কাজির বাজার ডেস্ক
মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর পাড়ি জমাচ্ছেন বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিক। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করছেন সেখানেই। যদিও বিদেশে মৃত এ নারী শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেকেরই মরদেহ দেশে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বিদেশেই সমাহিত করতে হচ্ছে তাদের। সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিদেশে মৃত্যু হয়েছে ৫২১ প্রবাসী নারী শ্রমিকের। তাদের মধ্যে ২৭০ জনের মরদেহ দেশে আনা সম্ভব হয়েছে। বাকি ২৫১ জনকে সমাহিত করা হয়েছে বিদেশে।
দেশে আসা রেমিট্যান্সে বড় অবদান রয়েছে প্রবাসী নারী শ্রমিকদের। বিদেশে নতুন পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তাদের অনেকেই। দুর্ঘটনারও শিকার হচ্ছেন কেউ কেউ। তাদের মধ্যে কারো কারো মৃত্যুও ঘটছে। আবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় নারী শ্রমিকদের অনেকেই নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে মারা গেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ঘটেছে আত্মহত্যার ঘটনাও। তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেককে বিদেশেই সমাহিত করতে হচ্ছে। অভিবাসন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা ও খরচের কারণে মরদেহ দেশে ফেরাতে চান না পরিবারের সদস্যরাই। আবার নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যয় ও ঝামেলা এড়াতে মৃত শ্রমিকের মরদেহ দেশে পাঠানোর দায়িত্ব নিতে চায় না। এছাড়া নথিপত্রের সমস্যা সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের অসহযোগিতার কারণেও অনেক সময় মরদেহ আনা সম্ভব হয় না। ২০২২ সালের মার্চে কাজের সন্ধানে সৌদি আরব পাড়ি জমান সাভারের সাবিনা। অভিযোগ আছে, সেখানে যাওয়ার পর ব্যাপক মাত্রায় নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাকে। চলতি বছরের জুলাইয়ে মৃত্যু হয় সাবিনার। তার মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা যায়নি। সৌদি আরবেই দাফন করা হয়েছে সাবিনাকে।
বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএমএসএ) পক্ষ থেকে সাবিনার মরদেহ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তার পরিবারও এ নিয়ে কিছুদিন চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু একপর্যায়ে ভোগান্তি ও জটিলতার মুখে সাবিনার মরদেহ দেশে ফেরানোর প্রয়াস বন্ধ করে দেন পরিবারের সদস্যরা।
বিওএমএসএর কর্মকর্তাদের অভিযোগ, প্রশাসনিক জটিলতা, নথিগত সংকট, সংশ্লিষ্ট দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশী দূতাবাসের অসহযোগিতাসহ নানা কারণেই বিদেশে মৃত নারী শ্রমিকদের বড় একটি অংশের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে প্রশাসনিক নানা জটিলতার কারণে মৃতের পরিবার বা স্বজনরা মরদেহ ফিরিয়ে আনার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।
বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের উপপরিচালক প্রবীর কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘বিদেশে মৃত্যুবরণকারী নারী শ্রমিকদের অন্তত অর্ধেকের মরদেহ দেশে আনা সম্ভব হয় না। অনেকের পরিবার প্রশাসনিক জটিলতা এড়াতে মরদেহ বিদেশেই দাফন করে ফেলতে বলে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নথিগত সংকটের কারণেও অনেকের মরদেহ আনা যায় না। যেমন সৌদি আরবে অভিবাসী নারী শ্রমিকরা দুই বছরের জন্য আকামা পান। দুই বছর পর তাদের মেয়াদ না থাকলেও আর্থিক সংকটের কারণে তারা সেখানে থেকে যান। তখন নথিবিহীন হওয়ায় তাদের মরদেহ দেশে পাঠানো সম্ভব হয় না। অনেক সময় নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে মরদেহ আনার খরচ বহন করতে চায় না। কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় বাঙালিরা এক হয়ে মরদেহের খরচ বহন করেন। অনেক ক্ষেত্রে তাও সম্ভব হয় না। মূলত এসব কারণেই মৃত নারী শ্রমিকদের অর্ধেক মরদেহ দেশে আনা সম্ভব হয় না।’
