কাজির বাজার ডেস্ক
ঢাকা জেলায় বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে ১২ হাজারের বেশি। নির্বাচন সামনে রেখে চলছে এসব লাইসেন্সের তথ্য হালনাগাদ করার কাজ। সাধারণত এসব বৈধ অস্ত্র নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর জমা দেওয়ার নির্দেশনা থাকে। নির্দেশনার পরও জমা না দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নবায়ন কিংবা তথ্য হালনাগাদ না করলে বাতিল হয় অস্ত্রের বৈধতা।
ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, রাজধানীসহ ঢাকায় বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে ১২ হাজার ৪৩৬টি। এর মধ্যে শটগান ও বন্দুক ৬ হাজার ৭৪, পিস্তল ৪ হাজার ৬১, রিভলবার ১ হাজার ৩২০ ও রাইফেল ৮৫১টি। বাকি ১৩০টি অস্ত্রের লাইসেন্স জেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া হলেও এখনো কেনা হয়নি। নির্বাচন সামনে রেখে চলছে হালনাগাদ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সন্নিকটে। এই নির্বাচন সামনে রেখে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও অস্ত্রের লাইসেন্সধারীদের তথ্য অনলাইনে এন্ট্রি করছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। প্রতিদিন ৫০ থেকে ১৫০ জন অনলাইনে তথ্য এন্ট্রি করতে আসছেন জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে। এরই মধ্যে প্রায় দেড় হাজার বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও অস্ত্রের লাইসেন্সধারীর তথ্য অনলাইনে এন্ট্রি করা হয়েছে। বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স থাকা এক ব্যক্তি বলেন, ‘বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও অস্ত্রের লাইসেন্সধারীদের তথ্য অনলাইনে এন্ট্রি করার গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে জেলা প্রশাসন। তাই তথ্য হলনাগাদ করলাম। অস্ত্রের তথ্য ও তালিকা থাকা দরকার। একই সঙ্গে সবাই যথাযথ ব্যবহার করছে কি না তাও তদারকি করা দরকার। নিয়ম মেনেই নিজের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করতে চাই।’
‘আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা, ২০১৬’ এর ধারা ৩৫ এ বলা আছে, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রাপ্তির পাঁচ বছরের মধ্যে অস্ত্র না কিনলে লাইসেন্সটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল বলে গণ্য হবে। বাতিল লাইসেন্স পুনর্বহাল করা যাবে না।
এছাড়া যেসব অস্ত্র নবায়ন করার কথা তা যদি পাঁচ বছরের মধ্যে নবায়ন না করে তাহলে সেই অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। সরকার যে কোনো সময় লাইসেন্স বাতিল করার এখতিয়ার রাখে। এছাড়া নীতিমালা ভঙ্গ করে ব্যবহার, সময়মতো নবায়ন না করা প্রভৃতি কারণে ঢাকা জেলায় বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কমেছে।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আগে ঢাকায় প্রায় ২০ হাজার বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল। এখন সেটা কমে ১২ হাজারে নেমেছে।’
লাইসেন্স কমার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, ‘আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সপ্রাপ্তির পাঁচ বছরের মধ্যে অস্ত্র না কিনলে এবং পাঁচ বছর কোনো অস্ত্রের নবায়ন না করলে লাইসেন্সটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায়। বাতিল হলে সেই লাইসেন্সটি আর থাকে না। বেশিরভাগই এ কারণে বাতিল হয়। এছাড়া নীতিমালা ভঙ্গ করে ব্যবহার, সরকার যে কোনো সময় লাইসেন্স বাতিল করার এখতিয়ারেও বাতিল হয়।’ ঢাকা জেলার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনিসুর রহমান বলেন, ‘লাইসেন্স করা অস্ত্রের ডাটাবেজটা ডিজিটাল করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অধীনে ডিজিটাল আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করে সারাদেশের সব জেলার লাইসেন্স করা বৈধ অস্ত্রের তালিকা তৈরি করছে। ঢাকা জেলায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লাইসেন্স করা বৈধ অস্ত্র রয়েছে। আমাদের জেলার ডাটাবেজ এন্ট্রি করা হচ্ছে। এটা অনলাইনে দিলে জানা যাবে কতগুলো অস্ত্র কী অবস্থায় আছে।’
বৈধ অস্ত্র ব্যবহারের নীতিমালা
‘আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা, ২০১৬ এর ধারা ২৫ (ক) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি স্বীয় লাইসেন্স এন্ট্রি করা অস্ত্র আত্মরক্ষার জন্য নিজে বহন বা ব্যবহার করতে পারবেন। তবে, অন্যের ভীতি বা বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে, এরূপভাবে অস্ত্র প্রদর্শন করা যাবে না। আর ২৫ (গ) অনুযায়ী, আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্সধারী কোনো ব্যক্তি নিজ ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বা সম্পত্তি রক্ষার জন্য অস্ত্রধারী প্রহরী হিসেবে নিয়োজিত হতে পারবে না।’ বয়স ৩০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে থাকা কোনো ব্যক্তির জীবনের ঝুঁকি থাকা, বছরে তিন লাখ টাকা আয়কর দেওয়াসহ কিছু শর্ত থাকে অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে আবেদন করার জন্য। এছাড়া ১৮৭৮ সালের আর্মস অ্যাক্ট ও ১৯২৪ সালের আর্মস রুলসের আওতায় যে কোনো সামরিক বা বেসামরিক নাগরিক বৈধ অস্ত্রের আবেদন করতে পারেন।
