কাজির বাজার ডেস্ক
অন্যান্য নিত্যপণ্যের মতো ওষুধের দামও বেড়েই চলেছে। জনজীবন এত বেশি ওষুধ নির্ভর হয়ে গেছে যে, ওষুধের দাম এতটা বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে মানুষ। আমাদের প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রায় ৯৫ ভাগ ওষুধই এখন উৎপাদিত হচ্ছে আমাদের দেশে। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো রপ্তানি করছে ওষুধ সেখানে ওষুধের মূল্যের এই উস্ফলন কেন সেটা বোঝার উপায় নেই। আমাদের বাজারে কোনো কিছুর দাম বাড়লে আমরা জানি না। সাধারণ মানুষের কোনো কিছু জানার প্রয়োজন নেই ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে। বাজারে কোনো ধরনের প্রচারণা ছাড়া কোনো কোনো ওষুধের দাম ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ছয় টাকার ট্যাবলেটের দাম হয়েছে ৯-১০ টাকা পর্যন্ত। একবারে এত দাম বাড়ানো সমীচীন কি না তাও একবার ভাবেনি কেউ।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রোগীদের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে ওষুধের এই মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি যৌক্তিক করা প্রয়োজন। খুচরা বাজারে ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে অভিনব পদ্ধতি বেছে নিয়েছে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। তারা প্রশাসনের নজর এড়িয়ে ফার্মেসি মালিকদের মুঠোফোনে বার্তা দিয়ে ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে। প্রায় এক বছর ধরে একাধিক প্রতিষ্ঠান বিপণন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দাম বাড়ালেও কিছুই জানে না সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। দেশের শীর্ষ ছয় প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত ২৩৪টি জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, নির্ধারিত দরের চেয়ে বাজারে অনেক ওষুধ বেশি দামেও কেনাবেচা চলছে। কিন্তু তাতে কারও কোনো বক্তব্য নেই।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শীর্ষ ছয় কোম্পানির ওষুধের দাম সর্বোচ্চ বেড়েছে। একথা সবারই জানা যে, অত্যাবশ্যকীয় তালিকাভুক্ত ১১৭টি জেনেরিকের ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। ২০২২ সালের ৩০ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটির ৫৮তম সভায় এসব ওষুধের পুনর্র্নিধারিত দাম অনুমোদন করা হয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার প্যারাসিটামলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৫০ থেকে শতভাগ। মাত্র ৪০ টাকার এমোক্সিসিলিনের দাম করা হয়েছে ৭০ টাকা, ২৪ টাকার ইনজেকশন ৫৫ টাকা। ৯ টাকার নাকের ড্রপের দাম বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৮ টাকা। কোনো কোনো ওষুধের দাম ৯৯ থেকে ১৩২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। নিয়ম মেনেই ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের।
তারা বলছে, তাদের একটি টেকনিক্যাল কমিটি ওষুধ উৎপাদনকারীদের প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই করে দাম নির্ধারণের সুপারিশ করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। পুনর্র্নিধারিত মূল্য তালিকা দেখে এটা সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, সব ওষুধের দাম যৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়নি। যদিও ওষুধের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিকে দুষছেন ওষুধ শিল্প সমিতি। কিন্তু এটা শুধু কথার কথা।
দেশে স্বাস্থ্যসেবায় যে অর্থ ব্যয় হয় তার প্রায় অর্ধেকই যাচ্ছে ওষুধে। গত কয়েক দশকে এ ব্যয় কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। বর্তমানে এ ব্যয়ের হার ৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতে খরচের ১০০ টাকার মধ্যে ৪৪ টাকাই ওষুধের পেছনে ব্যয় হচ্ছে। এ খরচের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে ওষুধের খরচে বৈশ্বিক গড় ব্যয় ১৫ শতাংশ। সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারার কারণে দেশে এ ব্যয় বেশি। এতে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির বাড়তি ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার) বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্যপ্রযুক্তি ও ক্লিনিক্যাল গবেষণার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউভিআইএর তথ্যমতে, স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ে ওষুধের খরচ সবচেয়ে কম যুক্তরাজ্যে। দেশটিতে মোট স্বাস্থ্যসেবার খরচের মাত্র ৯ শতাংশ ওষুধে ব্যয় হয়। এর পরের অবস্থানে রয়েছে কানাডা। দেশটিতে এ হার ১০ শতাংশ। অন্য দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিলে ১৩ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় ১৪ শতাংশ, ফ্রান্সে ১৫ শতাংশ, ইতালি, জাপান ও জার্মানিতে ১৭ শতাংশ, স্পেনে ১৮ শতাংশ এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০ শতাংশ ওষুধের পেছনে খরচ হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপালেও স্বাস্থ্য ব্যয়ে ওষুধের খরচ বাংলাদেশের তুলনায় কম।