তিনি বলেন, ‘যেসব মরদেহ দেশে আসে সেগুলো দেখলেই মৃত্যুর কারণ কিছুটা বোঝা যায়। আমরা সরকারকে বলেছি, মরদেহগুলো দেশে এনে সেগুলোর পুনঃময়নাতদন্ত করার জন্য। কিন্তু সেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না।’ দেশের অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় গন্তব্যস্থল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যান সৌদি আরবে। মোট নারী অভিবাসীর ৪৪ দশমিক ১৮ শতাংশের গন্তব্য হলো দেশটি। ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ যান সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই)। এছাড়া ওমানে যাচ্ছেন ১০ দশমিক ২২ শতাংশ, জর্ডানে ১৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ ও কাতারে যাচ্ছেন ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। এর বাইরেও বাহরাইন, লেবানন, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মরিশাস ও হংকংয়ে যাচ্ছেন কিছুসংখ্যক নারী শ্রমিক।
এসব দেশে মৃত নারী শ্রমিকদের মরদেহ যাতে দ্রæততার সঙ্গে দেশে ফিরিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক সিআর আবরার। তিনি বলেন, ‘নারী শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেকের মরদেহ দেশে না আসার বিষয়টি অনেক বড় ঘটনা। মৃত মানুষের সৎকারের বিষয়টি আমাদের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। পৃথিবীতে এটা তাদের শেষ অধ্যায়। তাদের পরিবার-পরিজন যদি প্রিয়জনকে শেষবারের মতো না দেখতে পারে তাহলে তা সারা জীবনের জন্য ট্রমা হয়ে থেকে যায়। এ সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব সরকারের। খুব দ্রæত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বিদেশে মৃত নারী শ্রমিকদের প্রায় এক-পঞ্চমাংশের প্রাণহানির কারণ আত্মহত্যা। গত পাঁচ বছরে মৃত ৫২১ জনের মধ্যে ১১০ জন আত্মহত্যা করেছিলেন। সে হিসেবে বিদেশে মৃত নারী শ্রমিকদের ২১ শতাংশেরই মৃত্যুর কারণ ছিল আত্মহত্যা। এর মধ্যে ২০১৮ সালে আত্মহত্যা করেছিলেন একজন। পরের বছর এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২২-এ। এরপর ২০২০ সালে ২৪ জন, ২০২১ সালে ২৬ ও ২০২২ সালে ৩৭ জন আত্মহত্যা করেন। বাকিদের মৃত্যু হয়েছে অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা অন্যান্য কারণে।
প্রবাসে মৃত নারী শ্রমিকদের মরদেহ ফিরিয়ে আনায় জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার কথাটি স্বীকার করে নিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের কর্মকর্তারা। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রবাসে শ্রমিকদের কেউ মারা যাওয়ার পর বেশকিছু জটিলতা তৈরি হয়। কর্মস্থলে শ্রমিক মারা গেলে মালিককে তার দায়ভার নিতে হয়। সঠিক নথির অভাব, আকামার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক সময় মরদেহ আনতে জটিলতা তৈরি হয়। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকলে হাসপাতালের খরচ বাড়তে থাকে। মালিক সে খরচ বহন করতে চায় না। এ কারণে অনেক মরদেহ স্থানীয়ভাবে দাফন করে ফেলতে হয়। আবার অনেক পরিবার প্রশাসনিক সমস্যার মধ্যে আসতে চায় না। এ কারণে তারা সেখানেই মরদেহ দাফন করে ফেলতে চায়।’
এছাড়া মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের জনবলের সংকটও এখানে বড় একটি ভ‚মিকা রাখছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় চাইলেও অনেক কাজ করা যায় না। দূতাবাসগুলোয় জনবল কম। এত কম জনবল দিয়ে এত বেশি পরিমাণ মানুষের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানো দুরূহ। প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়োগ না দিলে এসব সমস্যার সমাধান করা কঠিন হবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, ‘বিষয়টাকে জেনারালাইজ করে বলা যাবে না। একেক দেশের একেক ধরনের প্রেক্ষিত থাকে। আমাদের এখানকার মানুষেরও নানা বাস্তবতা থাকে। এসব কিছু মিলিয়ে মরদেহ ফিরিয়ে আনা হয় না। অনেক সময় স্বজনরা আনতে চান না। অর্থনৈতিক সংকট থাকে। স্থানীয় কিছু বিষয় থাকে। বিদেশ যাওয়ার পর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে না। এগুলোসহ নানা কারণে মৃত্যুর পর তারা মৃত শ্রমিকের মরদেহ ফিরিয়ে আনতে চান না। বিষয়গুলো ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড দেখে। এ বিষয়ে জটিলতা কমানোর জন্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে।’