লাইসেন্স ও নবায়ন ফি
লাইসেন্স পাওয়ার পর আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য লাইসেন্স ফি ও নবায়ন ফি দিতে হয়। ব্যক্তি পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের ধরন অনুযায়ী ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাইসেন্স ফি দিতে হয়। আর নবায়ন ফি দিতে হয় ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের জন্য লাইসেন্স ফি ২০ হাজার টাকা, নবায়ন ফি ৫ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে লাইসেন্স ফি ৫০ হাজার টাকা, নবায়ন ফি ১০ হাজার টাকা। ডিলার ও মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ফি ১ লাখ টাকা, নবায়ন ফি ২০ হাজার টাকা। সেফ কিপিংয়ের লাইসেন্স ফি ২০ হাজার টাকা, নবায়ন ফি ৫ হাজার টাকা করে দিতে হয়। তবে ধারা ৩২ (১) অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদিত কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির লাইসেন্সপ্রাপ্তির জন্য বিশেষ প্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তাদের নির্ধারিত আয়কর পরিশোধে বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
রাজধানীতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারজনিত মামলা
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে অস্ত্র আইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে উদ্ধারজনিত কারণে মামলা হয়েছে ২০২০ সালে ১৫৫টি, ২০২১ সালে ১৯২টি, ২০২২ সালে ১৯৬টি ও ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ৮৪টি। নির্বাচনের বছর অবৈধ অস্ত্রের বিস্তার ও উদ্ধার বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার আমাদের নিয়মিত কাজ। নির্বাচন এলে অপরাধীদের কেউ কেউ অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে এক ধরনের প্রভাব খাটাতে চায়। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তৎপর থাকে কেউ যেন অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা না করতে পারে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর।
নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র জমা ও পুলিশের ব্যবস্থা
নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেয় নির্বাচন কমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম-সচিব (রাজনৈতিক-১ অধিশাখা) আবু হেনা মোস্তফা জামান বলেন, ‘প্রতিটি নির্বাচনেই এটি আমরা করি। নির্বাচন এলে আমাদের এ ধরনের নির্দেশনা থাকে। নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়গুলো এখনো শুরু হয়নি। শুরু হলে নির্দেশনার বিষয়ে জানতে পারবেন।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশনা এলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তা বাস্তবায়ন করবো। থানায় জমা দিতে বললে আমরা থানায় জমা নেবো।’ জমা না দিলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্দেশনা দেওয়ার পর জমা না দিয়ে রেখে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তার লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। অস্ত্র অবৈধ হয়ে যাবে। আর অবৈধ অস্ত্রের জন্য যে আইনগত ব্যবস্থা আমরা সেটাই নেবো।’
প্রয়োজন অস্ত্রের সঠিক তদারকি
ঢাকা জেলার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনিসুর রহমান বলেন, ‘গুলি কেনার জন্য যখন কেউ আমাদের কাছে আসে তখন সেটা যাচাই করা হয়। হিসাব ছাড়া কিনতে দেওয়া হয় না। কেউ অবৈধভাবে ব্যবহার করে হিসাব মেলাতে না পারলে আমরা তদন্ত করি। জবাবদিহিতা রয়েছে। যে কোনো জায়গায় ব্যবহার করা যাবে না। লাইসেন্স করা বৈধ অস্ত্রগুলো অবৈধভাবে ব্যবহারের সুযোগ খুবই কম। অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল হলে তা থানায় জমা দেওয়া হয়েছে কি না তার তদারকির ব্যবস্থা রয়েছে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘নির্বাচনের সময় আমাদের দেশে ভয়ভীতি ও প্রভাব বিস্তারের একটা পরিবেশ তৈরি হয়। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার তখন বেড়ে যায়। এ সময়ে বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্সধারীদের নীতিমালা ভঙ্গের একটা পরিবেশ থাকে। তাই এ সময়ে কিংবা নির্বাচন ছাড়াও লাইসেন্সধারী অস্ত্রের তদারকি যথাযথভাবে করা উচিত। আর নির্বাচনের সময় এসব বৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার একটা নির্দেশনা থাকে। সেটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে করতে হবে।’