এ দেশগুলোর সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং গবেষণা থেকে জানা যায়, ভারতে ওষুধে ব্যয়ের হার ২৭ শতাংশ, নেপালে ২৬ শতাংশ ও পাকিস্তানে ৩০ শতাংশের কিছু বেশি। শুধু আমরা একটা দেশ দেশে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৪৪ শতাংশই ওষুধে খরচ হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। নিয়ম অনুযায়ী ১১৭টি ওষুধ বাদ দিয়ে দেশে যে পরিমাণ ওষুধ তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর মূল্য নির্ধারণ কোম্পানিই করে। এ ক্ষেত্রে অধিদপ্তর শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে, কোম্পানির দেয়া মূল্যে হাত দেয়ার ক্ষমতাও নেই তাদের। বিশ্বের যে কোনো দেশে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা করা ছাড়াও ওষুধগুলোর দাম নির্ধারণ করে সরকার। এটাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম। আমাদের দেশের ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতেও তা ছিল।
কিন্তু ১৯৯৪ সালে ওষুধ কোম্পানির দাবির মুখে বলা হলো, ১৭ শতাংশ ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ করবে, বাকিটা করবে কোম্পানি। এই আজগুবি নিয়মের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ওষুধের ওপর মানুষের নির্ভরতা কি পরিমাণ বেড়েছে তা দেখতে এটা ওষুধের দোকানের সামনে দাঁড়ালেই যথেষ্ট। রিকশাওয়ালা থেকে গাড়ি ওয়ালা সবাই মুড়ি মুড়কির মতো কিনছে ওষুধ। বাজারের খাবার, সবজি, ফলে ভেজাল, ফরমালিন, কার্বাইড থাকার কারণে ওষুধ সেবনের চর্চা বেড়েছে। একটু পেটে ব্যথা করলে রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে কিনে নিচ্ছে অ্যাসিডিটির ওষুধ। যার পরিমাণ মোট বিক্রীত ওষুধের ১৩ শতাংশের বেশি।
অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে এ হার ৬ শতাংশের বেশি। এরপরই দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ডায়াবেটিসের ওষুধ। ইনজেকশনের আকারে ব্যবহৃত এ ওষুধের হিস্যা মোট বাজারের সাড়ে ৩ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের মোট বিক্রীত ওষুধের প্রায় ২৩ শতাংশই দখল করে আছে অ্যাসিডিটি, অ্যান্টিবায়োটিক ও ডায়াবেটিস। ওষুধের দাম এই পরিমাণ বাড়ার কারণ হিসাবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির মধ্যে কোনো আইনি কাঠামো না থাকায় মধ্যস্বত্বভোগীরা ইচ্ছামতো ওষুধের দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটছে। এখানে ওষুধের দাম ও ওষুধ তৈরির কাঁচলের দামের মধ্যে কোনো সাযুজ্য নেই। মার্কেটিংয়ের নামে ওষুধ কোম্পানিগুলো এমন সব খরচ করে যাতে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়াতেই হয়।’
আমরা এমনই এক চর্চার মধ্যে পড়ে গেছি যে, আমাদের মস্তিষ্কে একটা কথা স্টোর হয়ে গেছে। অসুখ ও ওষুধ। আমাদের দেশের মোড়ে মোড়ে ওষুধের দোকানগুলো কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ দিয়ে দেয়, পারলে চিকিৎসাও দেয়। অন্যদিকে চিকিৎসক ও ওষুধ কেম্পোনিগুলো মানুষের ভেতরে এ ধারণা ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে যে, ওষুধ ছাড়া তার চলবে না। যে কারণে মানুষ ওষুধ নির্ভর জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এই সুযোগে ওষুধ কোম্পানি ওষুধের দাম বাড়ালে কোনো রাজনৈতিক দল, কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন কথা বলে না। রোগীরা দেশের ডাক্তারদের ওপর ভরসা তেমন করে না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘আমাদের দেশের চিকিৎসক ও ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি এমন এক রীতি চালু করেছে যে চিকিৎসকের কাছে ছোট একটা কিছু নিয়ে এলেও চিকিৎসক কিছু একটা ওষুধ দিয়ে দেন। দেখা যায় ওষুধ ছাড়াও নিরাময় সম্ভব কিন্তু সেটি না করে চিকিৎসকরা ওষুধ লিখে দেন। এটা মেডিক্যাল শিক্ষা ব্যবস্থারই সমস্যা। আমাদের শিক্ষাই দেয়া হয় মানুষ রোগ নিয়ে এলে নিরীক্ষা করার, ওষুধ দেয়ার কিংবা প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করার। এ ধারা চলে এসেছে। শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষই মনে করে কিছু হলেই ওষুধ খেতে হবে। যদি সকালে উঠে এক গøাস পানি খাই, যদি একটি ফল খাই তাহলে যে অনেক রোগ থেকে সুস্থ থাকা যাবে এ ধারণারই বাইরে তারা।’
ওষুধের দাম বাড়ানোর বিষয়টি যে হেলাফেলা নয় সেটা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কে বোঝাবে? এমনিতেই দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা ব্যয়বহুল। সরকারি/বেসরকারি হাসপাতালের যে কোনোটায় ভর্তি সংকটের শেষ নেই। ডাক্তারের পরীক্ষা-নীরিক্ষা আর ওষুধ কোম্পানিকে খুশি করতে (অধিকাংশের বেলায়) জীবন হয় ওষ্ঠাগত। আর খরচের ধাক্কা তো বলাই বাহুল্য। এর মধ্যে রোগীর যদি হয় ক্যানসার, কিডনির মতো জটিল অসুখ তাদের চিকিৎসা করতে নিঃস্ব হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। একদম সাধারণ অসুখ-বিসুখ মোকাবিলা করা ওষুধের দাম যেভাবে বাড়ছে এর থেকে নিষ্কৃতি দরকার। নতুবা ওষুধ ও অধিকাংশ চিকিৎসকের বাণিজ্যিক মানসিকতার কারণে দেশের বাইরে যাওয়া রোগীর পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।