিদুল ইসলাম নয়নকে লাঞ্ছিত করেন নৌকার সমর্থকরা। একই রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী কাঁচি প্রতীকের প্রার্থী ফিরোজুর রহমান ওলিওর সমর্থক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আক্তার হোসেনের গাড়ি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ভাঙচুর করেন। এ ঘটনায় কাঁচি মার্কার তিন সমর্থক আহত হয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের ভাষ্য, উভয় পক্ষ থেকে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে।
সোমবার রাতে গাইবান্ধা-৫ আসনের সাঘাটা উপজেলায় জাতীয় পার্টির প্রার্থী আতাউর রহমান সরকার আতার একটি নির্বাচনী অফিস পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার জন্য আতাউর রহমান নৌকা ও ট্রাক প্রতীকের কর্মীদের দায়ী করেছেন। এ ছাড়া গতকাল সকালে পটুয়াখালী-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল হোসেনের দুই কর্মীকে রড দিয়ে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে গলাচিপা থানায় নৌকা সমর্থক কলাগাছিয়া ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম সিকদারসহ চারজনের বিরুদ্ধে জিডি হয়েছে।
এদিকে ল²ীপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রহমান পবনের সমর্থকদের ওপর সোমবার হামলার ঘটনায় গতকাল মামলা হয়েছে। মামলায় নৌকার প্রার্থী ড. আনোয়ার হোসেন খানের পাঁচ সমর্থককে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া গাজীপুর-২ আসনের টঙ্গীতে নৌকার প্রার্থী জাহিদ আহসান রাসেল ও ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী আলম উদ্দিন বুদ্দিনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা হয়েছে। সোমবার রাতে নৌকা প্রতীকের সমর্থকদের নামে টঙ্গী পশ্চিম থানায় মামলা করেন ট্রাক প্রতীকের সমর্থকরা। এ ছাড়া পিরোজপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী রুস্তম আলী ফরাজীর সমর্থকদের ওপর দুর্বৃত্তের হামলার প্রতিবাদে গতকাল মানববন্ধন হয়েছে।
বরিশাল-২ আসনে ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের নৌকা মার্কার সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী ফাইয়াজুল হক রাজুর ঈগল প্রতীকের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে ইউপি চেয়ারম্যানসহ ১৬ জন আহত হয়েছেন। এ সময় ১৪-১৫টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।